ব্রিটেনের রাজপরিবারে নানা পরিবর্তন
সালেহা চৌধুরী: নানা সব পরিবর্তন ব্রিটেনের রাজপরিবারে। সময়ের সঙ্গে তাল রেখে ওদের বেঁধে দেওয়া অনেক অনিয়ম এখন নিয়ম হয়ে গেছে বা মেনে নিতে বাধ্য হয়েছে রাজপরিবারের লোকজন।
র্যাচেল মেগান মার্কেল এবং প্রিন্স হ্যারি সামনের বছর মে মাসে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হবেন। আজ থেকে ১৫ বছর আগে লন্ডনে বেড়াতে এসে মেগান বাকিংহাম প্যালেসের সামনে বসে ছবি তুলেছিলেন। যেমন আমরা তুলি। কিন্তু ওকি তখন ভাবতে পেরেছিলেন, ঠিক ১৫ বছর পর হ্যারির স্ত্রী হয়ে এই সাধারণী হয়ে যাবেন প্রিন্সেস। বাকিংহাম প্যালেসের ব্যালকনি থেকে হাত নেড়ে সাধারণ মানুষদের সম্ভাষণ জানাবেন। ছবি তোলার খানিক পরে বন্ধুর সঙ্গে একটা হীরার আংটি কিনতে চেয়েছিলেন মেগান। কেনা হয়নি। টাকা ছিল না। এখন? কত সব হীরা, মণিমুক্তোয় জড়ানো থাকবে তার শরীরে। ঝকঝকে হীরার মুকুট মাথায় নিয়ে ঘুরবেন এখান থেকে সেখানে। মায়ের নাম ডোরিয়া লয়কা। মায়ের বংশের লোকজন এক সময় আফ্রিকা থেকে আমেরিকায় আসে ক্রীতদাসরূপে। মেগানের বাবা টমাস ওয়েন মার্কেল সাধারণ কাজ করেন। সিনেমায় আলোকসজ্জার দায়িত্ব তার। আর এই কারণে মেগান বাবার সঙ্গে স্টুডিওতে ঘুরে সিনেমা জগতের সঙ্গে পরিচিত হন। মেগানের জন্ম ৪ আগস্ট। বছর ১৯৮১। এখন ওর বয়স ৩৬ বছর। টেলিভিশন-সিনেমা মিলিয়ে প্রায় ২০টি ছোট-বড় কাজ করেছেন মেকাল। বাবা-মায়ের বিয়ে ভেঙে গেছে মেগান যখন ছোট। তিনি ‘হাফকাস্ট’। প্রশ্ন উঠতে পারে, তিনিই কি রাজপরিবারের প্রথম ‘হাফকাস্ট’ অর্থাৎ সাদা-কালো মেশানো দোআঁশলা একজন? না, তার আগে তৃতীয় জর্জের স্ত্রী ছিলেন এমন দোআঁশলা। তার নাম ছিল শার্লোট ম্যাকলেন বার্গ স্টেলিজ। তিনি ছিলেন আফ্রিকার পর্তুগিজের বংশধর। তিনি রানী ভিক্টোরিয়ার দাদি। তিনি ক্রীতদাসের বংশধর। এরপরের এই দোআঁশলা ঘটনার নায়িকা এই মেগান মার্কেল। তবে শার্লোটের বাবার মধ্যে ছিল কিছুটা রাজকীয় রক্ত। কিন্তু মেগান একেবারেই সাধারণ একজন। এর আগে প্রিন্স উইলিয়াম একজন সাধারণ মেয়েকে বিয়ে করেছেন। কেট মিডলটন নামে যিনি পরিচিত। দু’জনে একসঙ্গে পড়তে পড়তে প্রেম ও বিয়ে। কেটের মা এয়ার হোস্টেস। আর বাবা সাধারণ একজন ব্যবসায়ী। তবে এরা দু’জনেই ইংরেজ। কিন্তু মেগান বাইরের। ককেসীয় ও আফ্রিকার ক্রীতদাসের রক্ত ওর শরীরে। কিন্তু প্রিন্স হ্যারি ওকে একবার দেখেই বলেন- এই মেয়েই আমার পছন্দ। মেগান কিছু কিছু মানবতাবাদী কাজও করে থাকেন ঠিক প্রিন্সেস ডায়ানার মতো নানা জায়গায় ঘুরে। একবার বিয়ে হয়েছিল ওর। দুই বছর পর সে বিয়ে ভেঙে যায়।
এরপর রাজপরিবারের পেছন দিকে তাকালে আমরা কী দেখব? ‘ব্লু রক্ত’। যার কোনো ব্যতিক্রম নেই। একটু পিছু ফিরে আমরা যদি অষ্টম হেনরি আর তার ছয়জন রানীর দিকে তাকাই, তাহলে কী দেখব? যাদের নিয়ে এত গল্প, এত সিনেমা? অষ্টম হেনরি টিউডর রাজা ছিলেন। রাজত্বকাল ১৫০৯ থেকে ১৫৪৭। প্রথমে তিনি বিয়ে করেন ক্যাথারিন অব আরাগনকে। যে নারী তার বড় ভাইয়ের স্ত্রী। বড় ভাই মারা গেলে তিনি এই স্পেনের রাজকুমারীকে বিয়ে করেন। বেশ কিছুদিন ভালোই চলছিল। একটি মেয়ে হয়। এরপর তার চোখ পড়ে অ্যান বোলিনের ওপর। অ্যান তাকে বলে দিয়েছেন, তিনি হেনরির মিসট্রেস হতে পারবে না, তিনি রানী হবেন। রানী? একজন রানী থাকতে তার ওপরে আর একজনকে রানী করা যায় না। তবে ইচ্ছা করলে রাজা শত শত মিসট্রেস রাখতে পারেন। চার্চ বলে তারা এমন বিয়েতে মত দিতে পারবে না। একজন ক্যাথলিক রাজা এমন কাজ করতে পারে না। তখন চার্চ দেখাশোনা করত রোমের ক্যাথলিকপ্রধান। সাত বছর প্রেম করলেন; কিন্তু অ্যান কিছুতেই মিসট্রেস হবেন না। যদিও হেনরির আরও মিসট্রেস ছিল; কিন্তু দৃঢ়প্রতিজ্ঞ তিনি রানী হবেন। এবার হেনরি অ্যানকে বিয়ের কারণে রোমের সঙ্গে সব সম্পর্ক শেষ করে খ্রিষ্টান ধর্মের জন্য সৃষ্টি করলেন- চার্চ অব ইংল্যান্ড। রোমের পোপ কিছুতেই এমন বিয়েতে মত দেননি। তাই ঠিক করেন, রোমের কোনো খবরদারি আর তিনি মেনে নেবেন না। এরপর ক্যাথারিনকে তালাক দিয়ে অ্যান বোলিনকে বিয়ে করেন। অ্যানের কোনো পুত্রসন্তান হয় না। রাজ্য রক্ষার্থে পুত্রসন্তান দরকার। এবার তিনি ফন্দি করলেন, কী করে অ্যানকে সরাবেন। সকলে বলে অ্যান যে তাকে নিয়ে সাত বছর খেলেছে, তাতে নাকি তিনি ক্লান্ত হয়ে যান। বিয়ের এক হাজার দিন পরে অ্যানকে খারাপ মেয়ে বা ‘আনফেথফুল’ এই অভিযোগে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। এরপর তিনি বিয়ে করেন জেন সেমুরকে। অ্যান হাঁড়িকাঠে তিনি ছুটছেন জেনের বাড়ির দিকে। এক বছর পর সন্তান হওয়ার ১৪ দিন পর জেন মারা যায়। পুত্রসন্তানের জন্ম দিয়েছিলেন তিনি। তবে ছেলেকে কোলেপিঠে করে বড় করার সৌভাগ্য হলো না। এরপর ফ্রান্স থেকে একজন কনে আনা হয়। নাম তার অ্যান অব ক্লিভস। আগে কেবল ছবি দেখেছেন, এরপর প্রথম দেখাতেই অপছন্দ। বললেন- তুমি আমার বোন। টাকাপয়সা যত চাও দেব, তুমি রানী হতে চেয়ো না। এবার তিনি বিয়ে করেন ক্যাথারিন হওয়ার্ডকে। দুই বছর পর স্থূলকায়, পায়ে ক্ষত হেনরির মনে হয়, ক্যাথারিন একজনের সঙ্গে মেলামেশা, প্রেম, দেহভোগ এসব করছে। এবার এই রানীকে হাঁড়িকাঠে তোলেন। বিয়ে করেন ক্যাথারিন পার নামের একজনকে। এরপর তিনি মারা যান। ছয়জন রানী ও হেনরির এই গল্প নানাভাবে সিনেমায় দেখানো হয়েছে। তখন রাজতন্ত্র কতটা রক্ষণশীল ছিল যে রোমান ক্যাথলিক চার্চের ক্ষমতা বাদ দিয়ে তিনি সৃষ্টি করেন ‘চার্চ অব ইংল্যান্ড’। কেবল একজনকে বিয়ে করবেন বলে। তবে তার ছিল অসংখ্য মিসট্রেস।
আমি কোনো ধারাবাহিক গল্প বলছি না। বলছি এমন সব গল্প, যা বারবার ওদের রাজকীয় ক্ষমতার কথা মনে করিয়ে দেয়। রানী ভিক্টোরিয়ার বড় ছেলে প্রিন্স অ্যাডওয়ার্ড ছয়-এর ছিল নারী আসক্তি। তিনি বিয়ে করেছিলেন। কিন্তু ব্রিটেনের সবচেয়ে সুন্দরী নারীরা ছিল তার মিসট্রেস। এদের নাম অ্যালিস ক্যাপেল, লিলি ল্যাংগট্রি, ডেইজি গ্রেভিল, লেডি র্যানোল্ড চার্চিল (প্রধানমন্ত্রী চার্চিলের মা), সারাহ বার্নহার্ড (বিখ্যাত নৃত্যশিল্পী), নেলি ডিডেনস, লেডি সুসান ভেন টেম্পল, লা বেলি অটো, হেলেনিস স্রাইডার, প্যাটসি কর্নওয়ালিস ওয়েস্ট। এরা ছিলেন তার মিসট্রেস। এদের অনেকেই বিবাহিত। রাজার ক্ষমতা আর ঐশ্বর্যের কাছে হার মানতে বাধ্য হয়েছিলেন এরা। এ ছাড়া আরও অনেকের সঙ্গে সখ্য ছিল তার। প্রধান মিসট্রেস অ্যালিস কাপেল হলেন কামিলা পার্কার বোলসের দাদির দাদি। প্রিস চার্লস যাকে মিসট্রেস থেকে রানী করেন। বোকা ডায়ানা প্রাণ হারান। অ্যাডওয়ার্ড মা ভিক্টোরিয়া মারা যাওয়ার পর সিংহাসনে বসেন ১৯০১-১০। তার মৃত্যুর সময় তার রানী আলেকজান্দ্রিয়া একা ছিলেন না স্বামীর বিছানার পাশে। তার সঙ্গে ছিল অ্যালিস কাপেল। অ্যালিসের কান্নার চিৎকারে লোকজন তাকে জোর করে একটা ঘরে আটকে রাখে। তিনি এদের কাউকে বিয়ে করেননি। কিন্তু সুন্দরী মেয়েদের প্রত্যেকের জন্য বাড়ি, টাকা, ঐশ্বর্য দেদার খরচ করেছেন। হেরেম শরিফ নয়, প্রত্যেকের জন্য আলাদা প্রাসাদ ছিল।
এবার আমি চলে আসছি অ্যাডওয়ার্ড দি এইট এবং ওয়ালিস সিম্পসনের গল্পে। ওয়ালিস দু’বার তালাকপ্রাপ্ত ও বিবাহিত নারী বলে তাকে বিয়ে করতে পারেননি অষ্টম অ্যাডওয়ার্ড। যদিও মিস্টার সিম্পসন ওয়ালিসকে তালাক দিতে বাধ্য হন। ১৯৩৬ সালে রাজা হওয়ার দশ মাস পরে সিংহাসন ছেড়ে দিয়ে যাকে ভালোবাসেন তার সঙ্গে চলে গেছেন এমন এক জায়গায়, যেখানে রাজকাজ নেই। তিনি তার জীবনের পুরো সময় ফ্রান্সে কাটান। ওয়ালিস পর্যন্ত তাকে বলেছিল- আমার জন্য সিংহাসন ছাড়বে? এ করবে না। তিনি বলেছিলেন- তোমাকে বিয়ে করতে পারব না, আমার সিংহাসনের পাশে তোমাকে বসাতে পারব না, এমন সিংহাসন আমার দরকার নেই। পরে তার ভাই জর্জ দি সিক্সথ রাজা হন। যে রাজার কন্যা বর্তমান রানী এলিজাবেথ। তিনি রাজা থাকলে কী হতো কে জানে।
এবারে আসছি আর এক তালাকপ্রাপ্ত মানুষ ও প্রিন্সেস মার্গারেটের গল্পে। তালাকপ্রাপ্ত পুরুষের নাম ক্যাপ্টেন পিটার টাউনসেন্ড, যিনি তালাকপ্রাপ্ত একজন। ১৯৪৭ সালে তার ও মার্গারেটের প্রেম হয়। পিটার ছিলেন মার্গারেটের চেয়ে ১৫ বছরের বড়। রাজপরিবার এ প্রেম মেনে নেয়নি। মার্গারেটকে বলা হয়েছিল, ও যদি পিটারকে বিয়ে করে রাজকীয় সুখ-সুবিধা, অর্থ, ক্ষমতা সবকিছু থেকে বঞ্চিত হবে। মার্গারেট ওর চাচার মতো ক্ষমতা দেখিয়ে বলতে পারেনি, এসব আমার দরকার নেই। আট বছর পর কাগজে ঘোষণা দেন- আমি ও পিটার দু’জন দু’জনের সম্মতিক্রমে ঠিক করেছি, আমরা আমাদের সম্পর্ক শেষ করব। পিটার চলে যান বেলজিয়ামে এবং থিতু হন জার্মানিতে। এরপর তিনি এমন একজনকে বিয়ে করেন, যে দেখতে অবিকল মার্গারেটের মতো। ১৯৬০ সালে মার্গারেট অ্যান্থনি আর্মস ট্রং জোনস নামে একজনকে বিয়ে করেন। ১৮ বছর পর এই বিয়ে ভেঙে যায়।
এখন যদি আমরা রাজপরিবারের দিকে তাকাই তাহলে দেখব, অভাবনীয় পরিবর্তন। প্রিন্স চার্লস বিয়ে করছেন কামিলা পার্কার বোলস নামের এক তালাকপ্রাপ্ত নারীকে। যে নারী তার দাদির দাদি অ্যালিস কাভেলের মতো একজন রক্ষিতা ছিলেন। চার্লস তাকে বিয়ে করেন। এলিজাবেথ মারা গেলে তিনি রাজা হবেন না, তার ছেলে রাজা হবে- এ নিয়ে নানা কথাবার্তা চলছে। তবে সেটা আর কত বছর পরে কে বলবে।
অনেকে বলে থাকেন, এই পৃথিবীতে তাস খেলার কার্ডের রাজা-রানী আর ব্রিটেনের রাজা-রানী চিরকাল থাকবেন। অন্য সব রাজা-রানী থাকবেন না। মানুষের হাতে ক্ষমতা চলে যাবে। কোনো কোনো দেশের দিকে তাকালে আমরা এর সত্যতা জানি। ব্রিটেনে কি তাই হবে? রাজপরিবারের ওরা সব সাধারণ মানুষ হয়ে যাবেন। বাকিংহাম প্যালেসের ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে কোটি কোটি জনতাকে হাত নেড়ে সম্ভাষণ জানাবেন না? কে জানে কী হবে।
মেগান ও হ্যারি বিয়ে করবেন ১৯ মে ২০১৮ সালে।
-লেখক, ব্রিটেন প্রবাসী কথাসাহিত্যিক