আধুনিকতা ও বহুবিবাহ পর্যালোচনা
জামাল আস-সাবেত: মানব জাতির এমন কোনো সমস্যা নেই, যে সমস্যার সুষ্ঠু সমাধান পবিত্র কোরআনে বর্ণিত হয়নি। আর সে সবের একটি হচ্ছে বহুবিবাহ। ইসলামে বহুবিবাহ বলতে, পুরুষকে একের অধিক স্ত্রী গ্রহণে অনুমোদন করে, কিন্তু স্ত্রীর ক্ষেত্রে একাধিক স্বামী গ্রহণে সম্পূর্ণ নিষেধ করেছে। দুর্ভাগ্যের বিষয় হচ্ছে, পশ্চিমা সভ্যতা, সেক্যুলারপন্থী এবং তথাকথিত নারীবাদীদের কাছে এটি গা-জ্বালার মতো। তাদের দাবি, বহুবিবাহের মাধ্যমে ইসলাম নারীদের অধিকার ক্ষুণœ করেছে। কিন্তু এ দাবি যে নিতান্তই অজ্ঞতা এবং সভ্য-সমাজের বিপরীত তা তাদের দৃষ্টিতে আসে না। পবিত্র কোরআনের সূরা নিসার ৩ নং আয়াতে বলা হয়েছে, ‘আর যদি তোমরা এতিমদের সঙ্গে বেইনসাফি করতে ভয় কর, তা হলে যেসব মেয়েদের তোমরা পছন্দ কর তাদের মধ্য থেকে বিয়ে কর দুই, তিন অথবা চারজন।’ তবে শর্ত হচ্ছে, তাদের মাঝে অবশ্যই সুবিচার বজায় রাখতে হবে। আল্লাহ বলেন, যদি তোমরা আশঙ্কা কর যে, সুবিচার করতে পারবে না, তা হলে মাত্র একজনকেই বিয়ে কর। (৪:০৩)।
এ আয়াতের প্রেক্ষাপট ছিল ওহুদ যুদ্ধের পরবর্তী সমস্যার সমাধান, এবং জাহেলিয়া যুগে যেসব নারীর অধিকার ক্ষুন্ন করা হতো সেসব নারীর অধিকার ফিরিয়ে দেয়ার একটি সুন্দর পথ।
ওহুদ যুদ্ধে অনেক সাহাবি শহীদ হওয়ার কারণে তাদের স্ত্রীরা বিধবা ও সন্তানসন্ততি এতিম হয়ে পড়ে। এসব বিধবাদের ব্যবস্থাপনা ও তাদের সন্তানদের ভরণপোষণের ব্যবস্থা করতেই আল্লাহতায়ালা এ আয়াত নাজিল করেছিলেন। অর্থাৎ সমাজের প্রয়োজন সাপেক্ষেই আয়াত নাজিল করে তার সুষ্ঠু সমাধান দেয়া হয়েছে। ইসলাম-পূর্বযুগে সে সমাজের পুরুষরা বহু বিধবা নারীকে বিবাহ এবং এতিমদের অভিভাবকত্ব গ্রহণ করত তাদের সম্পদের নিরঙ্কুশ মালিক হওয়ার লক্ষ্যে। আর এ জন্য সে ব্যক্তি দশ-বারোজন এতিম মেয়ে কিংবা বিধবা নারীকে বিয়ে করত। কিন্তু তাদের প্রতি বিন্দু পরিমাণ সুবিচার করত না, মোহর দিত না, এমনকি তাদের সব সম্পদ কুক্ষিগত করে নিত। এ অবিবেচক ব্যবস্থাপনা ও অবিচারকারীদের সায়েস্তা করার জন্যই আল্লাহতায়ালা সেসব বিবাহ বন্ধ করে সে স্থানে সুবিচারের শর্ত সাপেক্ষে বিবাহের নির্দিষ্ট নিয়ম করে দেন। সুবিচার করতে না পারলে একটি বিয়েতেই সন্তুষ্ট থাকতে বলে দেন। কিন্তু সেটি ছিল তৎকালীন সময়ের প্রেক্ষাপটে আয়াত। তা হলে বর্তমান সময়ে এ আয়াতের চাহিদা কী?
আমি বলতে চাই বর্তমান সময়ে এ আয়াতের চাহিদা আরও বেশি। যেমন-
১. দেশে এখন পুরুষের চেয়ে নারীর সংখ্যা বেশি। ২. বিধবা ও এতিম মেয়েদের অভিভাবকত্ব গ্রহণের প্রয়োজন। ৩. অসহায়, দরিদ্র, দুস্থ নারীদের দেখভালের জন্য। ৪. স্ত্রী দুরারোগ্যে আক্রান্ত হলে। ৫. স্ত্রীর বন্ধ্যত্বের কারণে সন্তান না হলে। ৬. স্বামীর যৌন কামনা অধিক হলে এবং স্ত্রী তা মেটাতে অক্ষম হলে।
আজকের পৃথিবীতে যুদ্ধ যেন একটি নিত্যনৈমিত্তিক কাজ হয়ে দাঁড়িয়েছে। যার ফলে, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে লিঙ্গ অনুপাত ব্যাহত হচ্ছে। শুধু তাই নয়, জন্মনিয়ন্ত্রণ প্রক্রিয়া গ্রহণ, সন্তান জন্মদান এবং লালন-পালনে নারীদের অনীহা প্রকাশ, সমকামিতা ইত্যাদি কারণেও আমেরিকা, ব্রিটেন, জার্মান, রাশিয়াসহ বিভিন্ন দেশে জনসংখ্যা ভারসাম্যহীন হয়ে নারীর সংখ্যা বেড়ে গিয়ে পুরুষের সংখ্যা কমে যাচ্ছে। এ ছাড়া মধ্যপ্রাচ্যের যুদ্ধ-বিধ্বস্ত দেশগুলোয়ও একই চিত্র বিরাজ করছে। যেমন, সিরিয়া ও ফিলিস্তিনে নারীদের তুলনায় পুরুষের সংখ্যা নগণ্য। শুধু সিরিয়ার দিকে তাকালেই জনসংখ্যা ব্যাহত হওয়ার অনুপাত চোখে পড়বে। সেখানে শুধু বিবাহযোগ্য নারীদের সংখ্যা ৭০ শতাংশ, যাদের বিবাহ করার মতো কোনো বিবাহযোগ্য পুরুষ নেই। এমনকি যেসব নারী বিধবা হয়েছেন তারাও বিবাহযোগ্য পুরুষের অভাবে দ্বিতীয় বিবাহ করতে পারছেন না। এ ছাড়া রোড এক্সিডেন্ট, নির্বাসিত জীবনযাপন, কারাগারে বন্দি, ইত্যাদি নারীদের তুলনায় পুরুষদের ক্ষেত্রেই বেশি হয়ে থাকে। যার ফলে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে সমানুপাতিক জনসংখ্যা না হয়ে বরং নারীর তুলনায় পুরুষের সংখ্যা ধীরে ধীরে কমে যাচ্ছে।
হাদিস শরিফে উল্লেখ রয়েছে, কেয়ামতের আগে, ‘পুরুষের সংখ্যা কমে যাবে এবং নারীর সংখ্যা বেড়ে যাবে।’ বুখারি শরিফ (বিবাহ অধ্যায়)।
তাই সময়ের ও সমাজের দাবি অনুযায়ী, এসব নারীকে তাদের অধিকার ফিরিয়ে দিতে বহুবিবাহের বিকল্প কিছু কল্পনা করা যায় না। এসব দেশে সমকামিতা দূর করতে, দেহব্যবসা থেকে রক্ষা করতে, মানুষ হিসেবে মর্যাদা নিয়ে বেঁচে থাকতে এবং মানব বংশধারা ঠিক রাখতেও বহুবিবাহের বিকল্প অন্য কিছু ভাবা যায় না।
অনেক সময় দেখা যায় সমাজের অসহায় দুস্থ এতিম নিরীহ দরিদ্র এবং কালো রঙের মেয়েদের বিবাহ দিতে সমস্যা হয়। যৌতুকের জন্য ছেলেপক্ষ রাজি হয় না। এ অবস্থায় কোনো বিবাহিত পুরুষ যদি তাকে বিবাহ করে বধূর মর্যাদা দেয় তবে সে নারীর সম্মান বজায় হল নাকি সম্মানহানি হল?
আমরা যদি সমাজের দিকে একটু চোখ বুলিয়ে নিই তা হলে দেখতে পাব এ অসহায় মেয়েদের অসহায়ত্বকে কাজে লাগিয়ে কিছু অসাধু ব্যক্তি তাদের পতিতাবৃত্তির জন্য উৎসাহিত করছে অথবা বাধ্য করছে। শুধু তাই নয়, গ্রাম-গঞ্জে অসহায় মেয়েদের অভিভাবকত্ব গ্রহণের নাম করে অনেক নেতা নামধারী ব্যক্তি সেসব মেয়েকে সারা জীবন ভোগ করে চলছে। তাই, বিধবা, অসহায় ইত্যাদি মেয়েদের যদি ব্যভিচারে লিপ্ত হওয়া থেকে অথবা তাদের সম্ভ্রম রক্ষা করতে বহুবিবাহের প্রচলন করা হয় তা হলে তাদের স্ত্রীর মর্যাদা দান এবং সম্মানজনক জীবন দান অমূলক বা নারী অধিকার হরণ নয় বরং তাদের সম্মানজনক বেঁচে থাকার মর্যাদা দান করা হয়।
তা ছাড়া যেসব স্ত্রী বন্ধ্যত্বের কারণে সন্তান জন্ম দিতে অক্ষম অথবা যেসব স্ত্রী তার স্বামীকে যৌন মিলনে পূর্ণ সুখ দিতে অক্ষম সেসব পুরুষ ইচ্ছা করলে প্রয়োজন পূরণের জন্য আবার বিয়ে করতে পারেন। তবে এ জন্য আগের স্ত্রীকে তালাক দেয়ার প্রয়োজন নেই। একটি কথা মনে রাখা দরকার, ইসলামে বহুবিবাহ ফরজ বা আবশ্যকীয় কোনো বিষয় হিসেবে গণ্য করছে না, বরং এটি হচ্ছে প্রয়োজন সাপেক্ষীয় বিষয়। যদি প্রয়োজন পড়ে এবং সুবিচার করতে সমর্থ হয় তবেই কোনো ব্যক্তির জন্য এই বিবাহ সমর্থনযোগ্য। বিশেষ করে মুসলিম নারীবাদীদের বলছি, যারা নারীদের অধিকার রক্ষণে সচেষ্ট তাদের উচিত হবে সৃষ্টিকর্তার এই আইনটিকে মেনে নেয়া। পশ্চিমা ধ্যানধারণা থেকে বেরিয়ে আসা। এবং সমাজকে ব্যভিচারমুক্ত রাখার জন্য বহুবিবাহকে সমর্থন করা।
লেখক : শিক্ষার্থী, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ