মহাবিশ্বের জ্ঞান অর্জনে কোরআনি তাগিদ
মনসুর আহমদ: মহাবিশ্বের জ্ঞান অর্জন কোন বিলাসী কাজ নয়। এ বিষয় পশ্চিমা জগৎ এগিয়ে চলছে দ্রুত গতিতে, কিন্তু বর্তমানে মুসলমানের এ ব্যাপারে কোন চেতনা নেই। অথচ মহাকাশ গবেষণা ঈমানকে মজবুত করার জন্য অপরিহার্য। আল্লাহ তা’য়ালাই আমাদেরকে প্রকাশমান বিশ্বলোক সম্পর্কে চিন্তা ও গবেষণা করার জন্য আহ্বান জানিয়েছেন আকাশ ম-লী ও পৃথিবী সৃষ্টির ব্যাপারে কোরআন পাকে এরশাদ হচ্ছে-
“ইন্না ফি খালকিস সামাওয়াতি ওয়াল আরদি ওয়াখতিলাফিল লাইলি ওয়ান্নাহারে লাআয়াইতিল্ লি উলিল আলবাবিল্লাজিনা ইয়াজ কুরুনাল্লাহা কিয়ামাওঁ ওয়া কুয়ুদা ওয়া য়ালা জুনুবিহিম ওয়া ইয়াতাফাক্কারুনা ফি খালকিস্ সামাওয়াতে ওয়াল আরদি.. (আলে ইমরান-১৯০)
অর্থাৎ- আকাশ মন্ডল ও পৃথিবীর সৃষ্টিতে; দিবস ও রাত্রির পরিবর্তনে, নিশ্চিত নিদর্শনাবলী রয়েছে প্রকৃত বুদ্ধিমান লোকদের জন্য। যারা আল্লাহকে স্মরণ করে দাঁড়িয়ে বসা ও শায়িত অবস্থায় সর্বক্ষণ এবং আকাশ মন্ডল ও পৃথিবী সৃষ্টি পর্যায়ে চিন্তা ভাবনা করে।
এই চিন্তা ভাবনা ও গবেষণার ফলশ্রুতিতে এক জন ঈমান দার পরম সত্যে উপনীত হয় এবং মহান আল্লাহ্র একমাত্র সৃষ্টিকর্তা হওয়ার ব্যাপারে দৃঢ় প্রত্যয় লাভ করে।
মহান আল্লাহ আকাশ গবেষণার তাগিদ দিয়ে ইরশাদ করেন- “আফালাম ইয়ানজুরু ইলাস্ সামায়ে ফাওকাহুম কাইফা বানাইনাহা ওয়া ঝাইয়ান্নাহা ওয়া মালাহা মিন ফুরুজ। ওয়াল আরদা মাদাদনাহা ওয়া আলকাইনা ফিহা রাওয়াসিআ ওয়া আনবাতনা মিন কুল্লি ঝাওজেম্ বাহিজ। (কাফ-৬-৭)
অর্থাৎ-ওরা কি কখন ও ওদের উপর অবস্থিত আকাশ মন্ডলের দিকে দৃষ্টি মেলে তাকিয়ে দেখছে কি ভাবে তা আমরা নির্মাণ করেছি, সুসজ্জিত ও সৌন্দর্যমন্ডিত বানিয়েছি এবং তাতে কোন ফাঁক ফাটল নেই ? আর যমীনকে আমরা সুবিন্যস্ত করেছি, তার বুকে বড় বড় পর্বতরাশি দাঁড় করিয়ে দিয়োছ এবং তাতে তরতাজা চাকচিক্যময় জোড়াসমূহ উৎপাদন করেছি?
সুসজ্জিত সুবিন্যস্ত আকাশ ম-ল মানুষের নিকট চিরদিনের জন্য এক মহাবিস্ময়ের ব্যাপার। আধুনিক বিজ্ঞানের গবেষণার ফলে এই মহাবিস্ময় আরও বিস্ময়কর হয়ে উঠেছে। কিন্তু এ ব্যাপারে মুসলমানদের আবদান আরও ব্যাপক হওয়া উচিত ছিল।
বিশ্ব নিয়ে চিন্তা ভাবনাশুরু হয় বেশ পরে। ইসলামের প্রথম দিকে দীনের মৌলিক শিক্ষা প্রচার ও বাস্তবায়নে বহু বছর কেটে যায়। পরে হিজরী চতুর্থ শতাব্দীর মধ্যভাগে শিয়া মতবাদের ছায়াতলে ইখওয়ানুস সাফা নামে একটি ধর্মীয় সম্প্রদায়ের আবির্ভাব হয়। এই দলটির প্রকৃত অবদান হলো তাদের জ্ঞান বিজ্ঞান চর্চা। তারা অংক, ভূগোল, জ্যেতির্বিদ্যা দর্শন, সঙ্গীত প্রভৃতি ক্ষেত্রে বিভিন্ন প্রবন্ধ রচনা করেন।
জ্যোতিষ শাস্ত্রের উৎকর্ষতা শুরু হয় খলিফা আল মামুনের কালে (৮১৯-’৩৩ খ্রিঃ)। মামুনের রাজত্ব কালে অনুবাদ কার্যের ফলে জ্ঞান বিজ্ঞানের প্রতিটি শাখায় ব্যাপক উন্নতি সাধিত হয়। জ্যোতির্বিদ্যার প্রতি মামুনের প্রগাঢ় অনুরাগ ছিল এবং তিনি নিজেও একজন জ্যোর্তিষবিদ ছিলেন। জ্যোতির্বিদ্যা সম্বন্ধে ব্যাপক গবেষণা চালানোর জন্য তিনি বাগদাদের সন্নিকটে ট্যাডমোরের প্রান্তরে শামসিয়া নামক স্থানে মান মন্দির নির্মাণ করেন। এটিই ইসলামের ইতিহাসে প্রথম মান মন্দির। খলিফা আল মামুনের সময় সিনদ বিন আলী এবং ইয়াহ বিন- আবি মনসুরের তত্ত্বাবধানে এই মান মন্দির নির্মিত হয়। আল মামুন দামেস্কের নিকট কাসিয়ুনেও একটি মান মন্দির নির্মাণ করেন। আব্বাসীয় খিলাফতের অন্যতম প্রখ্যাত জ্যোতির্বিদ আবু আল- আব্বাস আহমদ আল ফারগানী। পরবর্তী কালে স্পেনের জ্যোতির্বিদ মাসলামা আল মাজরিতি জ্যোতির্বিদ্যা সংক্রান্ত সারণী বিশোধিত করেন। বুয়াইয়া আমলে বাগদাদে যে মানমন্দির প্রতিষ্ঠিত হয় উহাতে আবদুর রহমান আস সূফী, আহমদ আস সাগানী এবং আবু ওয়াফা গবেষণা কার্য পরিচালনা করেন। অনন্ত বিশ্ব সম্পর্কে জানার জন্য মামুনের উৎসাহে আরব জ্যোর্তিষবিদদের নিরলস প্রচেষ্টার প্রশংসা করতে গিয়ে Draper বলেন, “The Arabs have left unfading trace of their fingers on the sky which every one can seewho reads the names of the stars on an celestial globe.” অর্থাৎ “আরবগণ নভোম-লে যে অম্লান হস্তছাপ রেখেছেন তা যে কোন ব্যক্তি ভূমন্ডলের নক্ষত্র সম্বন্ধীয় জ্ঞার আহরণ কালে উপলদ্ধি করতে পারবেন।”
ইসলামের অন্যতম শ্রেষ্ঠ জ্যোতির্বিদ আল বাত্তানী (৮৭৭-৯১৮) খ্রিঃ রাক্কায় জ্যোতিষ শাস্ত্র গবেষণায় আত্মনিয়োগ করেন। মৌলিক গবেষণায় তাঁর যথেষ্ট অবদান রয়েছে। টলেমির সূত্র পরিবর্তন করে তিনি চন্দ্র এবং বিভিন্ন গ্রহের কক্ষ পথ সম্পর্কে অবিনব মত প্রতিষ্ঠা করেন। সুলতান মাহমুদের পৃষ্ঠপোষকতায় তিনি জ্যোতিষ শাস্ত্রের সমসাময়িক তত্ত্বাবলীর সমন্বয়ে “আল কানুন উল মাসূদী ফিল হাইওয়ান নজুম” শীর্ষক একটি গবেষণা প্রসূত গ্রন্থ ১০৩০ খ্রিষ্টাব্দে প্রণয়ন করেন।
বৈজ্ঞানিক কার্যকলাপ নবম ও দশম শতাব্দীতে সম্পূর্ণরূপে না হলেও, প্রভূত পরিমানে তাইগ্রীস ও ফোরাত নদীর উপত্যকায় কেন্দ্রীভূত হয়েছিল। দশম শতাব্দীর প্রথম চল্লিশ বছরের মধ্যে খলিফারা দীর্ঘ দিনের জন্য পার্থিব ক্ষমতা থেকে বঞ্চিত হয়ে গেলেন। বাগদাদ এবং পারস্যের ঊভয় স্থলে, প্রথমটিতে পারসিকদের শাসনকালে এবং দ্বিতীয়টিতে কোনো তুর্কী বংশীয়দের শাসন কালে অন্ধকারময়তার যুগ শুরু হয়ে গেল। একই সময় আরব সাম্রাজ্যের রাষ্ট্রশক্তি বৈজ্ঞানিকদেরকে পৃষ্ঠপোষকতা কমিয়ে দিলেন। যেমন খলিফা হাকিম (৯৯৬-১০২১) কর্তৃক কায়রোতে প্রতিষ্ঠিত “বিজ্ঞান সভার” বার্ষিক বাজেট ছিল মাত্র ২৫৭ দিনার। এ সব কারণে মুসলমানরা প্রতিযোগিতায় খ্রিষ্টান ইউরোপের সঙ্গে টিকে থাকতে পারল না। কারণ ত্রয়েদশ শতাব্দীর শুরু থেকেই ইউরোপে নাগরিক জীবন ও শিল্প বানিজ্যে বিবর্তন শুরু হয়ে যায়। ইউরোপের রেনেসাঁর সাথে প্রতিযোগিতায় মুসলমানগণ টিকে থাকতে পারল না। পঞ্চদশ শতাব্দীর পরে ইসলামিক জগৎ বর্বরতায় পর্যবসিত হয়ে পড়েছিল। যে সমস্ত অনুকুল পরিবেশে মুসলমান সংস্কৃতি ও বৈজ্ঞানিক উন্নতি ঘটেছিল, বর্তমানে সেগুলির অভাব। আজ তাই মুসলমানদেরকে পুনরায় হারান গৌরব ফিরিয়ে আনতে কোরানের ছায়াতলে আশ্রয় নিতে হবে।
মা গ্রন্থ আর কোরআনে প্রচুর আয়াত রয়েছে মহাবিশ্ব সম্পর্কে চিন্তা গবেষণার তাগিদ দিয়ে যেমন- “আলাম তারা কাইফা খালাকাল্লাহু সাবায়া সামাওয়াতেন তিবাকা, ওয়া জায়ালাল কামারা ফিহিন্না নুরাওঁ ওয়া জায়াআশ্ শামসা সিরাজা। (নূহ- ১৫-১৬)
অর্থাৎ-তোমরা কি ভেবে দেখেছ আল্লাহ্ কি ভাবে স্তর বিন্ন্যাস করে সপ্ত আকাশ সৃষ্টি করেছেন, তাতে চন্দ্রকে আলো বানিয়েছেন এবং সূর্যকে বানিয়েছেন প্রদীপ।
“কুল সিরু ফিল আরদে ফানজুরু কাইফা বাদায়াল খালকা (আল আনকাবুত-২০)
অর্থাৎ- বল হে নবী! তোমরা পৃথিবীতে পরিভ্রমণ কর অতঃপর লক্ষ্য করে দেখ, আল্লাহ্ সৃষ্টিকর্ম কি ভাবে সৃষ্টি করেছেন।
“ওয়া কাআইয়িম্ মিন আয়াতিন ফিস্ সামাওয়াতে ওয়াল আরদে ইয়ার্মুরুরনা আলাইহা ওয়া হুম আনহা মু’রেদুন। (ইউসুফ-১৫)
অর্থাৎ- মহাকাশ ও পৃথিবীতে কত অসংখ্য নিদর্শন রয়েছে। লোকেরা তার উপরে দৃষ্টি ফেলে চলে যায়, কিন্তু তার মর্ম বুঝতে ইচ্ছুক নয়।
এতসব নির্দেশ থাকার পরেও মুসলিম বিশ্ব এখনও নীরব। আজ যদি মুসলমানরা আবার গবেষণা কার্যে লেগে যায় তা হলে মহা বিশ্ব রহস্য তাদের হাতের মুঠোয় এসে যাবে।