মহান বিজয়ের ৪৬তম বার্ষিকী
সাদেকুর রহমান: শনিবার ষোলোই ডিসেম্বর। স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশের মহান বিজয়ের ৪৬তম বার্ষিকী। ১৯৭১ সালের এদিন পাকিস্তানীদের শোষণ আর বৈষম্যের কৃংখল ভেঙ্গে পৃথিবীর মানচিত্রে বাংলাদেশ নামে একটি নতুন রাষ্ট্রের অভ্যূদয় ঘটে। বীরের জাতি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করার দিন। টানা নয়মাস সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের পর এই দিন বিকেলে রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে) হানাদার পাকিস্তানী বাহিনী যৌথবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করে। তার আগে পাকবাহিনী এদেশের মুক্তিকামী মানুষের ওপর নৃশংস বর্বরতা চালায়। এদেশের মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় মিত্রবাহিনীর রণকৌশলের কাছে পরাস্ত হয় পরাক্রমশালী পাকিস্তানী বাহিনী।
বিজয় দিবস আসলে দেশের প্রতিটি মানুষের রক্তকতাগুলো আন্দোলিত করতে থাকে চাওয়া-পাওয়ার হিসেব মিলাতে গিয়ে। দেশ স্বাধীনের সাড়ে চার দশকেও প্রকৃত অর্থে শোষণ মুক্তি ঘটেনি। বৈষম্যের দেয়াল যেন দিনকে দিন আরো দৃঢ় হচ্ছে। সাম্য ও ন্যায়বিচার যেন বাংলাদেশকে সেই কবে ‘বিদায়’ জানিয়ে গেছে। তবুও নতুন স্বপ্ন উঁকি মারে গণতন্ত্রকামী, শান্তিকামী দেশবাসীর মনে। অফুরন্ত আত্মত্যাগ এবং রক্তের বিনিময়ে অর্জিত লাল-সবুজের পতাকার দিকে সম্প্রসারণবাদী-আধিপত্যবাদীদের শ্যেণদৃষ্টিতে এমনকি সাধারণ মুক্তিযোদ্ধারাও আজ শংকিত, উদ্বেগাকূল।
১৭৫৭ সালে পলাশীর আম্রকাননে স্বাধীনতার যে সূর্য অস্তমিত হয়েছিল সেটির পুনরোদয় ঘটে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর। সেই থেকে ১৬ ডিসেম্বর শুধু পঞ্জিকার পাতায় লাল তারিখ নয়, জাতীয় জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। রক্ত আর ইজ্জতের দামে কেনা ঐতিহাসিক এ দিনটিকে যথাযোগ্য মর্যাদায় উদযাপনে সরকারের পাশাপাশি বিভিন্ন সংগঠন ও প্রতিষ্ঠান বিস্তারিত কর্মসূচি নিয়েছে। এ উপলক্ষে প্রেসিডেন্ট মো. আবদুল হামিদ, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং বিএনপি চেয়ারপার্সন ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া আলাদাভাবে বিশেষ বাণী দিয়েছেন। জাতির শ্রদ্ধা জানানোর জন্য নিরাপত্তা বেষ্টনী নির্মাণসহ সাভার জাতীয় স্মৃতিসৌধের যাবতীয় প্রস্তুতি আগেভাগেই সম্পন্ন করা হয়েছে। এছাড়া বিজয় দিবসে রাজধানীর শেরেবাংলানগরে জাতীয় প্যারেড স্কয়ারে সম্মিলিত বাহিনীর কুচকাওয়াজ অনুষ্ঠিত হয়। এ সময় প্যারেড স্কয়ার সংলগ্ন এলাকায় সুষ্ঠুভাবে যানবাহন চলাচলে নির্দেশনা জারি করেছে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি) ট্রাফিক বিভাগ।
বিজয় দিবস উপলক্ষে সরকারি ছুটির দিন আজ। সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে জাতীয় পতাকা উত্তোলন করা হয়। রাজধানীসহ দেশের বড় বড় শহরগুলোর প্রধান সড়ক ও সড়ক দ্বীপ জাতীয় পতাকায় সজ্জিত করা হয়েছে। রাতে গুরুত্বপূর্ণ ভবন ও স্থাপনায় করা হবে আলোকসজ্জা। বাংলাদেশ ডাক বিভাগ স্মারক ডাক টিকিট প্রকাশ করে। ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে দেশের হাসপাতাল, কারাগার ও এতিমখানাগুলোতে উন্নত মানের খাবার পরিবেশন করা হয়। সংবাদপত্র বিশেষ সংখ্যা প্রকাশ করে, বেতার ও টিভি চ্যানেলগুলো সম্প্রচার করে বিশেষ অনুষ্ঠানমালা।
ঢাকায় এ বছর বিজয় দিবসের অনুষ্ঠানে প্রথমবারের মতো অংশ নেন ভারতের সামরিক বাহিনীর কর্মরত (সার্ভিং) কর্মকর্তারা। বরাবরই বাংলাদেশের পাশাপাশি ভারতও ১৬ ডিসেম্বর উপলক্ষে অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। তবে এর আগে ঢাকায় ভারতীয় সামরিক বাহিনীর সার্ভিং অফিসারদের কেউ যোগদান করেননি। এ বিষয়ে কলকাতার ফোর্ট উইলিয়ামে ভারতীয় সেনাবাহিনীর ইস্টার্ন কমান্ডের এমজিজিএস মেজর জেনারেল আর নাগারাজু গণমাধ্যমকে জানান, ভারতীয় প্রতিনিধি দলের সদস্য হিসেবে ৩০ জন কর্মকর্তা এবার বাংলাদেশে বিজয় দিবসের অনুষ্ঠানে অংশ নিচ্ছেন। এর মধ্যে অন্তত চারজন সশস্ত্র বাহিনীতে কর্মরত। প্রতিনিধি দলের বাকিরা ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেয়া মিত্রবাহিনীর সদস্য।
মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার শপথে এবার বিজয় বার্ষিকী পালন করছে জাতি। সমালোচকরা বলছেন, যারা রাষ্ট্রক্ষমতায় থেকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও গণতন্ত্রের কথা বলছেন তাদের কর্মকান্ড পরিচালিত হচ্ছে উল্টো পথে। পাকহানাদার বাহিনীর মতো তারা গণতন্ত্রকামী মানুষদের হত্যা-গুম করছে, জনগণের ভাষা শাসকগোষ্ঠী বুঝতে চাইছে না। রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা বলছেন, দেশে বর্তমানে যে শাসন ব্যবস্থা চলছে সরকার একে গণতন্ত্র বললেও প্রকৃতপক্ষে তা স্বৈরতন্ত্রেরই ভিন্ন রূপ। একদলীয় কিংবা কর্তৃত্ববাদী শাসন ব্যবস্থা কায়েমে মত্ত সরকার। অবশ্য বিবেকের তাড়না থেকে সরকারপন্থী বুদ্ধিজীবীদের কেউ কেউ সাম্প্রতিক সময়ে চলমান শাসন ব্যবস্থাকে ‘সীমিত গণতন্ত্র’ বলছেন।
পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চলীয় সেনাপ্রধান লে. জেনারেল নিয়াজী তার ৯১ হাজার ৫৪৯ জন পরাজিত পাকসেনাসহ ভারতের পূর্বাঞ্চলের সেনাপ্রধান লে. জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরার কাছে নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ করেন। অবসান ঘটে পাকিস্তানী অত্যাচার আর নির্যাতনের। পাকিস্তানী সৈন্যের এ আত্মসমর্পণ ছিলো মূলত যৌথ বাহিনীর কাছে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের চূড়ান্ত পর্যায়ে মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় সেনাবাহিনী যৌথভাবে যুদ্ধ চালিয়ে যায়। মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের সর্বাধিনায়ক ছিলেন জেনারেল মো. আতাউল গণি ওসমানী। পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর আত্মসমর্পণের সময় তিনি ঢাকায় এসে পৌঁছতে পারেননি। তার বদলে এসেছিলেন ডেপুটি চিফ অব স্টাফ (পরবর্তীতে বাংলাদেশ বিমান বাহিনী প্রধান এবং মন্ত্রী) এয়ার ভাইস মার্শাল এ কে খন্দকার। যুদ্ধের নিয়মে এ দিনই পাকিস্তানের চূড়ান্ত পরাজয় ঘটে।
বিজয়ের এই ৪৬ বছর অনেক চড়াই-উতরাই পেরিয়েছে জাতি। কখনো সামনে এগিয়েছে, আবার পিছিয়ে গেছে নানা রাজনৈতিক টানাপোড়নে। তবুও হতোদ্যম হয়নি জাতি। হার না মানা বাঙালি আর্থ-সামাজিকসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে উড়াচ্ছে বিজয় নিশান। তবে গণতন্ত্রের জন্য কষ্টটা সবার রয়েই গেলো।