ছাত্রীদের বোরকা পড়া নিয়ে শিক্ষকের কটুক্তির জের : উত্তর বিশ্বনাথ উচ্চ বিদ্যালয়ে দু’পক্ষে ধাওয়া পাল্টা ধাওয়া
বিশ্বনাথ (সিলেট) থেকে এমদাদুর রহমান মিলাদ: বিশ্বনাথে বিদ্যালয়ের ছাত্রীদের বোরকা পড়া নিয়ে কটুক্তির জের ধরে দু’পক্ষের মধ্যে ধাওয়া পাল্টা ধাওয়া ও ককটেল বিস্ফোরণ ও বিদ্যালয়ের ডেস্ক-বেঞ্চ ভাংচুরের ঘটনা ঘটেছে। গতকাল বৃহষ্পতিবার বিকেল ৩টায় উপজেলার উত্তর বিশ্বনাথ উচ্চ বিদ্যালয়ে এ ঘটনাটি ঘটেছে। এ সময় অন্তত ১৫ জন আহত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। এ সময় বিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টি হয়। আতংকে তারা দিগ্বিদিক ছুটাছুটি করেন। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে সেখানে থানা পুলিশের পাশাপাশি অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে। সেই সাথে আগামী ১৩ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বিদ্যালয় বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। এদিকে, বোরকা পড়া ও মসজিদ নিয়ে কটুক্তির অভিযোগে অভিযুক্ত উত্তর বিশ্বনাথ উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক প্রভাংশু শেখরের অপসারণ দাবি করেছেন বিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীরা ও এলাকাবাসী। এ ঘটনায় এলাকায় উত্তেজনা বিরাজ করছে।
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, গত ২৯ আগষ্ট বৃহস্পতিবার শ্রেনী কক্ষে ৯ম শ্রেনীর ছাত্রীদের বোরকা পরা নিয়ে কটুক্তি করেন স্কুলের শিক্ষক প্রভাংশু শেখর তালুকদার। এ বিষয়টি এলাকায় জানাজানি হলে অভিভাবকদের মধ্যে চরম ক্ষোভ ও উত্তেজনা দেখা দেয়। বিষয়টি কৌশলে সামাল দিতে শিক্ষক প্রভাংশু শেখরের পত্নী একই স্কুলের শিক্ষিকা মনিসা রানী দাস গত মঙ্গলবার দুপুরে ৯ম শ্রেনীর ছাত্রীদের অফিসে নিয়ে ওই ঘটনাটি মিথ্যা বলে স্বাক্ষর নেন। ছাত্রীদের স্বাক্ষর নেওয়ায় গত মঙ্গলবার নতুন করে স্কুলে উত্তেজনা দেখা দেয় এবং ৯ম ও ১০ম শ্রেনীর শিক্ষার্থীরা ক্লাস বর্জন করে বিক্ষোভ মিছিল করে। স্কুলে হট্টগোলের সংবাদ পেয়ে পরিচালনা পরিষদের কয়েকজন সদস্যসহ অভিভাবকরা গিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রনে রাখতে বুধবার স্কুল বন্ধ ঘোষণা করেন এবং বৃহস্পতিবার দুপুর ১টায় (গতকাল) স্কুলে বৈঠকের সিদ্ধান্ত নেন। ঐ সিদ্ধান্ত অনুযায়ী গতকাল ম্যানেজিং কমিটির বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকের শেষ পর্যায়ে হাজী মফিজ আলী বালিকা বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকা নেহারুন নেছা উপস্থিত এলাকাবাসীর উদ্দেশ্যে বক্তব্য শুরু করেন। তাঁর বক্তব্য শেষ হতে না হতেই ছাত্রলীগ ও যুবলীগের কয়েকজন হট্টগোল সৃষ্টি করে বিদ্যালয় থেকে বেরিয়ে যায়। এক পর্যায়ে অভিযুক্ত শিক্ষকের পক্ষে অবস্থানকারী উপজেলা ছাত্রলীগের যুগ্ম আহবায়ক মুহিবুর রহমান সুইট গংরা ও বিপক্ষে অবস্থানকারী উপজেলা ছাত্রদলের যুগ্ম আহবায়ক গিয়াস উদ্দিন গংদের মধ্যে ধাওয়া পাল্টা ধাওয়া শুরু হয়। এ সময় ৭টি ককটেল বিস্ফোরণ ও বিদ্যালয়ের ডেস্ক-বেঞ্চ ভাংচুর করা হয়। ধাওয়া পাল্টা ধাওয়ায় গিয়াসসহ অন্তত ১৫ জন আহত হন।
আহতরা হলেন- অভিভাবক তুরণ মিয়া, বাবুল আহমদ, আলা উদ্দিন, স্কুল ছাত্র নিজাম উদ্দিন, ফয়সল মিয়া, আলামিন, শিপন আহমদ, উজ্জল আহমদ, হাফিজুর রহমান, ইসলাম উদ্দিন, মাহিদ, রায়হান ও জাহেদ আহমদ। গুরুতর আহত গিয়াস উদ্দিনকে সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে বিপুল সংখ্যক পুলিশ মোতায়েন করা হলে পরিস্থিতি শান্ত হয়। এর পর বিক্ষুব্ধ ছাত্ররা অভিযুক্ত শিক্ষকের অপসারণ দাবি করে মিছিল দিয়ে বিদ্যালয় ত্যাগ করে। এদিকে, এক পক্ষ অন্য পক্ষকে ঘায়েল করতে পরস্পর বিরোধী বক্তব্য পাওয়া গেছে। ছাত্রদল নেতা গিয়াস উদ্দিন পক্ষের দাবি ছাত্রলীগ ও যুবলীগ ক্যাডাররা বহিরাগতদের নিয়ে তাদের উপর হামলা করেছে এবং ৭টি ককটেল বিষ্ফোরণ, স্কুলের ডেস্ক-বেঞ্চ ভাংচুর ও তাদের লক্ষ্য করে গুলি বর্ষণ করেছে। তবে এ অভিযোগ মিথ্যা দাবি করে ছাত্রলীগ নেতা মুহিব পক্ষের দাবি প্রতিপক্ষ তাদের উপর হামলা করেছে। তাই তারা প্রতিহত করেছেন। এ ব্যাপারে ছাত্রদল নেতা গিয়াস উদ্দিন বলেন, প্রভাংশু শেখর বোরকা ও মসজিদ নিয়ে কটুক্তি করার কারণে এলাকাবাসীর সাথে আমি তার (প্রভাংশু শেখর) বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে আসছি।
গতকাল বৃহস্পতিবার ম্যানেজিং কমিটির বৈঠক চলাকালে ছাত্রলীগের মুহিবুর রহমান সুইট, যুবলীগের সাহান ও ফয়জুল সহ ছাত্রলীগ-যুবলীগের বহিরাগত সন্ত্রাসীরা আমাদের উপর হামলা চালায়। এ সময় তারা ককটেল বিস্ফোরণ করে ও বিদ্যালয়ের ড্রেস্ক-বেঞ্চ ভাংচুর করে। এ সময় আমিসহ অনেকেই আহত হই।
ছাত্রলীগ নেতা মুহিবুর রহমান সুইট বলেন, কটুক্তির বিষয়টি বিএনপি, যুবদল ও ছাত্রদলের লোকদের সাঁজানো নাটক। তাই তারা বিশৃংখলা সৃষ্টি করে নিজেদের ফায়দা হাসিল করতে চায়। গতকাল বৃহস্পতিবার বিদ্যালয়ে বৈঠক চলাকালে তারা আমাদের উপর হামলা চালায়। আমরা তাদের প্রতিহত করি। আমাদের বিরুদ্ধে আনিত অভিযোগ মিথ্যা। বিক্ষোভকারী ১০ম শ্রেনীর ছাত্র মিজান, ফয়সল আহমদ, উজ্জল আহমদ, ইমরান আহমদ, মোস্তাক আহমদ, তাজুল ইসলাম, নুরুল ইসলাম, রায়হান আহমদ, ৯ম শ্রেনীর ইকবাল আহমদ, জাবেদ আহমদ, আখলাকুর রহমানসহ শতাধিক ছাত্র ওই শিক্ষকের অপসারণ দাবি করে সাংবাদিকদের বলেন, দীর্ঘদিন ধরে ওই শিক্ষক দাঁড়িওয়ালা ছাত্র ও বোরকা পরা মেয়েদের নিয়ে নানা ভাবে কটুক্তি করে আসছেন। ওই শিক্ষকের হাতে স্কুলের অনেক শিক্ষকও একাধিকবার লাঞ্চিত হয়েছেন।
এলাকার অনেকেই অভিযোগ করে বলেন, যারা একসময় লামাকাজী রাগীব-রাবেয়া উচ্চ বিদ্যালয়কে শেষ করতে চেয়েছিল তারাই আবার ঐতিহ্যবাহী স্কুল ‘উত্তর বিশ্বনাথ উচ্চ বিদ্যালয়’কে শেষ করতে ষড়যন্ত্র শুরু করছে। বিদ্যালয় ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি এডভোকেট সাদ উদ্দিন বলেন, এলাকার জেনারেল কমিটির বৈঠক চলছে। এক পর্যায়ে দেখা গেছে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের বেশ কয়েক জন নেতা স্কুলে আসেন। এসময় আওয়ামীলীগের কয়েকজন বলেন, এখানে এসব কারা। তাদের সাথে কথা বলার এক পর্যায়ে শুরু হয় দু’পক্ষের মধ্যে ধাওয়া পাল্টা ধাওয়া। তিনি বলেন, বিদ্যালয় এক সপ্তাহ বন্ধ থাকবে। স্কুলের বিষয়টি শীঘ্রই বৈঠকে বসে সুরাহা করা হবে। ওসি আবুল কালাম আজাদ অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েনের সত্যতা স্বীকার করে বলেন বর্তমানে পরিস্থিতি শান্ত রয়েছে।
গতকাল বৃহস্পতিবার বেলা দেড়টায় ঘটনাটি মীমাংসা করার জন্য বিদ্যালয়ের ম্যানেজিং কমিটির অনুষ্ঠিত বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন হাজী মফিজ আলী বালিকা বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকা নেহারুন নেছা, রামসুন্দর অগ্রগামী উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আবদুল বারী, উত্তর বিশ্বনাথ উচ্চ বিদ্যালয়ের সাবেক প্রধান শিক্ষক আবদুল ওয়াহিদ খিজির, শিক্ষানুরাগী মিজানুর রহমান মিজান, এএইচ এম. ফিরোজ আলী, কবির আহমদ কুববার প্রমুখ।