ট্রাম্পের ভুলে আরবে বিপর্যয়
প্রত্যেকবারই মনে হয়, মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প নিজেকে অতিক্রম করে যেতে পারবেন না। কিন্তু তিনি সেটা আবার করছেন। এবার তিনি ঘোষণা করলেন, তার সরকার জেরুজালেমকে ইসরাইলের রাজধানী হিসেবে স্বীকৃতি দিচ্ছে। এর মধ্য দিয়ে তিনি ৭০ বছরের মার্কিন পররাষ্ট্রনীতি উল্টে দিলেন। ট্রাম্পের এ পদক্ষেপ ভবিষ্যতে অনেক নেতিবাচক ফল বয়ে আনবে। সেগুলো নিয়ে এখনই ভবিষ্যদ্বাণী করা অসম্ভব। জেরুজালেমের মর্যাদা নিয়ে ট্রাম্পের এ ভ্রান্তি আরববিশ্বের জন্য যেমন বিপর্যয়ের, তেমনিভাবে যুক্তরাষ্ট্রের জন্যও। ইসরাইল ও ফিলিস্তিনের মধ্যে মধ্যস্থতার ক্ষেত্রে যে ইস্যুগুলো রয়েছে, জেরুজালেম হচ্ছে তার মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ একটি ইস্যু। ইস্যুগুলো অত্যন্ত স্পর্শকাতর হওয়ায় এগুলো সব সময় এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে। ফিলিস্তিনের সঙ্গে যুক্ত সব আবেগগত ব্যাপার উড়িয়ে দিয়ে ট্রাম্প এ বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির মধ্যে শাবল চালিয়ে দিয়েছেন। ফিলিস্তিনের সামগ্রিক প্রশ্নে জেরুজালেম নিঃসন্দেহে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। ইসলাম ও খ্রিস্টান উভয় ধর্মের প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে এটা ফিলিস্তিনি মুসলিম ও খ্রিস্টানদের পরিচয়ের ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় একটি বিষয় হয়ে রয়েছে এবং ফিলিস্তিনকে ঘিরে সংঘাত যত ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে, সেই পরিচয়ের প্রশ্ন আরও বড় হয়ে দেখা দিয়েছে। পবিত্র এ শহরকে ঘিরে দ্বন্দ্ব ত্বরান্বিত হওয়ার পেছনে আসল যে ব্যাপার সেটা হচ্ছে, অভিন্ন একটি স্থান মুসলিমদের কাছে যেটা হারাম আল শরিফ, ইহুদিদের কাছে সেটেই টেম্পল মাউন্ট। উভয় সম্প্রদায়ের কাছেই এটি পবিত্র স্থান। বিস্ফোরণোন্মুখ প্রকৃতির কারণে এটা এমন একটা ইস্যুতে পরিণত হয়েছে, যেটাকে কোনো ফিলিস্তিনি রাজনীতিকই এবং কিছু আরব নেতা কখনোই হেলাফেলা করার সাহস দেখাননি। যাদের পরিবার শত শত বছর জেরুজালেমে বাস করে আসছে, তাদের কারও কারও জন্য ট্রাম্পের ঘোষণার অর্থ এটা না যে, জেরুজালেমে একমাত্র ইসরাইলের অধিকার, ট্রাম্প ইসরাইলের এ অবস্থান গ্রহণ করেছে। বরং তিনি এ ঘোষণার মধ্যে ১৯৬৭ সালের আরব-ইসরাইল যুদ্ধকালে ইসরাইলি সেনাবাহিনীর পূর্ব জেরুজালেমের জবরদখলকে বৈধতা দিলেন। এছাড়া এর মধ্য দিয়ে ট্রাম্প জেরুজালেমে বসবাসরত হাজার হাজার ফিলিস্তিনির ওপর ইসরাইলের বৈষম্যমূলক আইন চাপিয়ে দেয়াকেও বৈধতা দিলেন। এর মাধ্যমে যে ক্ষতি তিনি করলেন, তা স্থায়ী হয়ে থাকবে। যুক্তরাষ্ট্র এ স্বীকৃতি আর ফিরিয়ে নিতে পারবে না।
ট্রাম্পের এ কাণ্ডের কারণে এ অঞ্চলে দীর্ঘকাল ধরে মধ্যস্থতাকারী হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের যে ভূমিকা ছিল, তা সম্পূর্ণভাবে অক্ষম হয়ে গেল। এ অক্ষমতা বা অযোগ্যতা ওয়াশিংটন তার নিজের জন্য একচ্ছত্র করে তুলেছে। ইসরাইল-ফিলিস্তিন ‘শান্তি প্রক্রিয়া’ নিয়ে ট্রাম্পের জামাতা হোয়াইট হাউসের জ্যেষ্ঠ উপদেষ্টা এতদিন কূটনৈতিক প্রচেষ্টা চালাচ্ছিলেন এবং ফিলিস্তিনের ওপর চাপানোর আশা করছিলেন সেক্ষেত্রেও চরম অযোগ্যতা প্রকাশ পেয়েছে। ট্রাম্পের এ কাণ্ডে আরববিশ্বের মতামতের প্রতি তার এক বিশেষ ঘৃণার ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে। আরব দেশগুলোর স্বৈরশাসকদের বেশিরভাগই নিরাপত্তার জন্য মার্কিনিদের ওপর নির্ভর করে থাকে। এসব স্বৈরশাসকরা উচ্চৈঃস্বরে কিছু বলতে না পারলেও আরব জনগণ জেরুজালেম প্রশ্নে ফিলিস্তিনি অবস্থানের সমর্থনে একেবারেই সর্বসম্মত। যুক্তরাষ্ট্রের এ পদক্ষেপের প্রতি তাদের অনিবার্য প্রতিক্রিয়া মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে গুরুত্বপূর্ণ মার্কিন স্বার্থকে নিশ্চিতভাবেই আঘাত করবে। মার্কিন প্রতিরক্ষামন্ত্রী হিসেবে জেমস ম্যাটিস ২০১৩ সালে যেমনটা বলেন, ‘মার্কিন সেনাবাহিনীর কেন্দ্রীয় কমান্ডের একজন কমান্ডার হিসেবে প্রতিদিনই আমাকে সামরিক নিরাপত্তার মূল্য দিতে হয়েছে। কারণ ইসরাইলের প্রতি মার্কিন সমর্থনকে পক্ষপাতমূলক হিসেবে দেখা হয়ে থাকে।’ সাম্প্রতিক এ কূটনৈতিক ব্যর্থতা মার্কিন প্রশাসনের আরেকটা দৃষ্টান্ত, যেটা অবশিষ্ট বিশ্বের মতামতকে সম্পূর্ণভাবে অবমাননার প্রমাণ বহন করছে। যুক্তরাষ্ট্রের আগে কোনো দেশই জেরুজালেমকে ইসরাইলের রাজধানী হিসেবে স্বীকৃতি দেয়নি। বিশ্ব মনে করে, যতক্ষণ পর্যন্ত একটা মীমাংসায় না যাওয়া যাচ্ছে, মধ্যস্থতার ফল নির্ধারণ করা বা আগেই বিচার করা অবৈধ।
-দ্য গার্ডিয়ানে কলম্বিয়া ইউনিভার্সিটির আরব অধ্যায়নের অধ্যাপক রশীদ খালিদির লেখা নিবন্ধ