জেরুজালেমকে ফিলিস্তিনের রাজধানী ঘোষণা ওআইসি’র

oicপূর্ব জেরুজালেমকে স্বাধীন ফিলিস্তিনের রাজধানী হিসেবে ঘোষণা দিয়েছেন মুসলিম বিশ্বের নেতারা। তারা ফিলিস্তিনকে স্বাধীন রাষ্ট্র এবং পূর্ব জেরুজালেমকে তার রাজধানী হিসেবে স্বীকৃতি দেয়ার জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন।
বুধবার তুরস্কের বৃহত্তম নগরী ইস্তাম্বুলে ইসলামী সম্মেলন সংস্থার (ওআইসি) এক বিশেষ শীর্ষ সম্মেলনের চূড়ান্ত ঘোষণায় এ আহ্বান জানানো হয়।
জেরুজালেমকে ইহুদিবাদী ইসরাইলের রাজধানী হিসেবে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ঘোষণার প্রতিবাদে এবং এ সম্পর্কে করণীয় নির্ধারণে বিশেষ এই শীর্ষ সম্মেলনের ডাক দেয়া হয়।
ওআইসির বর্তমান চেয়ারম্যান ও তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তায়েপ এরদোগান এ সম্মেলন আহ্বান করেন। বাংলাদেশসহ ৫৭টি মুসলিম প্রধান দেশের সরকার ও রাষ্ট্রপ্রধান এবং প্রতিনিধিরা এক দিনের এ সম্মেলনে অংশ নেন।
সম্মেলন শেষে ইস্তাম্বুল ঘোষণায় বলা হয়, ‘ওআইসি পূর্ব জেরুজালেমকে ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের রাজধানী হিসেবে ঘোষণা করছে। সব রাষ্ট্রকে ফিলিস্তিনকে এবং পূর্ব জেরুজালেমকে তার অধিকৃত রাজধানী হিসেবে স্বীকৃতি দেয়ার আহ্বান জানাই।’
ঘোষণায় ট্রাম্পের সিদ্ধান্তকে বাতিল ও আইনগতভাবে অবৈধ বলে মন্তব্য করা হয় এবং বলা হয় ওই ঘোষণায় শান্তি প্রক্রিয়া ব্যাহত হবে এবং চরমপন্থা ও সন্ত্রাস মাথাচাড়া দেবে।
সভাপতির ভাষণে প্রেসিডেন্ট এরদোগান বলেন, ইসরাইল একটি সন্ত্রাসী রাষ্ট্র। তিনি বলেন, ইসরাইল দিন দিনই ফিলিস্তিনি ভূখণ্ড দখল করছে। এটা থামাতে হবে। তিনি বলেন, ইসরাইল দিন দিন যে আচরণ করছে তাকে অবশ্যই আমরা গ্রহণ করব না।
তিনি বলেন, যেসব দেশ আন্তর্জাতিক আইন ও ন্যায়বিচারকে মূল্যায়ন করে তাদের উচিত জেরুজালেমকে ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের রাজধানীর স্বীকৃতি দেয়া।
তিনি বলেন, মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বায়তুল মুকাদ্দাসকে ইহুদিবাদী ইসরাইলের রাজধানী হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে আমেরিকাসহ বিশ্ব মানবতাকে হুমকির মুখে ফেলেছেন।
ইসরাইলকে তিনি দখলদার ও সন্ত্রাসী রাষ্ট্র আখ্যা দিয়ে বলেন, তেল আবিবের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের জন্য প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প তাকে পুরস্কার দিয়েছেন। যেসব দেশ মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের সিদ্ধান্ত মানতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে তাদের প্রশংসা করে এরদোগান বলেন, “ট্রাম্পের এই বেআইনি সিদ্ধান্ত একমাত্র ইসরাইল ছাড়া কেউ সমর্থন করে নি।
যেসব দেশ মার্কিন সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে নি আমরা তাদেরকে ধন্যবাদ জানাই।” তিনি মার্কিন প্রেসিডেন্টকে এই বেআইনি, ভুল ও উসকানিমূলক সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করার আহ্বান জানান। ট্রাম্পের সিদ্ধান্তের পেছনে খ্রিস্টান ও ইহুদিবাদী মানসিকতা রয়েছে বলে কটাক্ষ করেন তিনি।
এরদোগানের আগে এক বক্তব্যে তুরস্কের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মেভলুত কাভুসোগ্লও ফিলিস্তিনকে সমর্থন জানান এবং ১৯৬৭ সালের যুদ্ধের আগের সীমানার নিরীখে পূর্ব জেরুজালেমকে ফিলিস্তিনের রাজধানী হিসাবে স্বীকৃতি দেওয়ার জন্য বিশ্বকে আহ্বান জানাতে মুসলিম দেশগুলোকে তাগাদা দেন।
১৯৬৭ সালে আরবদের সঙ্গে যুদ্ধে ইসরাইল পূর্ব জেরুজালেম দখল করে। পরে তারা আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন করে এটি ইসরায়েলি ভূখণ্ডের অংশ করে নেয়। এর আগে ১৯৪৮ সালের আরব-ইসরায়েলি যুদ্ধে ইসরাইল জেরুজালেমের পশ্চিমাংশ দখল করেছিল।
ফিলিস্তিন পূর্ব জেরুজালেমকে তাদের ভবিষ্যৎ রাষ্ট্রের রাজধানী হিসাবে দাবি করে আসছে। ইসরাইল পুরো জেরুজালেমকেই তাদের অবিভক্ত রাজধানী বলে মনে করে। কিন্তু জেরুজালেমে ইসরাইলের সার্বভৌমত্ব আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পায়নি।
বৈঠকে সৌদি বাদশাহ সালমান অংশ নেননি। তবে রিয়াদে এক অনুষ্ঠানে বুধবার তিনি বলেন, এ অঞ্চলের সংকট নিরসনে তার দেশ রাজনৈতিক সমাধানের আহ্বান জানাচ্ছে। আর শীর্ষে রয়েছে ফিলিস্তিনি ইস্যু এবং ফিলিস্তিনি জনগণের ন্যায়সঙ্গত অধিকার প্রতিষ্ঠা। বিশেষ করে পূর্ব জেরুজালেমকে প্রধান করে স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা।
বিবিসি বলছে, ডোনাল্ড ট্রাম্পের সমর্থক কয়েকটি দেশের রাষ্ট্র কিংবা সরকারপ্রধান সম্মেলনে অংশ নেননি। তবে শীর্ষ সম্মেলনে ইসরাইলবিরোধী সুর ছিল চড়া।
ভাষণে জেরুজালেমকে ইসরায়েলের রাজধানী হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া যুক্তরাষ্ট্রের সিদ্ধান্তকে ‘গুরুতর অপরাধ’ বলে মন্তব্য করেছেন ফিলিস্তিনের প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাস। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রশাসনের সিদ্ধান্তকে আন্তর্জাতিক আইনের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন আখ্যা দিয়ে তিনি বলেন, এ পদক্ষেপই বলে দিচ্ছে যে, মধ্যপ্রাচ্য শান্তি আলোচনায় ওয়াশিংটনের আর কোনো ভূমিকা থাকতে পারে না।
ভাষণে আব্বাস বলেন,‘জেরুজালেম ফিলিস্তিনের রাজধানী। এটি সবসময় ফিলিস্তিনেরই রাজধানী থাকবে।’ তিনি বলেন, যুক্তরাষ্ট্র এমনভাবে জেরুজালেমকে দিয়ে দিচ্ছে যেন এটি তাদের নিজেদেরই কোনো শহর।
আর তা করে যুক্তরাষ্ট্র ‘চরম সব সীমাই’ লঙ্ঘন করে গেছে। ইসরাইলের প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষপাতিত্ব থাকার কারণে মধ্যপ্রাচ্য শান্তি প্রক্রিয়ায় তাদের কোনো ভূমিকা থাকাটা আর গ্রহণযোগ্য হতে পারে না বলে মন্তব্য করেন আব্বাস। ফিলিস্তিনের এ অবস্থানকে সবাই সমর্থন জানাবে বলেও আশা প্রকাশ করেন তিনি।
ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের প্রেসিডেন্ট ড. হাসান রুহানি বলেছেন, ফিলিস্তিনের পবিত্র বায়তুল মুকাদ্দাস শহরকে ইহুদিবাদী ইসরাইলের রাজধানী হিসেবে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প যে ঘোষণা দিয়েছেন তা রুখে দিতে মুসলমানদেরকে সম্ভাব্য সবকিছু করতে হবে। তিনি ইসলামী সহযোগিতা সংস্থা বা ওআইসির শীর্ষ সম্মেলনে দেয়া বক্তৃতায় ট্রাম্পের ওই ঘোষণার বিরুদ্ধে তীব্র সমালোচনা করেন।
ড. রুহানি আরও বলেছেন, ট্রাম্পের ঘোষণার পর পরই মুসলিম দেশগুলো দ্রুত যে প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে তা মার্কিন প্রশাসনের প্রতি তাদের দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় তুলে ধরেছে এবং ওআইসির শীর্ষ সম্মেলন অনুষ্ঠানকে ট্রাম্পের ভুল পদক্ষেপের বিপরীতে সঠিক পদক্ষেপ বলে মন্তব্য করেন।
তিনি বলেন, বেলফোর ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে যে ক্ষতের শুরু হয়েছিল একশ’ বছর ধরে তার ব্যথা অনুভব করছে মুসলমানরা এবং ট্রাম্পের বেআইনি ঘোষণার মধ্যদিয়ে এখন নতুন অধ্যায়ের শুরু হয়েছে। কিন্তু সব উপায় অবলম্বন করে আমেরিকার এ অভদ্রচিত পদক্ষেপের বিরুদ্ধে আমাদেরকে ঐক্যবদ্ধভাবে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে।”
প্রেসিডেন্ট রুহানি বলেন,”কোন উপাদান ও কারণ মার্কিন প্রেসিডেন্টকে এ ধরনের নিষ্ঠুর এবং ধর্ম অবমাননাকর সিদ্ধান্ত নিতে উৎসাহিত করেছে তাও আমাদেরকে খুঁজে বের করতে হবে। তবে আমি বিশ্বাস করি, ইহুদিবাদী ইসরাইলের সঙ্গে কিছু দেশের  সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টাÑ এমনকি ইসরাইলের সঙ্গে পরামর্শ ও সহযোগিতা করার ঘটনা ট্রাম্পকে এ সিদ্ধান্ত নিতে সহায়তা করেছে।
হাসান রুহানি বলেন, ইসরাইলকে মোকাবেলার পরিবর্তে আমাদের অঞ্চলের কিছু দেশ ফিলিস্তিনি জনগণের ভাগ্য নির্ধারণের বিষয়ে আমেরিকা ও ইহুদিবাদীদের সঙ্গে জোট করে চলেছে। এ ধরনের তৎপরতায় ইসরাইল স্থায়ীভাবে ফিলিস্তিনের ওপর প্রভাব বিস্তার করবে এবং চেপে ধরবে। তিনি ইহুদিবাদীদের বিপজ্জনক প্রকল্প সম্পর্কে মুসলিম দেশগুলোকে সতর্ক করেন।
প্রেসিডেন্ট রুহানি বলেন, গত কয়েক দশক ধরে ইসরাইলি সেনারা ফিলিস্তিনিদের হত্যা ও নির্যাতন করে আসছে এবং তার প্রতি আমেরিকা অন্ধ সমর্থন দিয়েছে। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে সেই আমেরিকাকে ফিলিস্তিন ইস্যুতে মধ্যস্থতাকারী হিসেবে গ্রহণ করা হয়েছে। কিন্তু এটা খুবই পরিষ্কার যে, আমেরিকা কখনও সৎ মধ্যস্থতাকারী ছিল না এবং হবেও না।
ফিলিস্তিনের চলমান সমস্যা সমাধানের ক্ষেত্রে প্রেসিডেন্ট রুহানি সাত দফা প্রস্তাব তুলে ধরেন। এর মধ্যে রয়েছেÑ মার্কিন পদক্ষেপের নিন্দা জানানো, নানা মতভেদ সত্ত্বেও বায়তুল মুকাদ্দাস ইস্যুতে মুসলিম দেশগুলোর ঐক্যবদ্ধ অবস্থান গ্রহণ করা, ইউরোপের দেশগুলোর সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে ঐক্য গড়ে তোলা, ফিলিস্তিন ইস্যুকে মুসলিম বিশ্বের শীর্ষ এজেন্ডায় রাখা ও ইসরাইলের পরমাণু অস্ত্রের বিপদ ভুলে না যাওয়া। পাশাপাশি তিনি জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদ ও নিরাপত্তা পরিষদকে নিজেদের দায়িত্ব পালনের কথা বলেন।
একই সঙ্গে তিনি ইহুদিবাদী সরকারের পদক্ষেপের প্রতি মুসলিম বিশ্বকে প্রতি মুহূর্তে নজরদারি করার আহ্বান জানান এবং প্রয়োজনীয় ইস্যুতে ওআইসির মন্ত্রী পর্যায়ে কিংবা শীর্ষ সম্মেলনে সিদ্ধান্ত নেয়ার প্রস্তাব দেন।

আরও পড়ুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button