ট্রাম্পের গোড়ামি ও একক সিদ্ধান্তে পৃথিবী সংকটে

trumpযারা মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে চিনতেন তাদের আশঙ্কা ছিল এক অনিশ্চিত সময়ের দিকে যাত্রা শুরু হলো যুক্তরাষ্ট্র। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সব হিসাব-নিকাশ উল্টে দিয়ে যেভাবে তিনি হোয়াইট হাউজে প্রবেশ করলেন তাদের সেরকম আশংকার কিছু কারণ ছিল। বাস্তবে তিনি যাই করুন হোয়াইট হাউজে ঢোকার পর থেকে ডোনাল্ড ট্রাম্পকে গত এক বছর ধরে মার্কিন রাজনীতির গতি পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে আনতে পারেননি সে নিয়ে দ্বিমত নেই রাজনৈতিক পন্ডিতদের।
এ প্রসঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সাউদার্ন ক্যারোলিনা ইউনিভার্সিটির ড. শফিকুর রহমান বলেন, তিনি একটা ভিন্ন ধরণের রাজনৈতিক প্রভাব এবং ধরন নিয়ে এসেছিলেন। রাজনীতির ভিতর গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ যদি না থাকে এবং তিনি একা একা সবকিছুতে সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন। সেটা অত্যন্ত ক্ষতিকর এবং সারা পৃথিবী একটা সংকটের মধ্যে চলে যাচ্ছে। দায়িত্ব নেয়ার দুদিন পরে যুক্তরাষ্ট্রকে মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি থেকে প্রত্যাহারের ঘোষণা দিলেন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প। এর চেয়ে বড় চমক অপেক্ষা করছিল বিশ্ববাসির জন্য। নির্বাচনি প্রচারণার সময় তার একটি ঘোষণা স্তম্ভিত করেছিল সবাইকে। তিনি যুক্তরাষ্ট্রের সব মুসলিমদেরকে নিষিদ্ধ করার প্রস্তাব দিয়েছিলেন। হোয়াইট হাউজে প্রবেশের এক সপ্তাহের মধ্যে এলো তা বাস্তবায়নের ঘোষণা। তিনি ৭ টি মুসলিম দেশের নাগরিককে যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করলেন।
ডোনাল্ড ট্রাম্প যেরকম প্রেসিডেন্ট হবেন বলে আশঙ্কা করা হয়েছিল বাস্তবে কি তাই দেখা গেছে? এমন প্রশ্নের জবাবে ব্রুকলিন ইউনিস্টিটিউটের সিনিয়র ফেলো ড. এ্যালায়েন ক্যামার্কে বিবিসিকে বলেন, তাকে যতটা অনিশ্চিত প্রকৃতির বলে ভাবা হয়েছিল তিনি আসলেই তাই। তাকে নিয়ে লোকের অতটা ভয়ের কারণ ছিল না এ কারণে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টকে সর্বময় ক্ষমতাধর ভাবা হয়,প্রেসিডেন্ট আসলে সেরকম ক্ষমতাধর নন। আদালত এবং কংগ্রেসের মতো প্রতিষ্ঠান আছে তার ক্ষমতাকে আটকে দেয়ার জন্য এখন পর্যন্ত আসলে তাকে সেভাবে থামিয়ে দেয়া সম্ভব হয়েছে। যেমন মুসলিমদের নিষিদ্ধ করার জন্য তার চেষ্টা আদালত তিনবার প্রত্যাখ্যান করেছে। কংগ্রেস এবং আদালত তার নানা পদক্ষেপ আরো বিভিন্ন ক্ষেত্রে এভাবে থামিয়ে দিয়েছে।
প্রেসিডেন্টের কাজের ধারা নিয়ে তিনি একটা বই লিখেছিলেন ‘হোয়াই প্রেসিডেন্ট ফেল’। ক্যামার্কে গত এক বছরের অবস্থা বিবেচনা করে বলেন, এরকম প্রেসিডেন্ট যুক্তরাষ্ট্রে তার ইতিহাসে আর কেউ দেখেনি। মি. ট্রাম্প একজন অস্থির প্রকৃতির, কিভাবে নীতি প্রনয়ন করতে হয় তিনি জানেন না। যুক্তরাষ্ট্রে নানা ধরনের মানুষ আছে, তিনি সবার প্রতি সংবেদনশীল নন। যুক্তরাষ্ট্রের এ যাবত যত প্রেসিডেন্ট হয়েছেন তিনি সবচেয়ে ভিন্ন ধরনের প্রেসিডেন্ট। মি. ট্রাম্পের আরেকটি নির্বাচনী অঙ্গীকার ছিল তা হলো মেক্সিকোর সীমান্ত বরাবর একটা প্রাচীর তৈরি করা, যাতে অবৈধ অভিবাসন আসা বন্ধ করা যায়। এ দেয়াল তৈরির খরচ মেক্সিকোর কাছ থেকে আদায় করা হবে বলে ঘোষণা দিয়ে মেক্সিকোর সরকারের সঙ্গে তর্কে জড়িয়ে পড়েন ট্রাম্প। মুসলিমদের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা জারি করতে গিয়ে যেরকম বাধার মুখে পড়েছিলেন তিনি, একই বিপদে পড়লেন ওবামাকে বিলুপ্ত করতে গিয়ে। এ ছিল তার আরেকটা নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি। ওবামাকে বাতিলের নির্বাহী ঘোষণায় সই করলেন প্রেসিডেন্ট জনগণের জন্য দারুণ স্বাস্থ্যসেবার ব্যবস্থা করবেন বলে প্রতিশ্রুতি দিলেন। কিন্তু ব্যাপারটা বলা যত সহজ ছিল কাজে পরিণত করা তার চেয়ে অনেক কঠিন হয়ে দাঁড়াল। এসব অভ্যন্তরীণ ইস্যু ছাড়াও প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের বড় ব্যর্থতা হচ্ছে তার পররাষ্ট্র নীতি।
সাউদার্ন ক্যারোলিনা ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক ড. শফিকুর রহমান বলেন, যেটা দেখতে পাচ্ছি যে ফরেন পলিসির বিভাজনটা, রাশিয়াকে তিনি কখনো খারাপ কথা বলেননি। কিন্তু রাশা হচ্ছে আমেরিকার এক নম্বর শত্রু। গত ২০ থেকে ২৫ বছর যাবত আমরা যা দেখেছি এরপরে যেটা সেটা হচ্ছে যে বিশেষ করে ফরেন পলিসিতে উত্তর কোরিয়া যাকে ট্রাম্প কোনভাবে হ্যান্ডেল করতে পারছেন না। কাজেই বিভিন্নভাবে তিনি ভয় দেখিয়েছেন, অর্থনৈতিক অবরোধের কথা বলেছেন, বিভিন্ন শব্দ ব্যবহার করে গালাগালি করেছেন। কিন্তু তাকে খুব একটা ভালোভাবে হ্যান্ডেল করতে পারছেন না। বড় রকমের যে ক্রাইসিসটা আছে সেটা হলো মিডল ইস্ট এবং ইসরায়েলকে নিয়ে। বিশেষ করে জেরুজালেমের রাজধানীকে নিয়ে তিনি যে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। এটা নিয়ে সারা বিশ্বের জনগণের মধ্যে ভীতির সৃষ্টি হয়েছে।শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প আশ্বাস দিয়েছিলেন তিনি সব আমেরিকানদের প্রেসিডেন্ট হতে চান। আমেরিকাকে ঐক্যবদ্ধ করতে চান তিনি। কিন্তু এক বছর পরে যুক্তরাষ্ট্র আরো বেশি বিভক্ত। কিন্তু অনেকের কাছে এ বিভক্তির বড় কারণ প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প।গত এক বছরে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প যত সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, যেসব নীতি গ্রহণ করেছেন, যেসব নির্বাচনী অঙ্গীকার বাস্তবায়নের চেষ্টা করেছেন, তার মধ্যে কোনটি তার শাসনের বড় চাপ বলে লোকে মনে রাখবে?
এমন প্রসঙ্গে এলিয়ন ক্যামার্কে বলেন, তিনি অভিবাসনের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছেন যে ধরণের কড়াকড়ি আরোপ করেছেন আমার মনে হয় প্রেসিডেন্ট হিসেবে তার শাসন আমলে চিহ্ণিত হয়ে থাকবে এই একটি বিষয়ের জন্য। এর বাইরেও তার প্রশাসনে ব্যাপক বিশৃঙ্খলা আমরা দেখেছি সেটির কারণেও তার শাসনামল স্মরণীয় হয়ে থাকবে। এর পাশাপাশি সন্দেহ আছে, রাশিয়ার তৎপরতা তাকে প্রেসিডেন্ট পদে আসীন হতে সাহায্য করেছে। নির্বাচনের সময় প্রেসিডেন্ট হওয়ার জন্য রাশিয়ার যোগসাজশ ছিল বলে সেটার তদন্ত নিয়ে বছর জুড়ে তাকে তাড়া করে ফিরেছিল। এটি কি শেষ পর্যন্ত প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের জন্য কাল হয়ে দাঁড়াতে পারে? ড. এলায়েন ক্যামার্কে মনে করেন তা হওয়া সম্ভব। কিন্তু যে মানুষটিকে নিয়ে এত উদ্বেগ, বিতর্ক, এত সংখ্যা, সামনের বছরগুলোতে তার সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়া এবং আচরণে কোন পরিবর্তন কি আশা করা যায় না? ড. এলায়েন ক্যামার্ক বলেন, আমরা যেটা ভাবি আবার দেখা যায় যে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প তার অপ্রেসিডেন্ট আচরণে ফিরে গেছেন। কাজেই আমি আসলে জানি না এরকম কিছু দেখব কিনা। আমি যেটা জানি সেটা হলো তার মর্জি মাফিক তিনি যেন হঠাৎ করে কোন কিছু করে না ফেলেন তার জন্য হোয়াইট হাউজে যারা আছেন, রাজনীতিবীদ এবং আদালত এরা সবাই খুবই সর্তক। তিনি এমন এক ধরণের প্রেসিডেন্ট আমরা আগে কখনো দেখিনি। তার কোনো অভিজ্ঞতা নেই, তিনি পড়াশোনা করেন না, তিনি জটিল বিষয় অনুধাবন করতে পারেন না, তিনি আসলে তালগোল পাকানো এক প্রেসিডেন্ট। ড. ক্যামার্ক মনে করেন এত সীমাবদ্ধ থাকা সত্ত্বেও প্রেসিডেন্টকে ঘিরে একটা ব্যবস্থা চালু আছে এবং হয়তো সে ব্যবস্থাটি যুক্তরাষ্ট্র এবং বাকি বিশ্বকে এক অস্থির মতির প্রেসিডেন্টকে খামখেয়ালি সিদ্ধান্ত থেকে রক্ষা করবে।

আরও পড়ুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও দেখুন...
Close
Back to top button