বাংলা কাব্যে কুয়াশা মোড়ানো শীত
মোহাম্মদ সফিউল হক: বঙ্গ ঋতু মঞ্চে স্থবির বৈরাগ্যের সুরলহরী তুলে উত্তরীয় হিমশীতল মৃদু-মন্দ সমীরণে শীত আসে কুয়াশার পাখনায় নিশির শিশির নিয়ে। দিগন্ত বিস্তৃত রিক্ততা ও শূন্যতায় প্রকৃতির স্নিগ্ধতা ধূসরতায় পরিণত হয় শীতের তীব্রতায়। কানন বীথির কুসুম কলি ও বৃক্ষপল্লব হলুদ রং ধারণ করে শাখাচ্যুত হতে থাকে শীতের নির্মমতার পরশে। আবার মাঠে দেখা যায় সর্ষেফুলের নয়নাভিরাম হলদে ক্যানভাস দুলে ওঠে হিমেল হাওয়ায়। রাতের কুয়াশা পুকুরের জলে বিছিয়ে দেয় দুধের সরের মতো হালকা আস্তরণ, তার ওপর মাকড়সার দৌড়-ঝাঁপ দেখে মনে হতেই পারে সারা রাত জেগে কোনো এক শিল্পী তুলির আঁচড়ে এঁকে দিয়েছেন শীতের ছবি।ঘাসের ডগায় জমে থাকা কুয়াশার জলবিন্দুর ওপর অস্পষ্ট সূর্যালোক প্রতিবিম্বিত হয়ে তৈরি করে অপার সৌন্দর্যের আল্পনা। শীতের আগমনী বার্তার সাথে যোগ হয় হাওর-বাঁওড়, খাল-বিলে অতিথি পাখির আনাগোনা।
সেই আদিকাল থেকে শীতের সঙ্গে মানুষের গড়ে উঠেছে পরস্পর বিপ্রতীপ দুই সম্পর্ক। শীতের নানা উপহার ও উপাচার মানুষকে দেয় পরম প্রশান্তি; অপরদিকে তীব্র শীত আনে দুঃসহ কষ্ট। প্রশান্তি ও কষ্ট- এই দুই ভাব নিয়ে বাঙালি কবি স্মরণ করেছেন শীতকে; কবিচিত্তের নানা আবেগ, উপলব্ধি আর অভিজ্ঞানের বাণীমূর্তি শীতকে আশ্রয় করে প্রকাশিত হয়েছে। শীতের এপিঠ-ওপিঠ নিয়ে বাংলা কাব্য সাহিত্যের এক বিরাট অংশজুড়ে রয়েছে বিচিত্র সব কবিতা।
বাংলা সাহিত্যের প্রাচীন নিদর্শন চর্যাপদ। রূপকের আশ্রয়ে বৌদ্ধ সহজিয়াগণের কল্পনায় তৎকালীন সমাজের বিভিন্ন চিত্রের প্রতিফলন থাকলেও শীতের অবস্থা ও প্রভাবের কোনো উল্লেখ নেই। তবে প্রাচীন কবি কালিদাসের (৩৭০-৪৫০) রচনায় শীতের প্রভাব কিছুটা লক্ষণীয়। মানব-মনে শীতের প্রভাব ও পরিবর্তন তার অনুভবে প্রোজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। তিনি রোমান্টিক অনুভূতির প্রাখর্যে শীতের উপস্থিতি যে মানুষের জন্য আশীর্বাদ স্বরূপ সে কথাই স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন। শীতে শালিধান ও আমের প্রাচুর্যে মনোহর গ্রামীণ প্রকৃতি ঐশ্বর্যময় হয়ে ওঠে মানুষের জীবনে। সে কথাই তার কাব্য পঙ্ক্তিতে ভাস্বর হয়ে উঠেছে “হে সুন্দরী, এবার শীত ঋতুর কথা সুবর্ণ করো।/এই ঋতু শালিধান ও আমের প্রাচুর্যে মনোহর।” [‘পঞ্চম সর্গ’ ‘ঋতুসংহার’]
মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যে শীতের উপস্থিতি ততটা বেশি না হলেও একেবারে বিরল নয়। বৈষ্ণব পদাবলিতে শীত এসেছে রাধার অভিসার-অনুষঙ্গে। শীত এখানে যত-না আনন্দের অনুষঙ্গ, তারচেয়ে অনেক বেশি বেদনার শোকগাথা। বাঙালির হাজার বছরের দুঃখের কথাই যেন ফুল্লরার মুখ দিয়ে মুকুন্দরাম চক্রবর্তী (আনুমানিক ১৫৪০-১৬০০) প্রকাশ করেছেন, নিচের কবিতাংশে শীতের অনুষঙ্গে- “কার্ত্তিক মাসেতে হয় হিমের প্রকাশ।/যগজনে করে শীত- নিবারণ বাস/নিযুক্ত করিল বিধি সভার কাপড়।/অভাগী ফুল্লরা পরে হরিণের ছড়,” [(মুকুন্দরাম চক্রবর্তী/‘চ-ীমঙ্গল কাব্য]
মধ্যযুগের রোমান্টিক প্রণয়োপাখ্যানগুলোতেও শীত নিয়ে কাব্য রচনার প্রয়াসের পরিচয় পাওয়া যায়। তবে তা মানব-মানবীয় প্রেমের সংশ্লিষ্টতায় সন্দীপিত হয়েছে প্রবল রোমান্টিক ভাবধারার অনুষঙ্গে। এ ধারার অন্যতম কবি দৌলত উজির বাহরাম খান (১৬০০ শতক)। তার কাব্যে শীত বিরহ ব্যথার এক বিচ্ছেদময় আবেগ অনুভূতির মূর্ত প্রকাশ। তার রচিত পঙ্ক্তিতে সে স্মৃতিই ভাস্বর “এ সুন্দরী দেখ বিরহীর অবশেষ।/প্রবল ষট্ ঋতু নাথ বিচ্ছেদ/সরোরুহ ভেল মলিন।/দীরঘ যামিনী দিবস ভএ ক্ষীণী/কাপন তপন তুহার।”[লায়লী-মজনু ]
মধ্যযুগের একজন খ্যাতিমান কবি আলাওলের (১৬০৭-১৬৮০) কাব্যে শীত রোমান্টিক আবহে নর-নারীর প্রেম ও মিলনের অন্যতম অনুষঙ্গ হিসেবে বিধৃত হয়েছে। বিচিত্র বসনে সৌন্দর্যের ভিন্নতায় স্বামী-স্ত্রীর একাত্মতায় কেবলই শীতের প্রকোপ থেকে পরিত্রাণ পাওয়া সম্ভব। কবির কাব্য পঙ্ক্তিতে সে কথারই প্রতিধ্বনি ফুটে উঠেছে “সহজ দম্পতি মাঝে শীতের সোহাগে।/হেমাকান্তি দুই অঙ্গ এক হইয়া লাগে/পুষ্পশয্যা ভেদগুলি বিচিত্র বসন।/ওরে ওরে এক হইলে শীত নিবারণ।” [“ষট্-ঋতু-বর্ণন” ‘পদ্মাবতী’]
অগ্রজ কবি যতীন্দ্রনাথ সেনগুপ্ত (১৮৮৭-১৯৫৪) শীতকালকে দেখেছেন ‘সর্বনাশী’ হিসেবে। শীত ঋতু হচ্ছে ‘প্রলয়’ সাধনকারী রুদ্র সন্ন্যাসী। মানুষের জরা, জীর্ণতা, বৃক্ষের পাতা ঝরার দিনে শীত যেন মায়ামন্ত্রে মরণের আবাহন করে। তাঁর ভাষায়: ‘বর্ণ-গন্ধ-গীত-বিচিত্রিত জগতের নিত্যপ্রাণস্পন্দ,/কি স্বতন্ত্র মায়ামন্ত্র বলে পলে পলে হয়ে আসে বন্ধ।/মরণের আবাহন তরে কেন এই তীব্র আরাধন- চেষ্টা/সর্বনাশী/বর্ষপরে বিশ্বজুড়ে বসিলে আবার, হে রুদ্র সন্ন্যাসী।/ তোমার বিশাল বক্ষে উঠিছে পড়িছে/পূরকে রেচকে দীর্ঘশ্বাসে/ওগো যোগীশ্বর!/তব প্রতি পূরক নিঃশ্বাস আকষিছে দুর্নিবার টানে/ মৃত্যুভয়ভীতি সর্বজনে তব বক্ষ গহ্বর পানে।/…শীত ভয়ংকর!’
শীত মানুষের জীবনে দুঃখ-কষ্টের আনয়ন করলেও শীত কোনো কোনো ক্ষেত্রে আশীর্বাদস্বরূপ। ষড়ঋতুর এই দেশে অন্যান্য ঋতুর মতো শীত ঋতুও মানুষের কল্যাণ বয়ে আনে। আধুনিক যুগের প্রারম্ভের কবি ঈশ্বর গুপ্তের (১৮১২-১৯৫৯) কবিতায় কিছুটা ব্যাঙ্গাত্মক ভাবধারায় শীত ঋতুর প্রাসঙ্গিকতায় প্রেমিক-প্রেমিকার সংলাপের বৈপরীত্যে কল্যাণ-অকল্যাণের চিত্র ফুটে উঠেছে “বসানে ঢাকিয়া দেহ গড়ি মোরা আছি।/উহু উহু প্রাণ যায় শীত গেলে বাঁচি/হাসিয়া নাগর কহে, খোল প্রাণ মুখ।/শীত-ভীত হায় এত ভাব কেন দুখ/ছয় ঋতু মধ্যে শীত করে তব হিত।/হিতকর দোষী হয় একি বিপরীত।” [“মালিনী নায়িকার মানভঙ্গ” ‘কাব্য কানন’]
আধুনিক বাংলা কবিতার শীতের বহুমাত্রিক রূপ অঙ্কিত হয়েছে রবীন্দ্রনাথের(১৮৬১-১৯৪১) হাতে। শীত ঋতু নিয়ে তার অজস্র কবিতা রয়েছেথ যা জীবন ঘনিষ্ঠতায় জীবনের বিচিত্র অনুষঙ্গে ভিন্ন ভিন্ন ব্যঞ্জনায় ভাস্বর হয়ে উঠেছে। রবীন্দ্রচিত্তে হিমশীতল শীতের পরশ পরম সুখানুভূতির ইঙ্গিত বহন করে না বরং শীতে বয়ে আনা কষ্ট-যন্ত্রণা মানব-মনে তার নেতিবাচক প্রভাবই তার কাব্য পঙ্ক্তিতে ঝরে পড়েছে বারবার। শীত বিষয়ে তার দর্শন ও অনুধ্যান কবিতায় মূর্ত হয়ে উঠেছে – “ডেকেছো আজি এসেছি সাজি, হে মোর লীলাগুরু/শীতের সাথে তোমার সাথে কী খেলা হবে শুরু।/ভাবিয়াছিনু গতিবিহীন/গোধূলি ছায়ে হল বিলীন/পরাণ সম, হিমে-মলিন আড়ালে তারে হেরি-/এমন ক্ষণে কোন গগনে বাজিল তব ভেরি?/উত্তরায় কারে জাগায় কে বুঝে তার বাণী-/অন্ধকারে কুঞ্জদ্বারে বেড়ায় কর খানি।” [‘উদ্বোধন” ‘বনবাণী’]
বাংলাদেশে শীতের আগমন ঘটে প্রকৃতির স্বাভাবিক পরিবর্তনের ধারায়। চারদিকে রিক্ততা, শূন্যতা ও বিষন্ন প্রকৃতি স্বাভাবিক জীবন প্রবাহে স্থবিরতায় গতিহীন করে তোলে। এ সময়ে শস্য শূন্য খাঁ খাঁ মাঠ, পল্লবচ্যুত সবুজহীন বৃক্ষ শাখা প্রকৃতির ঊষরতারই জানান দেয়। বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের (১৮৯৯-১৯৭৬) দৃষ্টিতে শীত যেন প্রাপ্তি প্রত্যাশা ও বিচ্ছেদ বেদনাময় এক মানবীয় অনুভূতির নামান্তর। পউষের হিমের পরশ তার কাছে মোটেই সুখকর নয়। শীতের আগমনে পউষ তার অনুভবে কবিতায় ব্যঞ্জিত হয়ে উঠেছে – “পউষ এলো গো-/এক বছরের শ্রান্তি পথের কালের আয়ুক্ষয়,/পাকা ধানের বিদায় ঋতু, নতুন আসার ভয়।/পউষ এলো গো! পউষ এলো-/শুকনো নিঃশ্বাস, কাঁদন-ভারাতুর/বিদায় ক্ষণের, (আ-হ) ভাঙ্গা গলার সুর-/ওঠ পথিক! যাবে অনেক দূর/কালো চোখের করুণ চাওয়া দাঁড়ায়ে।” [“পউষ” ‘দোলন-চাঁপা’]
তিরিশোত্তর আধুনিক বাংলা কাব্যের অন্যতম কবি জীবনানন্দ দাশ (১৮৯৯-১৯৫৪)। তার মগ্নচৈতন্যে উপমা অলংকারের সাযুজ্যে শীত মৃত্যুর মতো জীবনের সামনে সমাসীন হয়। কবি মৃত্যুকে প্রত্যক্ষ করেছেন শীত ঋতুর শাখাচ্যুত পাতা, ঝরেপড়া নিশির প্রগাঢ় শিশির আলো-আঁধারের সন্ধিক্ষণে পেঁচার আকুতির অন্তর্জাত উপলব্ধিতে। এ সময়ে চারদিকে আবৃত কুয়াশার অন্ধকারে কবি জীবনের উচ্ছ্বাস প্রত্যক্ষ করলেও হিমশীতের প্রগাঢ়তায় কেবলই শূন্যতা ও রিক্ততার প্রতিচ্ছবিই কবির চোখে দৃশ্যমান। কবির উপলব্ধিতে “এই সব শীতের রাতে আমার হৃদয়ে মৃত্যু আসে;/বাইরে হয়তো শিশির ঝরছে, কিংবা পাতা,/কিংবা পেঁচার গান; সেও শিশিরের মতো হলুদ পাতার মতো।/… … …/চারদিককার আবছায়া-সমুদ্রের ভিতর জীবনকে স্মরণ করতে গিয়ে মৃত মাছের পুচ্ছের শৈবালে,/অন্ধকার জলে, কুয়াশার পঞ্জরে হারিয়ে যায় সব।” [‘শীতরাত’ ‘মহাপৃথিবী’]
বাংলার প্রকৃতিতে শীতের উপস্থিতি ও তার প্রভাব বিষয়ে অনন্য অনুভূতির বহিঃপ্রকাশ পল্লীকবি জসীমউদ্দীনের (১৮৯৯-১৯৭৬) কাব্যভূমে পরিলক্ষিত হয়। উত্তরের হিমশীতল বায়ে শ্যামল বাংলার প্রকৃতি রুক্ষতার রূপ ধারণ করে। গাছের পাতা ঝরে যায়। পল্লবহীন বৃক্ষ যেন আভরণ পরিত্যাগ করে ধ্যানী তাপসীর মূর্তি ধারণ করে। কবির চোখে পল্লব শূন্যবৃক্ষ যেন ধ্যানমগ্ন মুনি ঋষীর মতো ঠায় দাঁড়িয়ে কোনো কিছুর একনিষ্ঠ প্রত্যাশায়- “তবু কি তাহার সময় হইবে হেথায় চরণ ধরি,/মোর কুঁড়ে ঘর দিয়ে যাবে হায়, মনি-মানিকেতে ভরি।/ সে কি ওই চরে দাঁড়ায়ে দেখিবে বর্ষার তরুগুলি,/শীতের তাপসী কারে যা স্মরিছে আভরণ গায় খুলি!/হয়তো দেখিবে হয় দেখিবে না; কাল সে আসিবে চরে,/এপারে আমার ভাঙ্গা ঘরখানি, আমি থাকি সেই ঘরে।” [“কাল সে আসিবে” ‘বালুচর’]
কবি বুদ্ধদেব বসু (১৯০৮-১৯৭৪) শীত-অনুষঙ্গকে ব্যবহার করেছেন দার্শনিক উপলব্ধির উপাদান-উৎস হিসেবে। শীতের রিক্ততা কবির কাছে প্রত্যাশিত, কারণ তা মানুষকে সংসার থেকে দিতে পারে আকাক্সিক্ষত মুক্তি। শীত কবির কাছে মৃত্যুর প্রতিসত্তায় উপস্থিত হয়েছে-
“আমি যদি মরে যেতে পারতুম/এই শীতে,/গাছ যেমন মরে যায়,/সাপ যেমন মরে থাকে/সমস্ত দীর্ঘ শীত ভরে।/ৃ ৃ / যদি আমিও মরে থাকতে পারতুম-/যদি পারতুম একেবারে শূন্য হয়ে যেতে,/ডুবে যেতে স্মৃতিহীন, স্বপ্নহীন অতল ঘুমের মধ্যে-/তবে আমাকে প্রতি মুহূর্তে মরে যেতে হতো না/এই বাঁচার চেষ্টায়,/খুশি হবার, খুশি করার,/ভালো লেখার, ভালোবাসার চেষ্টায়।” [এই শীতে]
সুকান্ত ভট্টাচার্য (১৯২৬-১৯৪৭) শ্রেণী সংগ্রামের কবি। তাঁর ভাবনায় নিঃসর্গের চেয়ে জনজীবন প্রাধান্য পাবে এমনটাই স্বাভাবিক। সুকান্ত শীতে দরিদ্রের কষ্ট দেখেছেন, দেখেছেন পথের ছেলেগুলোর জন্য শীত কতটা যাতনাময়, কতটা বিভীষিকাময়। গরীবদের শীত নিবারণের জন্য সূর্যই হয়ে দাঁড়ায় উষ্ণতার অবলম্বন। ‘কৃষকের চঞ্চল চোখ ধান কাটার রোমাঞ্চকর দিনগুলোর জন্য’ যেমন প্রতীক্ষা করে, তেমনি দরিদ্ররা ‘হিমশীতল রাতের পর উত্তাপ বিলানো সূর্য ওঠার জন্য’ প্রতীক্ষায় থাকে। শীত নিবারণের জন্য শীতার্তদের কাছে ‘সকালের এক টুকরো রোদ্দুর’ এক টুকরো সোনার চেয়েও দামী মনে হয়। সেই সূর্যের প্রতি সুকান্তের আহ্বান- “হে সূর্য!/তুমি আমাদের স্যাঁতসেঁতে ভিজে ঘরে/উত্তাপ আর আলো দিও/আর উত্তাপ দিও/রাস্তার ধারের ওই উলঙ্গ ছেলেটাকে।” [“প্রার্থী” ‘ছাড়পত্র’]
অন্যদিকে শীতের দাপট থেকে বাঁচার জন্য চুলোর আগুনে তাপ পোহাবার জন্য কবি আসাদ চৌধুরীর (১৯৪৩-) ব্যস্ততা দেখার মতো- “চিরল চিরল তেঁতুল পাতা/বাতাস পাইলে কাঁপে/সাপের মতোন লক লকাইয়া/চুলার আগুন তাপে/(আমার) শীতে কাঁপে দেহ।”[সন্দেহ] কবি উনুনের তাপে শীত তাড়ালেও, শীতের কথা ভেবে কোনো এক কবি অকাতরে ভিক্ষা দেয়ার ইচ্ছা পোষণ করেন। কী হতে পারে ভিক্ষা সামগ্রী? কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায় যা বলেন- “রোদ্দুরের সঙ্গে কিছু ভিখারির শীতের আঙুল ভিক্ষা চায়/এখন নিরন্ন ঘরে তাকে ভিক্ষা দেবো/হাতে গুঁজে দেব বুনো ভাং, শুকনো পাতা।” [ভিক্ষা চায়]
শীতকালে খেজুর গাছ কেটে রস-সংগ্রহ বাংলার এক চিরচেনা দৃশ্য। কবির কাছে খেজুরের রস নয়, বরং গাছটার বেদনাই বড় হয়ে উঠেছে। এই বোধের প্রকাশ ঘটেছে সানাউল হকের কবিতায়-“পাশেই খেজুরগাছ/সতেরটি শীতাতঙ্কের/সতেরটি অস্ত্রোপচারের/ক্ষতচিহ্ন-ইতিহাস/কালো-কালো দীর্ঘশ্বাস/বুকে-পিঠে নিয়ে নিরালে ঝিমায়/তার দিকে কে তাকায়?’ [দু’টি গাছ]। কবির পঙ্ক্তিতে কখনো বা উঠে আসে পৌষ মাসের পিঠা-উৎসবের কথা- “পৌষমাস বিস্মরণ-ডুবি পানপিঠা পানিপিঠা/একদার গল্পসল্প- লুপ্তগৃহে সুপ্তপ্রায়/বাঁচি কি বাঁচি না।” [ বিরাশির কবিতা]
প্রকৃতপক্ষে শীতকে বাঙালি কবিরা উপেক্ষা করতে পারেননি। সব কালের কবিতায় শীত কিংবা শীতের প্রতীকায়ন সক্রিয়ভাবে হয়েছে। সাম্প্রতিককালের কবিরাও শীতকে নিয়ে অনেক কাব্য লিখেছেন । তার কয়েকটি নিম্নরুপ:
০১. শুয়ে আছে একজন নিরিবিলি ভোরের শয্যায়।/ শীত-গোধূলির শীর্ণ শব্দহীন নদীর মতন (‘তার শয্যার পাশে’ /শামসুর রাহমান)
০২.শীতের ঢেউ নামি আসবে ফের/ আমার বুড়ো হাড়ে ঝনাৎকার (আবদুল মান্নান সৈয়দ)
০৩. শীতের সেবায় তবে সেরে উঠি (মহাদেব সাহা)
০৪. বুকের ভেতর মাঘনিশীথের আবছা কুয়াশা (তুমি: মাহবুব সাদিক)
০৫. সব মরবে এবার শীতে/কেবল আমার ফুসফুসের পাতাঝরার শব্দ ছাড়া (এবার শীতে: আবিদ আজাদ)
০৬. হে পূর্ণিমা, হে শীত,/ শীতের কুয়াশায় ভেজা কনকনে হিমেল বাতাস/তোমরা সাক্ষী থেকো (পদচিহ্ন : কামাল চৌধুরী)
০৭. আমিও সারারাত মৃত মানুষের শীতেÍ শীতার্দ্র হয়েছিলাম (নষ্ট অন্ধকারে : রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ)
০৮. এই শহরেই ইতস্তত ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে আমার সমস্ত শীতকাল/কালোজামে ভরা এই শীতকাল এই শহরেই ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে,/ বসন্তে যেমন ঝরাপাতা সারা পাড়া জুড়ে পড়ে থাকে (সারা শীতকাল জুড়ে : মাহবুব হাসান)
০৯. শীতই একমাত্র ঋতু / অন্তত আমার বোধে অন্য কোনো ঋতু নেই (শীতার্ত চরাচরে : নাসির আহমেদ)
১০. তিনমাস শীতঘুমের পর সাপের খোলস পড়ে থাকে/ শিশিরের নিচে (তিনমাস শীতঘুমের পর: ইকবাল আজিজ)
১১. মধুর আমেজে হাসছে বনফুল, শীতের বকুল (শীতের জার্নাল : আবু করিম)
১২. শিশিরের নিচে নির্ঘুম গ্রাম যেন স্বপ্ননিবিড় (নামলো সন্ধ্যা : মাহমুদ শফিক)
১৩. খুব ভোরে শীত পাখিদের অবগাহনের পাশে রাঙাবধূ (শীত পুড়ে যাচ্ছে : জাহাঙ্গীর ফিরোজ)
১৪. শীতের আকাশ যেন কুড়োতেছে নাক্ষত্রিক বরফের কুচি (প্রত্যাবর্তন নিজের দিকে : আসাদ মান্নান)
বাংলাকাব্য সাহিত্য শীতবিষয়ক প্রতিটি কবিতাই হীরকখন্ডের বিচ্ছুরিত দ্যুতি নিয়ে বাংলা সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছে ভিন্ন ভিন্ন প্রেক্ষাপটে। চাঁদ, জ্যোৎস্না, প্রেম, বিরহ, প্রত্যাশা-হতাশা যেমন কবিতার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে তেমনি শীতে আড়ষ্ট কবির শীত বন্দনার পঙ্ক্তিমালায় নির্মমতা, নিষ্ঠুরতা আর অসহায়ত্বের চিত্রটি যেমন প্রকট হয়ে উঠেছে। কুয়াশা জড়ানো ভোর, পাতাঝরার দিন, কাকডাকা ভোরে খেজুর গাছ থেকে গাছির রস আহরণ, শর্ষে ফুলের হলুদ বিছানা, অতিথি পাখির আনাগোনা কিংবা শাপলার পাপড়িতে শিশিরের জলকণা এত শীত ঋতুরই অবিচ্ছেদ্য অংশ। স্বভাবতই শীতের মুগ্ধতা কিংবা নির্মমতা যাই বলি না কেন, বারবার কবির কলমে নিত্যনতুন পঙ্ক্তিমালায় উঠে আসবে শীত। আমরা স্বপ্ন দেখব তেমন একটা শীতের, যে শীতে উত্তাপের অভাবে খারাপ যাবে না কোনো শিশু বরং তারা ও গাইবে গান ‘শীত তুমি আনন্দের’।