সিয়াচেন হিমবাহে সৈনিকদের জীবন কাটে যেভাবে
উত্তর কাশ্মীরের সিয়াচেন হিমবাহ পৃথিবীর সবচেয়ে উঁচু যুদ্ধক্ষেত্র হিসেবে পরিচিত। ভারত এবং পাকিস্তান উভয় দেশ এ জায়গাটি নিজেদের বলে দাবী করে। উভয় দেশ এখানে কয়েক হাজার সৈন্য মোতায়েন রেখেছে।
কিন্তু সিয়াচেনে দায়িত্ব পালন করা একজন সৈনিকের জন্য ভীষণ কষ্ট এবং বিপদের।এখানে সৈন্যরা যে প্রতিপক্ষের গুলি কিংবা মর্টারের আঘাতে আঘাতে মারা পড়ছে তা নয়। এখানকার সবচেয়ে বড় প্রতিপক্ষ হচ্ছে আবহাওয়া।
ভূ-পৃষ্ঠ থেকে সিয়াচেন হিমবাহের উচ্চতা তের থেকে বাইশ হাজার ফুটের মধ্যে। অধিকাংশ সৈনিক মারা যায় তীব্র ঠাণ্ডা এবং তুষাড় ঝড়ের কারণে।
১৯৮৪ সালে সিয়াচেনে ভারত এবং পাকিস্তানের মধ্যে সংঘাত শুরু হবার পর উভয় দেশ প্রায় আড়াই হাজার সৈন্য হারিয়েছে।
এটি হচ্ছে আনুষ্ঠানিক হিসেব। কিন্তু অনানুষ্ঠানিক-ভাবে জানা যায়, নিহত সৈনিকের সংখ্যা তিন থেকে পাঁচ হাজার। নিহতের মধ্যে ৭০ শতাংশই মারা গেছে আবহাওয়া-জনিত কারণে।
২০০৩ সালে সিয়াচেন নিয়ে ভারত এবং পাকিস্তানের মধ্যে যুদ্ধ বিরতি হবার পর এখনও পর্যন্ত প্রতিপক্ষের গুলিতে একজন সৈন্যও মারা যায়নি।
পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর এক কর্মকর্তা জানান সিয়াচেনে তারা প্রতিপক্ষ নিয়ে উদ্বিগ্ন নয়, বরং তাদের প্রধান শত্রু হচ্ছে আবহাওয়া। এতো উঁচুতে অক্সিজেনের ঘাটতি একটি বড় সমস্যা।
২০১২ সালে এক ভয়াবহ তুষাড় ঝড়ে পাকিস্তানের ১৪০জন সেনা সদস্য বরফের নিচে চাপা পড়ে মারা গেছে। গত বছর একই ধরনের ঘটনায় ভারতীয় সেনাবাহিনীর নয়জন নিহত হয়।কিন্তু এরপরেও কোন পক্ষই তাদের সামরিক শক্তি কমায় নি।যদিও এটি নিয়ে দুই দেশের মধ্যে বেশ কয়েকবার আলোচনা হয়েছে।
২০০৩ সালে যুদ্ধবিরতি স্বাক্ষরের পরে সিয়াচেনে অবস্থানরত দুই দেশের সৈন্যদের তেমন একটা কাজ নেই। প্রতিদিন চার থেকে ছয় ঘণ্টা তারা টহল দেয়।
সারাবছর যাবত সিয়াচেনের তাপমাত্রা থাকে মাইনাস বিশ ডিগ্রি । কিন্তু শীতকালে এ তাপমাত্রা থাকে মাইনাস পঞ্চাশ ডিগ্রি।
সিয়াচেনে দায়িত্ব পালনকারী পাকিস্তান সেনাবাহিনীর এক মেজর জানালেন সেখানে শ্বাস-প্রশ্বাস নেয়া এক বিরাট চ্যালেঞ্জ।
শেভ করা, বাথরুমে যাওয়া কিংবা দাঁত ব্রাশ করা সাংঘাতিক কঠিন কাজ। প্রচণ্ড ঠাণ্ডার মধ্যে ঠাণ্ডা পানি দিয়ে দিনেরে পর দিন এ ধরনের কাজ করলে হাতের আঙ্গুল জমে যায়।
তীব্র ঠাণ্ডায় এমন পরিস্থিতি তৈরি হয় যে হয়তো এক পর্যায়ে হাতের আঙুলে রক্ত চলাচল বন্ধ হয়ে অকেজো হয়ে যায়। অনেক সময় কেটেও ফেলতে হয়।
সিয়াচেনে রান্নাবান্না করতে অনেক সময়ের প্রয়োজন। প্রায় সারাদিনই লেগে যায় খাবার রান্না করতে। শুধু ভাত এবং ডাল রান্না করতেই চার ঘণ্টা পর্যন্ত সময় লাগে।
পাকিস্তান সেনাবাহিনীর কর্নেল আমের ইসলাম জানালেন, কোন সৈনিককে সিয়াচেনে পাঠানোর আগে সেনাবাহিনীর পর্বত প্রশিক্ষণ ক্যাম্পে কঠোর অনুশীলন করানো হয়।
কম অক্সিজেন নিয়ে কিভাবে বেঁচে থাকা যায় সে প্রশিক্ষণ দেয়া হয় তাদের।
প্রশিক্ষণ শেষে একজন সৈনিককে তাঁর ব্যাগে প্রয়োজনীয় জিনিস দিয়ে পাঠিয়ে দেয়া হয়।
এসব প্রয়োজনীয় জিনিসের মধ্যে রয়েছে স্লিপিং ব্যাগ, অক্সিজেন সিলিন্ডার, কেরোসিন তেল, বরফ কাটার যন্ত্র, হাত ও পায়ের মোজা ইত্যাদি। পুরো ব্যাগের ওজন প্রায় ২৫ থেকে ৩০ কেজি।
পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একজন সদস্য জানালেন সিয়াচেনে সবচেয়ে প্রয়োজনীয় বিষয় হচ্ছে কেরোসিন।
কেরোসিন হচ্ছে তাদের জীবন রক্ষাকারী বস্তুর মতো। এর মাধ্যমে থাকার ঘর উষ্ণ রাখা, ফোন চার্জ দেয়া, বরফ গলানো এবং পানি ফুটানোর মতো কাজ করা হয়।
সিয়াচেনে সৈন্যদের জন্য খাবার এবং প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র এক বছরের জন্য মজুত রাখা হয়। সৈন্যদের জন্য কোন তৈলাক্ত খাবার রান্না করা হয় না।
সেনাবাহিনীর একজন মেডিকেল অফিসার বলেন, ” খাবারে কোন স্বাদ নেই। আমার প্রথম দুই সপ্তাহ খুবই খারাপ গেছে। প্রতিবার খাবার খাওয়ার সময় আমার মনে হয়েছে যেন বমি করে দিই। এ ধরনের খাবার খাওয়া তো দূরের কথা, আমি এসব কখনো দেখতেও চাই না।” সিয়াচেন থেকে দায়িত্ব পালন শেষে ফিরে আসলে তাঁর ওজন ২২ কেজি কমে গিয়েছিল বলে তিনি জানান।
পাকিস্তানের মুলতান থেকে যাওয়া একজন সৈন্য জানালেন, তিনি সিয়াচেনে যাওয়ার দুই সপ্তাহ পরে তাঁর বাবা মারা যায়।
কিন্তু তিনি আসতে পারেননি। একবার সিয়াচেনে গেলে সেখান থেকে দ্রুত ফিরে আসা খুবই কঠিন।
সিয়াচেনে অনেক অপ্রত্যাশিত বিপদও আসে। একবার এক সৈন্যকে ভাল্লুক আক্রমণ করেছিল।
তাঁর চিৎকার শুনে যখন আরকজন সৈন্য সাহায্যের জন্য এগিয়ে যায়, তখন ভাল্লুক তাঁকেও আক্রমণ করে। একজন সৈন্য মারা যায় এবং আরেকজন তাঁর একটি হাত হারিয়েছিল।
এমন প্রতিকূল অবস্থার মধ্যে বিষণ্ণতা থেকে মুক্তি পেতে সৈনিকরা তাদের ছোট ছোট আনন্দ খুঁজে নেবার চেষ্টা করে।
মুহাম্মদ শফিক নামে একজন সৈনিক জানালেন, গত বছর চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে পাকিস্তান যখন ভারতকে হারিয়ে শিরোপা জিতেছিল তখন রেডিওতে সে খবর শুনে তারা বেশ আনন্দ করেছিলেন।জয়ের পর তারা সবাই সারা রাত নাচে-গানে মেতে উঠেছিলেন। অন্য সময় সেনা সদস্যরা বই পড়ে, তাস এবং লুডু খেলে সময় কাটায়।
একজন সৈনিক জানালেন, এ ধরনের ছোট আনন্দ না থাকলে তারা তীব্র অবসাদে ভুগতেন। তিনি হতাশা প্রকাশ করে বলেন, এতো উঁচুতে এসে যুদ্ধ করা পাগলামি ছাড়া কিছুই নয়। -বিবিসি