বাংলাদেশি গার্মেন্টস শিল্প নিয়ে ব্রিটেনে উদ্বেগ

Rana Plazaবাংলাদেশের গার্মেন্টস শ্রমিকদের অধিকারের বিষয়, বিশেষ করে কর্মস্থলে তাদের নিরাপত্তা, বেতন-ভাতা, সুযোগ-সুবিধা এখন আর দেশের ভেতরে আলোচনায় সীমাবদ্ধ নেই। ব্রিটেনের শ্রমিক সংগঠনগুলো বাংলাদেশের গার্মেন্টস শ্রমিকদের অধিকারের বিষয়টি নিয়ে ইতোমধ্যে বেশ তৎপর এবং আগামীতে তাদের তৎপরতা আরো জোরদার করতে যাচ্ছে। তবে তাদের মূল লক্ষ্য হবে যেসব ব্রিটিশ কোম্পানি বাংলাদেশ থেকে গার্মেন্টস কেনে, তাদেরকে শ্রমিকদের নিরাপত্তা এবং রুটি-রোজগারের বিষয়ে অঙ্গীকারবদ্ধ করা।
ব্রিটিশ শ্রমিক সংগঠনদের জোট ট্রেড ইউনিয়ন কংগ্রেস বা টিইউসি-র আন্তর্জাতিক শাখার মুখপাত্র স্যাম গেরনি বলেন, কেউ বাংলাদেশ থেকে তৈরি পোশাক কেনা বন্ধ করার কথা বলছে না। তবে পোশাক কী পরিবেশে তৈরি হচ্ছে, সে ব্যাপারে সাধারণ ক্রেতারা, বিশেষ করে তরুণরা এখন সচেতন।
গেরনি বলেন, সামাজিক মাধ্যম ব্যবহার করে আমরা টিইউসি থেকে প্রচারণা চালাচ্ছি। সাধারণ মানুষ এ সব কোম্পানিকে যোগাযোগ করে বলছে; দেখ, আমরা তোমাদের ক্রেতা। কিন্তু আমরা চাই এ কাপড়গুলো যেন ভালো পরিবেশে তৈরি করা হয়। বাংলাদেশে শ্রমিক অধিকার সম্পর্কে সচেতন থাকার জন্য ব্রিটিশ কোম্পানিগুলোর উপর চাপ আগে থেকেও ছিল। কিন্তু ২০১২ সালে তাজরিন ফাশনসে আগুনে শতাধিক শ্রমিকের মৃত্যুর পর চাপ বেড়ে যায়। তবে চলতি বছর এপ্রিল মাসে রানা প্লাজা ধসে এক হাজার ২২৮ জনের মৃত্যুর পর অনেক শ্রমিক এবং ভোক্তা সংগঠন সিদ্ধান্ত নেয় এ ধরনের ঘটনা আর ঘটতে দেয়া যাবে না। এ উপলব্ধি থেকেই জুলাই মাসের ৭ তারিখে দুটি আন্তর্জাতিক শ্রমিক সংগঠন এবং ৮৬টি কোম্পানি ‘বাংলাদেশ এ্যাকর্ড অন ফায়ার অ্যান্ড বিল্ডিং সেফটি’ সই করে। এ চুক্তি অনুযায়ী, বাংলাদেশের যেসব কারখানা থেকে তারা পোশাক আমদানি করে, সেগুলোর ভবনের নিরাপত্তা এবং অগ্নি নির্বাপক ব্যবস্থা যাচাই করা হবে।
তবে বাংলাদেশের জাতীয় গার্মেন্টস শ্রমিক ফেডারেশনের সভাপতি আমিরুল হক আমিন বলেন, আটটি বড় ব্রিটিশ কোম্পানি এ চুক্তিতে এখনো যোগ দেয়নি। তিনি মনে করেন, বাংলাদেশের গার্মেন্টস শ্রমিকদের কর্মস্থলকে নিরাপদ করতে ব্রিটেনের শ্রমিক আন্দোলন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। কারণ তারা ব্রিটেনের বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর উপর চাপ সৃষ্টি করতে পারে।
আমিরুল হক বলেন, যদি বাংলাদেশের গার্মেন্টস শিল্পে নিরাপদ কর্মস্থল নিশ্চিত করতে হয় এবং শ্রমিকদের বাঁচার মত মজুরী যদি নিশ্চিত করতে হয়, সেটার জন্য মূল দায়িত্ব নিতে হবে বহুজাতিক কোম্পানিগুলোকে। যারা বাংলাদেশ থেকে গার্মেন্টস সামগ্রী ক্রয় করে। আমিরুল হক ব্রিটেনে এসেছেন টিইউসি-র বিশেষ অতিথি হিসেবে, চলতি মাসের ৭-৮ তারিখে বোর্নমোথে তাদের বার্ষিক সম্মেলনে যোগ দিতে। সভাটির আয়োজন করেন লন্ডনের স্থানীয় সংসদ গ্রেটার লন্ডন এ্যাসেম্বলি বা জিএলএ’র সদস্য মুরাদ কুরেশি।
হক বলেন, তার ব্রিটেন সফরের লক্ষ্য হচ্ছে টিইউসি’র সাথে কাজ করা, যাতে সব ব্রিটিশ কোম্পানি এ চুক্তির আওতায় আসে। তার দ্বিতীয় লক্ষ্য হচ্ছে, টিইউসি যাতে এ কোম্পানিগুলোর উপর চাপ সৃষ্টি করে, যাতে তারা বাংলাদেশ থেকে কেনা গার্মেন্টস সামগ্রীর ন্যায্য মূল্য দেয়। টিইউসি’র স্যাম গেরিন আমিরুলের হকের সাথে একমত হয়ে বলেন, শ্রমিক ন্যায্য মজুরী না পাওয়ার পেছনে বড় বড় ব্র্যান্ডের অবদান রয়েছে।
তিনি বলেন, বড় বড় ব্র্যান্ডগুলো যদি সব সময় তৈরি পোশাক কম দামে কিনতে চায়, তাহলে সেই চাপ এসে পরে গার্মেন্টস কারখানা মালিকের উপর, আর তারা চাপ সৃষ্টি করে শ্রমিকের উপর। তিনি মনে করেন, ব্রিটেনের খুব কম মানুষই জানেন, যে দামে তৈরি পোশাক বড় বড় মার্কেটে বিক্রি হয়, তার মাত্র এক থেকে তিন শতাংশ যায় শ্রমিকের কাছে, যারা পোশাকটি তৈরি করেছে। কাজেই, আপনি শ্রমিককে ভাল মজুরী দিতে পারেন, কারখানা সংস্কার করে সেটাকে নিরাপদ করতে পারেন, তাতে খুব বেশি খরচ হবে না। এর ফলে বাজারে তৈরি পোশাকের দামে তেমন হের-ফের করবে না। হয়তো, প্রতি টি-শার্টের দাম দুই-এক পেন্স বেড়ে যাবে।
তবে স্যাম গেরিন পরিষ্কার জানিয়ে দেন , তারা তৈরি পোশাকের দাম দারুণভাবে বৃদ্ধি করার কথা বলছেন না। গেরিন বলেন, আমরা বলছি, কোম্পানিগুলো যারা তৈরি পোশাক কেনে, তারা যেন তাদের ব্যবসা পদ্ধতি পুনর্বিবেচনা করে এমন দামে কেনে, যাতে গার্মেন্টস কারখানার মালিক তার শ্রমিকদের ন্যায্য মজুরী দিতে পারে ।
টিইউসি-অন্তর্ভুক্ত শ্রমিক সংগঠনগুলোর তৎপরতার মূল লক্ষ্য হচ্ছে তাদের সদস্য এবং সাধারণ মানুষজনকে সচেতন এবং উদ্বুদ্ধ করা। তাদের এই কর্মসূচীর সাথে ব্রিটেন প্রবাসী বাংলাদেশীদেরও সম্পৃক্ত হওয়া উচিত বলে মনে করেন জিএলএ সদস্য মুরাদ কুরেশি। তিনি বলেন, প্রবাসীদের মধ্যে এ ধরনের সচেতনতা সৃষ্টি করাই সিটি হলের এ সভার একটি উদ্দেশ্য। মুরাদ কুরেশি বলেন, ভোক্তা হিসেবে প্রবাসীদের ক্ষমতা ব্যবহার করে কোম্পানিগুলোর কাছে সঠিক উদ্বেগগুলো তুলে ধরা সম্ভব। বাংলাদেশে গার্মেন্টস শ্রমিকদের কাজের পরিবেশ উন্নত করার লক্ষ্যে, এ দেশের শ্রমিক সংগঠনগুলোর আন্দোলনের সাথে শরিক হয়ে প্রবাসীরা উল্লেখযোগ্য অবদান রাখতে পারবে ।
তবে সবাই একমত, আমদানীকারী কোম্পানি এবং ব্র্যান্ডগুলোর বড় ভূমিকা থাকলেও, বাংলাদেশ সরকার এবং গার্মেন্টস রফতানীকারকদের সংগঠন বিজিএমইএ’র সহযোগিতা ছাড়া শিল্পে নিরাপত্তা বা পরিবেশ সৃষ্টি সম্ভব না। আমিরুল হক বলেন, ইউরোপীয় কোম্পানিগুলোর চুক্তিতে সরকার এবং বিজিএমইএ’র অংশ গ্রহণের যথেষ্ট সুযোগ আছে, বিশেষ করে উপদেষ্টা পরিষদে। অবশ্যই তাদের অংশগ্রহণ লাগবে ।
হক বলেন, বাংলাদেশে এত বড় একটি জিনিস হবে আর তাতে যদি বাংলাদেশ সরকার এবং বিজিএমইএ’র অংশ গ্রহণ না থাকে, তাহলে তো সেটা ফলপ্রসূ হবে না । তিনি জানান, সরকার এবং বিজিএমইএ সহযোগিতা করছে, কিন্তু তাদের কাছে আমাদের প্রত্যাশা অনেক বেশি। অর্থাৎ প্রত্যাশা অনুযায়ী সহযোগিতা পাচ্ছেন না? এ প্রশ্নের সরাসরি কোনো জবাব তিনি দেননি, তবে বলেন, তার মতে মূল দায়িত্ব আমদানীকারক কোম্পানিগুলোর হলেও, সরকারের ভূমিকা কম না। তিনি বলেন, তাদের কাছে আমাদের প্রত্যাশা আরো বেশি, যাতে ভষ্যিতে গার্মেন্টসের শ্রমিকরা সুন্দরভাবে জীবনযাপন করার মতো মজুরী পায়, এ ব্যাপারে সরকার এবং বিজিএমইএ’র দায়িত্ব আছে।
অন্যদিকে মুরাদ কুরেশি মনে করেন, বাংলাদেশ সরকারের উপর প্রভাব ফেলতে প্রবাসীরা ভূমিকা রাখতে পারে। ঢাকা থেকে প্রতি বছর রাজনীতিকরা লন্ডনে আসেন। প্রবাসীদের উচিত গার্মেন্টস সম্পর্কে তাদের উদ্বেগ তুলে ধরা। তিনি বলেন, প্রবাসীদের উচিত তাদের কাছে জানতে চাওয়া, তারা এ বিষয়ে কী করেছে। আপনি অন্য সব বিষয়ে আলাপ করতে পারেন কিন্তু মানুষের রুটি-রোজগারের বিষয় যেন ভুলে না যান। সূত্র : বিবিসি বাংলা

আরও পড়ুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও দেখুন...
Close
Back to top button