ট্রাম্পের ঘোষণার নেপথ্যে অস্ত্র ব্যবসা?
ইসরায়েলের রাজধানী হিসেবে জেরুসালেমকে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের দায়িত্বহীন ঘোষণা মধ্যপ্রাচ্যে মারাত্মক বিপজ্জনক ফল বয়ে আনতে পারে। আঞ্চলিক বিশ্লেষকরা বলছেন, জেরুসালেমকে ইসরায়েলের রাজধানীর স্বীকৃতি না দিতে আরব বিশ্ব ও অন্যান্য মার্কিন মিত্র দেশগুলোর আহ্বান ট্রাম্প উপেক্ষা করায় মিত্রদের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কের ভাঙ্গন ধরতে পারে। ইসরায়েলকে কাছে টানতে ও মধ্যপ্রাচ্যে যুদ্ধ জিইয়ে রাখতে তার এই ঘোষণার পেছনে মার্কিন অস্ত্র ব্যবসা রমরমা করার গোপন উদ্দেশ্য থাকতে পারে। গত বুধবার আনুষ্ঠানিকভাবে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জেরুসালেমকে ইসরায়েলের রাজধানী হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছেন। ট্রাম্প দাবি করেছেন, তেল আবিব থেকে মার্কিন দূতাবাস সরিয়ে জেরুসালেমে নেয়া এবং রাজধানীর স্বীকৃতি দেয়ার ফলে ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সংঘাতের অবসান ঘটবে। বিশ্বজুড়ে মার্কিন মিত্র ও শত্রুরা বেপরোয়া এ সিদ্ধান্ত নেয়া থেকে বিরত থাকার আহ্বান জানালেও তাতে বুড়ো আঙুল দেখিয়েছেন ট্রাম্প। এ সিদ্ধান্তের ফলে মধ্যপ্রাচ্যের শান্তিপ্রক্রিয়া বিঘ্ন ও বিশৃঙ্খলা বৃদ্ধি পেতে পারে।
ইসরায়েল-ফিলিস্তিন যেকোনো ধরনের আলোচনার প্রধান ইস্যু হচ্ছে জেরুসালেম। দুই দেশই জেরুসালেমকে তাদের রাজধানী হিসেবে চায়। জাতিসংঘ পূর্ব জেরুসালেমকে ফিলিস্তিন অধিকৃত ভূখন্ড মনে করে কিন্তু সংস্থাটি মনে করে ইসরায়েল-ফিলিস্তিনের রাজধানী হিসেবে একদিন স্বীকৃতি পাবে জেরুসালেম। কিন্তু পবিত্র নগরী জেরুসালেম ১৯৬৭ সাল থেকে দখলে নিয়ে আছে তেল আবিব এবং তারা জেরুসালেমের ভাগাভাগি প্রত্যাখ্যান করে আসছে।
ট্রাম্পের সিদ্ধান্তের পেছনে সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্বার্থের বিষয়টি উড়িয়ে দিচ্ছেন না বিশ্লেষকরা। তারা বলছেন, মধ্যপ্রাচ্যের দীর্ঘমেয়াদি শান্তিপ্রক্রিয়া বাস্তবায়নের বিপক্ষে জেরুসালেমকে ইসরায়েলের রাজধানীর স্বীকৃতি দেয়ার পেছনে গভীর স্বার্থ রয়েছে।
বহু পুরস্কার জয়ী ব্রিটিশ সাংবাদিক মার্টিন জে রুশ সংবাদমাধ্যম আরটিকে বলেছেন, আমি মনে করি না, ট্রাম্প শান্তিতে আগ্রহী। আমার মনে হচ্ছে, তিনি ওই অঞ্চলে সঙ্কট বাড়াতেই বেশি আগ্রহী।
আঙ্কারার মিডল ইস্ট টেকনিক্যাল ইউনিভার্সিটির আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক হুসেইন বাগচি বলেন, ট্রাম্পের এই সিদ্ধান্ত মধ্যপ্রাচ্যের শান্তিচুক্তির জন্য অত্যন্ত কঠিন হয়ে দাঁড়াবে। কারণ এখন তুরস্কসহ বিশ্বের সব মুসলিম দেশেই ব্যাপক সামাজিক আন্দোলন শুরু হবে। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের কল্পনার চেয়েও মারাত্মক জটিলতা দেখা দেবে পুরো বিশ্বে। ফিলিস্তিন সংহতি প্রচারণার কামেল হ্যাওয়াশ বলেন, ‘ট্রাম্প যদি শান্তির ব্যাপারে আন্তরিক হন, তাহলে তিনি ইসরায়েলিদের পূর্ব জেরুসালেম ও অধিকৃত ফিলিস্তিনের অন্যান্য ভূখন্ড ত্যাগ করতে বলবেন এবং ফিলিস্তিনিদের সঙ্গে শান্তিচুক্তিতে পৌঁছানোর পথ পরিষ্কার করবেন।’
ট্রাম্পের এ সিদ্ধান্ত ফিলিস্তিনের ইতিহাসে ‘কালো বুধবার’ হিসেবে লেখা থাকবে; যেদিন ইসরায়েলের প্লেটে জেরুসালেমকে তুলে দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। দায়িত্বহীন ও অনৈতিক সিদ্ধান্তের কারণে আরো বেশি সহিংসতা দেখা দিতে পারে বলে সতর্ক করে দিয়েছেন হ্যাওয়াশ।
তিনি বলেন, ‘শান্তি প্রক্রিয়াকে আরো জটিল করে তুলবে এটি। এটি বেশ হাস্যকর যে ট্রাম্প ইসরায়েলের রাজধানী হিসেবে জেরুসালেমকে স্বীকৃতি দেয়ায় তা শান্তি প্রক্রিয়াকে সহায়তা করবে; কিন্তু এটি কীভাবে সহায়তা করবে সেব্যাপারে তিনি বলেননি।’
‘এটা যদি শান্তি প্রক্রিয়াকে সহায়তা করবে, তাহলে মার্কিন পররাষ্ট্র দফতর কেন দূতাবাসগুলোতে অতিরিক্ত নিরাপত্তার ব্যাপারে সতর্ক করলো? এটা যদি ভালো পদক্ষেপ হয়, তাহলে প্রত্যেকেই এতে সাধুবাদ জানাতো। কিন্তু সত্যিকার অর্থে বিশ্বের সব দেশই ট্রাম্পের এই সিদ্ধান্তের নিন্দা জানিয়েছে।’
মার্টিন জে’র ধারণা, নিজেদের স্বার্থে মার্কিন প্রেসিডেন্ট মিত্রদের থেকে মুখ ফিরিয়ে নিলেও ওই অঞ্চলের বড় বড় খেলোয়াড়দের সঙ্গে ওয়াশিংটনের সম্পর্কে এ সিদ্ধান্তের সরাসরি প্রভাব পড়বে।
‘বড় বড় আঞ্চলিক খেলোয়াড়; যারা শান্তি প্রক্রিয়া বাস্তবায়ন করতে পারেন শুধুমাত্র তাদের প্রতিই শ্রদ্ধাবোধের অভাব নয়; বরং দেশটির নীতি-নৈতিকতার প্রতিও একই ধরনের অভাব পরিলক্ষিত হয়েছে ট্রাম্পের সিদ্ধান্তে।’
বাগচি বলেন, ‘মার্কিন এই সিদ্ধান্তের জেরে যুক্তরাষ্ট্র-তুরস্ক সম্পর্ক গভীর সঙ্কটে পড়বে। আমার ধারণা, ডোনাল্ড ট্রাম্প এবং তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ানোর মধ্যে আর কোনোভাবেই ভালো সম্পর্ক রাখা সম্ভব হবে না।’
তবে অনেকেই বলছেন, ওই অঞ্চলে মার্কিন অস্ত্র ব্যবসা বাড়ানোর লক্ষ্যে ট্রাম্পে এই সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকতে পারেন। জে রুশ বলেন, ‘ট্রাম্প প্রতিনিয়ত সঙ্কট তৈরি করতে চান, আর এ সঙ্কট যত বড় হবে ততেই ভালো। কারণ সঙ্কটের সময় আমরা অস্ত্র ব্যবসা বাড়তে দেখেছি। এমনকি লকহিড মার্টিনের শেয়ারের দাম আকাশচুম্বী হয়েছিল। এটা আসলে ওই অঞ্চলে উত্তেজনা ও অস্ত্র বিক্রি বাড়ানোর কৌশল।’
বাগচি বলেন, ‘এই মুহূর্তে আমেরিকা এক ধরনের সুবিধাজনক অবস্থানে আছে। তারা পুরো মধ্যপ্রাচ্যের রাজধানী নিয়ন্ত্রণ করছে; তারা পুরো সামরিক অবকাঠামো নিয়ন্ত্রণ করছে। ট্রাম্প একজন ব্যবসায়ী, ঝুঁকি গ্রহীতা এবং আমি মনে করি বর্তমানে তিনি ঝুঁকি নিয়েছেন; তবে ব্যবসায়ীক ঝুঁকি নয়, এটা হচ্ছে রাজনৈতিক ঝুঁকি। আমার বিশ্বাস মধ্যপ্রাচ্য আবারো অস্থিতিশীল হবে।’
পর্যবেক্ষকরা বলছেন, আপাতদৃষ্টে মনে হচ্ছে ট্রাম্প ইসরায়েলি সুরে নাচছেন। ট্রাম্পের আশ-পাশে এখন যে উপদেষ্টারা আছেন তারা পুরোদমে ইসরায়েলপন্থী। তারা গাজা উপত্যকায় বসতি গড়তে সরাসরি অর্থায়ন করছে। সুতরাং আপনি আশা করতে পারেন না যে তারা মনে করবে, অধিকৃত জেরুসালেম ত্যাগ করার আহ্বান জানাবে ইসরায়েলিদের।
‘এটা কি শান্তি প্রক্রিয়ার জন্য কাজ করবে…? শান্তি প্রক্রিয়ায় আমেরিকার কোনো ভূমিকা নেই। কারণ তারা সৎ মধ্যস্থতাকারী নয়, ইসরায়েলি সরকারপন্থী, কট্টর ডানপন্থী ইসরায়েলি সরকারের শান্তি প্রক্রিয়ায় আগ্রহ নেই।’
তিনি বলেন, যুক্তরাষ্ট্র কখনো মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকা পালন করেনি অথবা সৎ মধ্যস্থতাকারী হয়নি। বর্তমানে এই বিষয়টাকে স্পষ্ট করে তুলেছে। ফিলিস্তিন পন্থী ওয়েবসাইট ইলেক্ট্রনিক ইন্তিফাদার প্রতিষ্ঠাতা আলি আবুনিমাহ এ বিষয়ে ঐক্যমত পোষণ করেন।
আবুনিমাহ বলেন, আমরা এখানে পৌঁছেছি কারণ, গত কয়েক দশক ধরে তথাকথিত আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় যুক্তরাষ্ট্রকে সৎ মধ্যস্থতাকারী হিসেবে ধরে নিয়ে তাদের দায়-দায়িত্ব এড়িয়ে গেছে। কিন্তু বর্তমানে এই মুখোশ উন্মোচন হয়েছে যা সবাই দেখতে পাচ্ছেন। মূলত ইসরায়েলের প্রধান দালাল, অস্ত্র সরবরাহকারী ও অর্থের যোগানদাতা হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র।
সুশীল সমাজকে পদক্ষেপ নেয়ার আহ্বান জানিয়ে আলি আবুনিমাহ বলেন, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় শুধু অশেষ উদ্বেগ জানাচ্ছে কিন্তু ফিলিস্তিনি ভূখ- দখলদারির জেরে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে সরাসরি ব্যবস্থা নিতে অস্বীকার করছে।
মানবাধিকার কর্মীরা বলছেন, ‘ভূয়া শান্তি প্রক্রিয়া ও দ্বিরাষ্ট্র সমাধানের ঢেঁকুর তুলে কেউ এর আড়ালে লুকিয়ে থাকতে পারেন না। আসলেই যদি তারা এই ব্যাপারে উদ্বিগ্ন হয়ে থাকেন, তাহলে ব্যবস্থা নেয়ার এটাই যথাযথ সময়, এটাই নিষেধাজ্ঞার উপযুক্ত সময়।’