কড়ি থেকে ই-মানি
জামাল উদ্দীন: দ্রব্য বিনিময়ের একটি টেকসই মাধ্যম প্রচলনের জন্য প্রাচীন কাল থেকেই মানুষ অর্থ ও মুদ্রা নিয়ে নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালিয়েছে। এর মধ্যে মূল্যবান ধাতুর ব্যবহার হাজার হাজার বছর ধরে টিকেছিল। আর কাগজের টাকা এবং ব্যাংক নোটও ব্যাপকভাবে ও দীর্ঘ সময় ধরে ব্যবহূত হচ্ছে। পশুর চামড়া, ধাতব পদার্থ থেকে শুরু করে বিটকয়েন পর্যন্ত দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে এসেছে মুদ্রা ব্যবস্থা। এখন অনেক দেশই ‘পেপারলেস ট্রেড’ এর দিকে ঝুঁকছে।
কাগজের মুদ্রার ব্যবহারকে অনেকেই অসম্পূর্ণ বলে থাকেন। কেননা, কোন দেশেই মুদ্রার মান দীর্ঘ সময় ধরে রাখা যায় না। মূল্যস্ফীতি আর আন্তর্জাতিক বাজারে নিজেদের অবস্থান টেকসই না হলে মুদ্রামানও ধরে রাখা যায় না। বিশ্ব এখন ভার্চুয়াল মুদ্রার দিকে এগুচ্ছে। তথ্য প্রযুক্তির বিকাশের ফলে কাগুজে মুদ্রা আর কতদিন প্রচলনের মাধ্যম হয়ে থাকবে সেটি নিয়ে এখনই ভাবার সময় এসেছে। বিট কয়েন আধুনিক কারেন্সি’র একটি আলোচিত বিষয়। পৃথিবীতে সবচেয়ে দামি কারেন্সি হচ্ছে এই বিট কয়েন। ভার্চুয়াল এই মুদ্রাটি অনলাইনে বিভিন্ন সেবা ক্রয়ে ইতোমধ্যে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে।
বিশ্বের অনেক দেশেই বিট কয়েন জনপ্রিয় হলেও বাংলাদেশে এখনও এর স্বীকৃতি মেলেনি। বর্তমানে বাংলাদেশে মুদ্রাবিহীন লেনদেনে ডেবিট বা ক্রেডিট কার্ডই ব্যবহার হচ্ছে, যাকে বলা হয় প্লাস্টিক মানি। প্লাস্টিক মানি ব্যবহারের নানাবিধ সুবিধা রয়েছে বলেই গ্রাহকরা এদিকে ঝুঁকছেন। নগদ টাকা পরিবহনে নানাবিধ ঝুঁকিও রয়েছে। এসব ঝুঁকি এড়াতে নগদ টাকার বহন কমিয়ে কার্ডের মাধ্যমে লেনদেনকারী বাড়াতে ব্যাংকগুলোকেও উদ্বুদ্ধ করছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
মুদ্রা প্রচলনের ইতিহাস অনেক পুরোনো। বিনিময়ের মাধ্যম কড়ির ব্যাপক ব্যবহার দেখা যায় প্রাগ—আধুনিক, প্রাচীন ও সনাতনী অর্থনৈতিক ব্যবস্থায়। বাংলা তথা এই ভারতীয় উপমহাদেশে মুদ্রা প্রচলনের ইতিহাসও বেশ প্রাচীন। ইতিহাসে দেখা যায় খ্রিষ্টপূর্ব পঞ্চম শতকে উত্তর ভারতে ধাতব মুদ্রার প্রচলন হয়েছিল। মুদ্রাগুলোর আকৃতি কখনও গোল, কখনও বর্গাকার আবার কখনও আয়তাকার। অর্থাত্ তাদের আকার এই পর্বে স্থিরিকৃত হয়নি। মুদ্রাগুলোর ওপরে কোনও শাসক বা রাজবংশের নাম ছিল না। সে সময় মুদ্রার একটি মাত্র দিকে বিভিন্ন প্রকারের নকশার ছাপ মারা ছিল। ফলে মুদ্রাগুলোকে ‘ছাপাঙ্কিত মুদ্রা’ বলা হতো। বিখ্যাত প্রত্নক্ষেত্র মহাস্থান থেকে আনুমানিক খ্রিষ্টপূর্ব তৃতীয় শতকের যে লেখটি আবিষ্কৃত হয়েছে, তাতে জানা যায়, বাংলার প্রাচীনতম নগর পুন্ড্রনগরে যা বর্তমানে মহাস্থানগড় সেখানে রাজকোষে ‘গন্ডক’ ও ‘কাকিনী’ রাখার জন্য প্রয়োজনীয় প্রশাসনিক নির্দেশনা দেওয়া হয়েছিল। অনেক পণ্ডিতের মতে ‘গন্ডক’ ও ‘কাকিনী’ দুই প্রকার মুদ্রার নাম, যা তত্কালীন উত্তরবঙ্গে ব্যবহূত হতো। সে সময় বাংলায় কড়ির প্রচলনও ছিল। তবে খ্রিষ্টপূর্ব তৃতীয়-দ্বিতীয় শতক থেকে বাংলায় ধাতব মুদ্রার উপস্থিতির প্রমাণ পাওয়া যায়। সে সময়কালের বহু রৌপ্য নির্মিত ‘অঙ্কচিহ্নিত’ মুদ্রা পাওয়া যায় বাংলাদেশের মহাস্থানগড়ে, দক্ষিণ দিনাজপুরের বাণগড়, পশ্চিমবঙ্গের মঙ্গলকোটসহ বিভিন্ন স্থানে। ঢাকার নিকটস্থ উয়ারি-বটেশ্বর থেকেও প্রচুর পরিমাণে রূপার অঙ্কচিহ্নিত মুদ্রা সম্প্রতি পাওয়া গেছে। তাতে স্পষ্ট হয় যে, খ্রিষ্টজন্মের ছয়শ বছরের আগেই বাংলায় মুদ্রার প্রচলন ছিল।
যদিও বলা হয়ে থাকে যে, খ্রিষ্টীয় ৭-১০ শতকে মৌর্যশাসন বাংলায় প্রসারিত হওয়ার ফলে আনুমানিক খ্রিষ্টপূর্ব তৃতীয় শতক নাগাদ উত্তরবঙ্গে ও পরে বাংলার অন্যান্য এলাকায় মুদ্রার প্রচলন দেখা যায়।
বাংলার প্রাচীনতম মুদ্রাগুলোতে অন্তত ১৭২ রকম নকশার ছাপ পাওয় যায়। তামা ও বিলনের মতো অপেক্ষাকৃত কমদামি ধাতুতে যে অঙ্কচিহ্নিত মুদ্রাগুলো তৈরি হলো, সেগুলো সম্ভবত দৈনন্দিন ছোটখাটো লেনদেনের পক্ষে উপযোগী ছিল। প্রাচীন মৌর্য বংশ (আনুমানিক খ্রিষ্টপূর্ব ৩২৪-১৮৬) থেকে শুরু করে মধ্যযুগের তুর্কী বিজয়ের খিলজী শাসন, খিলজী শাসন থেকে মোগল সম্রাট শাহ্ আলম পর্যন্ত এবং পরবর্তীকালে ব্রিটিশ-ভারত যুগ শেষে বর্তমান কালের ইতিহাসের সাক্ষী বিভিন্ন সময়ের ধাতব মুদ্রা। স্বাধীন সুলতানি শাসনের পর মোগল আমলেও বাংলাদেশে টাকশালের অস্তিত্ব ছিল। মোগল যুগের জাহাঙ্গীরনগর টাকশালের তৈরি মুদ্রার কথা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। যার পাশাপাশি কাগজের নোটের প্রচলন ছিল। তবে বর্তমানে আধুনিক ব্যাংক নোটের মতো উন্নতমানের ছিল না। মোগল আমলে ঢাকা, মুর্শিদাবাদ এবং পাটনায় টাকশাল প্রতিষ্ঠিত হয়। মোগল মুদ্রা ‘রূপী’ নামে অভিহিত হতো। সরকারিভাবে পুরানো ‘টঙ্কা’ নাম পরিত্যক্ত হলেও জনসাধারণ রূপীকে ‘টাকি’ বলতে থাকে। বর্তমান বাংলাদেশের মুদ্রার নামও টাকা।
ব্রিটিশ শাসনামলে ভারতীয় উপমহাদেশে তত্কালীন অবিভক্ত বাংলায় প্রথম ব্যাংক নোট চালু হয়। ১৮৬১ সালে কাগজের নোট প্রচলন করা হয়। সে সময় ১০, ২০, ৫০, ১০০, ৫০০, ১০০০ টাকার নোট বাজারে আসে। বিনিময় সুবিধার্থে ১৮৯১ সালে ৫ টাকার নোট প্রচলিত হয়। তবে ১৯১৭ সালের ৩০ নভেম্বর ভারতে সর্বপ্রথম এক টাকার নোট বাজারে আনে তদানিন্তন ব্রিটিশ সরকার। সেই সময় এক টাকার নোটে শোভা পেত ব্রিটেনের রাজা পঞ্চম জর্জের ছবি। এক টাকা ছাপার পেছনে রয়েছে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ভূমিকা। যুদ্ধের কারণে রূপার কয়েন চালাতে অসমর্থ হয়ে টাকার নোট চালু করে ব্রিটিশ সরকার।
বাংলাদেশ ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা লাভের পর কিছু সময় পাকিস্তানি ১, ৫ এবং ১০ রূপী ব্যবহূত হয় যা পরের দিকে সরকার বাতিল করে দেয়। পরবর্তী সময়ে ১৯৭২ সালের ৪ মার্চ প্রথম নোট চালু হয়। প্রথমে ১, ৫, ১০ এবং ১০০ টাকার নোট ছাপা হয়। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১ পয়সা, ৫, ১০, ২৫ ও ৫০ পয়সার মুদ্রা বাজারে ছাড়া হয়। পরে পর্যায়ক্রমে ১ টাকা, ২ টাকা ও ৫ টাকার ধাতব মুদ্রাও ছাড়া হয়। বর্তমানে ৫, ১০, ২৫ ও ৫০ পয়সার মুদ্রার দেখা মেলে না বললেই চলে।
নগদ টাকার ব্যবহার কমছে
দৈনন্দিন বিভিন্ন আর্থিক লেনদেনে কার্ডের ব্যবহারে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করছেন গ্রাহকরা। ব্যাংক থেকে টাকা তোলাসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রতিদিনই বাড়ছে কার্ডের ব্যবহার। এমনকি বিদেশেও এ দেশের মানুষ এখন কার্ড ব্যবহারের প্রতি ঝুঁকছেন। বেড়ানো কিংবা চিকিত্সা অথবা ব্যবসার প্রয়োজন যে কারণেই বিদেশ যাওয়া হোক না কেন, পকেটে করে বিদেশি মুদ্রা নিয়ে যাওয়ার চেয়ে কার্ডেই বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করছেন তারা। ইলেকট্রনিক লেনদেনের প্রযুক্তি সেবাদাতা প্রতিষ্ঠান ভিসা করা সম্প্রতি এক জরিপে উল্লেখ করা হয়েছে, লেনদেনে মানুষ ডিজিটাল ব্যবস্থায় আগ্রহী হচ্ছেন। ফলে নগদ লেনদেনের হার কমছে।