কারী উবায়দুল্লাহ ছিলেন আলেম জগতের উজ্জ্বল নক্ষত্র
কারী মো: মিযানুর রহমান: ২০১৬ সালের ২০ ডিসেম্বর কারী উবায়দুল্লাহ ইন্তেকাল করেন। কারী সাহেবের কণ্ঠে তেলাওয়াত ও আজান শুনে আমরা রুহানি শক্তি পেতাম, ঈমানি জজবা পেতাম, কুরআন তেলাওয়াত করার উৎসাহ পেতাম ও চেষ্টা করতাম। এ দেশের হাফেজ-মাওলানা-কারীদের প্রেরণার কেন্দ্র ছিলেন কারী উবায়দুল্লাহ। তিনি ছিলেন একজন খাঁটি আবেদ ও বড় মাপের আলেম। অত্যন্ত বিনয়ী এবং সবার সাথে অত্যন্ত নম্র ব্যবহার করতেন। তিনি একবার ময়মনসিংহের গফরগাঁও মশাখালি রেলস্টেশন স্কুলের মাঠে মাহফিলে তেলাওয়াত ও ওয়াজ করলেন। শেষরাতে আমরা অনুরোধ করলাম হুজুর ফজরের আজানটা যদি দিতেন।
তিনি আজান শুরু করলেন, আমার মনে হলো সারা পৃথিবী স্তব্ধ হয়ে আজান শুনছিল, তার আরেকটি বড় গুণ ছিল, তিনি কোনো মাহফিলে যেতে ‘বাজেট’ করতেন না। মনে পড়ে ১৯৯৫ সালের দিকে গফরগাঁও লংগাইর গ্রামে মাহফিলে দাওয়াত করা হলো। কমলাপুর থেকে ট্রেনে গিয়ে গফরগাঁও স্টেশনে নেমে রিকশায় চড়ে একসাথে যাচ্ছিলাম।
একপর্যায়ে বললাম, হুজুর আমার তো লজ্জা লাগছে আপনাকে রিকশা দিয়ে নিয়ে যাচ্ছি। হুজুর বললেন, আরে মিয়া আমি তো রিকশা পাইছি। নবী রাসূল সা: ও সাহাবায়ে কেরামরা তো রিকশাও পাননি। তারা কত কষ্ট করে ইসলাম প্রচার করেছেন। এ কথা শুনে আমার কান্না এসে গেল। তাই লোকমুখে বলতে শোনা যায় কারী উবায়দুল্লাহর মতো মানুষ কি আর হবে? আসলে যার জীবনটাই গড়া কুরআনের ওপর তিনি তো এমনই হবেন। তিনি হাফেজ্জী হুজুরের প্রতিষ্ঠিত, ঢাকার লালবাগ মাদরাসায় ছাত্রজীবন থেকেই সুললিত কণ্ঠে কারী হিসেবে পরিচিত।
কোনো আয়োজন হলেই কুরআন তেলাওয়াতের জন্য ডাক পড়ত তার। ২০-২৫টি দেশে কুরআন প্রতিযোগিতায় একাধিকবার প্রথম স্থান লাভ করে তিনি বাংলাদেশের মানমর্যাদা বাড়িয়েছিলেন। বিভিন্ন মাদরাসায় তিনি কুরআনের খেদমত করেছেন। গ্রামবাংলার প্রত্যন্ত অঞ্চলে ওয়াজ মাহফিলে প্রথমে তেলাওয়াত তার পর বয়ান; এমনকি শ্রোতাদের অনুরোধে আজান ও শোনাতেন।
অনেকে রেডিওতে তার আজান শুনতেন আর কাঁদতেন দু’হাত তুলে। সর্বত্র দেখেছি দলমত নির্বিশেষে তাকে মানুষ অত্যন্ত ভালোবাসতেন। একদিন একজন বলছেÑ হুজুরের তেলাওয়াত শোনার জন্য রেডিও টিভি ছেড়ে বসে থাকি। যখন তার নাম বলা হয় এবং হুজুর কুরআন তেলাওয়াত করতে শুরু করেন তখন আমি মন ভরে তেলাওয়াত শুনি। বিটিভির কর্মচারীরা তাকে আমাদের কারী সাহেব বলে ডাকতেন। এমনকি, চকবাজার শাহী জামে মসজিদের মুসল্লি এবং ভক্তরা বলতেন আমরা কারী সাহেবকে ফেরেশতা মনে করি। বাংলাদেশ বেতারে এবং বিটিভিতে যে আজান আমরা শুনি, তা তিনি ওয়াকফ করে দিয়েছেন। কোনো কোনো মাহফিল থেকে হাদিয়া দিলে ওই হাদিয়া কখনো কখনো ওই প্রতিষ্ঠানের জন্য দান করে দিয়ে আসতেন।
তিনি দেশের শীর্ষস্থানীয় আলেমদের মধ্যে ছিলেন অন্যতম। হাফেজ্জী হুজুরের যেকোনো কর্মসূচি থেকে শুরু করে আলেমদের বড় বড় অনুষ্ঠানে তাকে দেখা যেত। তিনি যখন বাকশক্তি হারানো অবস্থায় ছিলেন, একদিন স্বপ্নে দেখি বিশাল জায়গায় সবুজ ধানক্ষেত। নিচু জমি থেকে উঁচু জমিতে মেশিন দিয়েপানি সেঁচ করছেন। এক পর্যায়ে মেশিন ছেড়ে নিচের জমিতে নেমে ধান গাছের গোড়ায় হাত দিয়ে কি যেন পরিষ্কার করছিলেন।
আর বলছিলেন এগুলো হলো আল্লাহর নেয়ামত। এই স্বপ্ন হুজুরকে শুনালাম, হুজুর খুশিতে জোরে কান্না শুরু করে দিলেন। অনেকক্ষণ কাঁদলেন। আমি সান্ত্বনা দিলাম যে, আপনার চিন্তা নেই পৃথিবীতে কুরআনের যে ফসল আপনি বপন করেছেন মৃত্যুর পর সেই ফসল আকাশে উঠতেই থাকবে।
এটা ছাড়া এমন স্বপ্নের তাৎপর্য আর কি হবে? গত বছর ২০ ডিসেম্বর রাতে তিনি ইন্তেকাল করেন। পরের দিন বাদ জোহর চকবাজার শাহী জামে মসজিদে তার নামাজে জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। হুজুরের নামাজে জানাজায় অসংখ্য মানুষ উপস্থিত হলেন। চকবাজার পাঁচ তলা মসজিদ ভরে আশপাশের রোড ভরে সোয়ারি ঘাট থেকে কেন্দ্রীয় কারাগার গেট, উর্দুরোড চৌরাস্তা পর্যন্ত মুসল্লিদের কাতার ছিল।
তার নামাজে জানাজায় উপস্থিত হয়েছিলেন চকবাজার শাহী মসজিদের সেক্রেটারি আবদুস সালাম, মাওলানা মোখলেছুর রহমান, মাখযানুল উলুম মাদরাসার প্রিন্সিপাল মাওলানা নুরুল ইসলাম, ফরিদাবাদ মাদাসার শিক্ষক মাওলানা ইমাদুদ্দিন, কারী আবু রায়হান, কারী হাবিবুর রহমান, বড় কাটারা মাদরাসার মুফতি সাইফুল ইসলাম, মুফতি তৈয়ব, আল্লামা আজিজুল হক সাহেবের ছেলে মাওলানা মাহবুবুর রহমান, ইসলামী ঐক্যজোটের মুফতি ফয়জুল্লাহ, কারী মিযানুর রহমান গফরগাঁও, কারী নজিবুল্লাহ প্রমুখ। নামাজে জানাজার আগে বক্তারা কারী উবায়দুল্লাহর জীবনী সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত আলোচনা করেন।
মাওলানা নুরুল ইসলাম বলেন, কারী উবায়দুল্লাহর সাথে জীবনে অনেক কাজ করেছি। তার মতো মুখলেছ (বিশুদ্ধ) বা ঘাঁটি আলেম আমি কখনো দেখিনি। তিনি ছিলেন আলেম জগতের উজ্জ্বল নক্ষত্র এবং কুরআন শিক্ষার উৎসাহ দানকারী। তার নামাজে জানাজার ইমামতি করেন তার ছেলে কারী ওয়ালিউল্লাহ। বিকালে আজিমপুর কবরস্থানে তাকে চিরশায়িত করা হয়। ২৪ ডিসেম্বর চকবাজার শাহী মসজিদে কারী উবায়দুল্লাহর স্মরণে হুসনে কেরাত ও দোয়া মাহফিল অনুষ্ঠিত হয়। মাহফিলে প্রখ্যাত কারীরা তেলাওয়াত এবং মরহুমের রূহের মাগফিরাত কামনা করেন।