ফিলিস্তিন সংকটে মুসলমানদের করণীয়
তাকি উসমানি: বায়তুল মোকাদ্দাস বা মসজিদুল আকসা মুসলমানদের প্রথম কেবলা। এখন আর তা মুসলমানদের হাতে নেই। যে মসজিদে দিনে পাঁচবার আজানের আওয়াজে গুঞ্জরিত হতো, দীর্ঘ আট শ বছর পর সেখানে আজান বন্ধ হয়ে গেছে। মসজিদুল আকসা আজ অভিশপ্ত ইহুদিদের নিয়ন্ত্রণে।
কমপক্ষে এক লাখ নবী-রাসুলের স্মৃতিবিজড়িত ফিলিস্তিন আজ ইহুদিদের শিকারে পরিণত হয়েছে। এরা এমন জাতি, এদের অভিধানে নিরাপত্তা, নৈতিকতা, ভদ্রতার কোনো নাম-গন্ধ নেই। ‘সিনাই’ উপত্যকাকে একসময় ইহুদিদের জন্য ‘ময়দানে তীহ’ বানানো হয়েছিল।
আল্লাহর আজাবে একসময় হতবিহ্বল হয়ে ওই ময়দানে তারা ঘুরপাক খেত। সেখানে আজ ইসরাইলি সারি সারি ট্যাংক সগৌরবে ছুটে চলছে। তুর পাহাড় আল্লাহর নুরের তাজাল্লি লাভে ধন্য। এর আস্তিনে ইহুদিদের ওপর আল্লাহর আজাব লুক্কায়িত ছিল।
আজ সেই তুর পাহাড়ের আকাশে ইহুদি-নক্ষত্রের দীপ্তি ছড়িয়ে যাচ্ছে। সিরিয়া ও বায়তুল মোকাদ্দাসের ওই ভূখণ্ডকে পবিত্র কোরআনে পুণ্যময় ও বরকতময় ভূমি বলে অভিহিত করা হয়েছে। সেই পবিত্র ভূমিতে ঈমানদারদের রক্ত প্রবাহিত হচ্ছে। তাদের বর্বরতা আজ অতীতের সব রেকর্ড অতিক্রম করেছে। মুসলমানদের রক্ত নিয়ে আজ তারা হোলিখেলায় মত্ত।
ফিলিস্তিনের মুসলমানদের ঘরবাড়ি ছিনিয়ে নিচ্ছে জালিম ইহুদিগোষ্ঠী। মুসলিম মা-বোনদের সম্ভ্রম লুটে নিচ্ছে তারা। মানবতা সেখানে প্রশ্নবিদ্ধ। মানবাধিকার সেখানে ভূলুণ্ঠিত। নিঃসন্দেহে এটি মুসলিম বিশ্বের জন্য বড় ট্র্যাজেডি। ইসরায়েলিদের এমন জুলুমে প্রতিনিয়ত মুসলমানের অন্তরে রক্তক্ষরণ হচ্ছে।
শব্দের পরিবর্তনের দ্বারা বাস্তবতার পরিবর্তন হয় না। আমাদের খোলাখুলিভাবে স্বীকার করা উচিত, এটা আমাদের মুসলিম জাতিসত্তার বড় পরাজয়। এটা এমন পরাজয়, যার দৃষ্টান্ত ইসলামের ইতিহাসে খুঁজে পাওয়া যায় না।
আরব দেশগুলোর অপার শক্তি ও সম্ভাবনা আজ কোনো কাজে লাগছে না। মাত্র আট হাজার বর্গমাইলের একটি ছোট্ট ‘রাষ্ট্র’ ২৪ হাজার বর্গমাইলের রাষ্ট্রকে দখল করে নিয়েছে। দীর্ঘ আট শ বছর পর বায়তুল মোকাদ্দাস থেকে মুসলমানদের বিতাড়িত হওয়ার বেদনা সহজে ভোলার মতো নয়। এটা এমন আঘাত, যার ব্যথা তত দিন উপশম হবে না, যত দিন আরেকজন সালাউদ্দিন আইয়ুবির জন্ম না হবে।
এ পৃথিবীতে কোনো ঘটনাই কোনো কারণ ছাড়া ঘটে না। প্রতিটি ঘটনার পেছনে বাহ্যিক কিছু কারণ ও ক্রিয়ার ধারাক্রম থাকে। পৃথিবীর প্রতিটি ঘটনা শিক্ষা ও উপদেশের বিশাল বহর নিয়ে আসে। জীবন সফরের বন্ধুর পথে ওই জাতিই উন্নতির ধাপগুলো অতিক্রম করতে পারে, যারা প্রতিবন্ধকতার স্থানগুলো চিহ্নিত করে তা অতিক্রম করার কৌশল খোঁজে।
তাই বিপর্যয়ে শুধু হা-হুতাশ করাই আমাদের দায়িত্ব নয়; বরং ইতিহাসের এই করুণ ট্র্যাজেডি আমাদের সতত ভাবিত করে। আমাদের এ ঘটনার চুলচেরা বিশ্লেষণ করতে হবে। ফিলিস্তিন ট্র্যাজেডি নিঃসন্দেহে মুসলমানদের জীবনের একটি করুণ অধ্যায়।
তবে আমরা যদি এ ঘটনা থেকে শিক্ষা নিতে পারি, তাহলে হয়তো আমাদের এ বিপর্যয় বিজয়ে রূপান্তরিত হবে। অশ্রু বিসর্জন দিয়ে হাল ছেড়ে দিলে চলবে না। চৈতন্য জাগ্রত করার এটাই সুবর্ণ সুযোগ। এখনো সময় আছে নিজেদের ত্রুটি-বিচ্যুতি পর্যালোচনা করার।
সহমর্মিতা ও সমবেদনার দাবি হচ্ছে, এই দুর্যোগময় মুহূর্তে আরব ভাইদের এই বিচ্যুতি নিয়ে খোলামেলা আলোচনা না করা। এমন কোনো ভুল ধরিয়ে না দেওয়া, যাতে ঘটনার দায়ভার পুরোটাই তাদের কাঁধে চেপে বসে। কিন্তু আমাদের কাছে এর চেয়ে কল্যাণময় কোনো পদ্ধতি নেই, যার আলোকে আরবীয় ভাইদের সতর্ক করা যাবে। তাই সামনের বক্তব্যের জন্য আমি আমার আরবীয় ভাইদের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করছি।
কোরআন-সুন্নাহ ও বিভিন্ন জাতির উত্থান-পতনের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, কোনো জাতির পার্থিব উন্নতি শুধু এ জন্যই হয় না যে তারা আসমান থেকেই সৌভাগ্যের অধিকার নিয়ে দুনিয়ায় এসেছে।
পৃথিবীর সূচনা থেকে আল্লাহর রীতি হলো, দুনিয়ায় চেষ্টা-সাধনার ভিত্তিতেই প্রত্যেকের চাওয়া-পাওয়া পূরণ করা হয়। মুসলমানরাও আল্লাহর এ অমোঘ নীতির ঊর্ধ্বে নয়। নিঃসন্দেহে তাদের ‘শ্রেষ্ঠ জাতির’ মর্যাদায় ভূষিত করা হয়েছে।
সন্দেহ নেই যে মুসলিম জাতি আল্লাহর সবচেয়ে প্রিয়। এটাও সর্বজন স্বীকৃত, দুনিয়ার বুকে কোনো ধর্ম মুসলমানদের ধর্মের সমকক্ষ নেই।
কিন্তু এসব দিয়ে কখনো এই ফল বের হয় না যে কোনো জাতি শুধু মৌখিকভাবে নিজেদের মুসলমান হওয়ার দাবি করে হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকলেই আকাশ স্পর্শ করতে পারবে, হাতের ওপর হাত রেখে বসে থাকলে সাফল্য তাদের পদ চুম্বন করবে।
কোরআন ও ইসলামের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, মুসলমানদের মাথা উঁচু করে দাঁড়ানোর জন্য দুটি শর্ত আছে—এক. সঠিক অর্থে মুসলমান হয়ে জীবনের প্রতিটি স্তরে নিজেকে ইসলামের অনুসারী বানিয়ে নেওয়া। দুই. উন্নতির বাহ্যিক উপকরণ ও উপাদান সংগ্রহ করা।
এ দুটি জিনিসের মধ্যে আমাদের উন্নতি ও সাফল্যের রহস্য লুক্কায়িত। এ বিষয়ে কোরআনের বক্তব্য দেখুন—একদিকে বলা হয়েছে, ‘তোমরাই বিজয়ী হবে, যদি তোমরা মুমিন হও।’ অন্যদিকে বলা হয়েছে, ‘আর তোমরা দুশমনের মোকাবেলায় সামর্থ্য অনুযায়ী শক্তি ও ঘোড়ার ছাউনি তৈরি করো, যার মাধ্যমে তোমরা আল্লাহর দুশমন ও তোমাদের দুশমনদের ভয় দেখাবে।’ (সুরা : আনফাল, আয়াত : ৬০)
ইসলামের ইতিহাসে যে বিপ্লবের দিকেই আপনি নজর দেবেন, কোরআনের এ ঘোষণার সত্যতা স্পষ্ট হয়ে যাবে। যেখানে মুসলমানরা সাচ্চা ঈমানদান হয়ে বাহ্যিক উপকরণ ও উপাদান জমা করে সাধ্যমতো সাধনা করেছে, সেখানেই তারা বিজয়ের মালা ছিনিয়ে এনেছে, যদিও তাদের জনবল ও অস্ত্র ছিল তাদের তুলনায় অপ্রতুল ও সীমিত। পরাজয়ের গ্লানি মুসলমানদের ওই সময় বহন করতে হয়েছে, যখন তারা উল্লিখিত দুটি নির্দেশনা থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে।
-কালের কণ্ঠ, ভাষান্তর : আরিফুর রহমান