‘কওমি মাদরাসা শিক্ষা কর্তৃপক্ষ’ গঠনের বিপক্ষে আলেমদের ঐক্যবদ্ধ অবস্থান

ফয়েজ উল্লাহ ভূঁইয়া
সরকার কওমি মাদরাসাগুলোর ব্যবস্থাপনার লক্ষ্যে ‘বাংলাদেশ কওমি মাদরাসা শিক্ষা কর্তৃপক্ষ’ গঠনের যে উদ্যোগ নিয়েছে তার বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ অবস্থান নিয়েছেন দেশের সব কওমি আলেম। এ লক্ষ্যে সরকারের তৈরি খসড়া বিল সর্বসম্মতভাবে প্রত্যাখ্যান করেছেন শীর্ষ আলেমরা। বিলটি পর্যালোচনা করে তারা বলেছেন, এ বিল পাস হলে কওমি মাদরাসা পুরোপুরি সরকারের নিয়ন্ত্রণে চলে যাবে এবং মূলত কওমি মাদরাসাকে ধ্বংস করার জন্যই সরকার এ উদ্যোগ নিয়েছে। আলেমরা সরকারের এ উদ্যোগ প্রতিহত করতে ‘কওমি মাদরাসা সংরক্ষণ কমিটি’ নামে একটি উচ্চপর্যায়ের কমিটিও গঠন করেছেন। বর্তমানে করণীয় নিয়ে আলেমদের মধ্যে আলাপ-আলোচনা চলছে।
রাজধানীর মালিবাগের একটি মাদরাসায় গত সোমবার কওমি আলেমদের এক জরুরি সভায় সরকারি উদ্যোগকে প্রত্যাখ্যান করে ওই কমিটি গঠন করা হয়। সরকারের পক্ষ থেকে বাংলাদেশ কওমি মাদরাসা শিক্ষা বোর্ডের (বেফাক) কাছে মতামত জানতে চেয়ে দেয়া খসড়া বিলটি পর্যালোচনা করার পরই এ সিদ্ধান্ত নেন তারা। সরকার বিলটি সংসদে উত্থাপন করে পাসের উদ্যোগ নিতে চাইলে সারা দেশে তীব্র আন্দোলন গড়ে তোলার ব্যাপারেও সিদ্ধান্ত হয়েছে বলে বৈঠক সূত্রে জানা গেছে। প্রস্তাবিত বিলটিতে কওমি মাদরাসার সুষ্ঠু ব্যবস্থা এবং মূলধারার শিক্ষাব্যবস্থার সাথে সামঞ্জস্য রেখে শিক্ষাদানের লক্ষ্যেই আলোচ্য কর্তৃপক্ষ গঠন করার কথা বলা হয়েছে। কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যানসহ আট সদস্য ছাড়াও কওমি মাদরাসাগুলোর বোর্ড প্রধানদের সদস্য হিসেবে রাখার কথা বলা হয়েছে। চেয়ারম্যানসহ সব সদস্যই সরকার নিয়োগ দেবে। চেয়ারম্যানের যে যোগ্যতার উল্লেখ করা হয়েছে তাতে কওমি শিক্ষায় শিক্ষিত নন এমন ব্যক্তিকেও নিয়োগ দেয়ার সুযোগ থাকবে। কওমি আলেমরা কওমি মাদরাসার ওপর সরকারের যেকোনো হস্তক্ষেপ ছাড়া শুধু সনদের সরকারি স্বীকৃতির দাবি জানিয়ে আসছিলেন; কিন্তু এখন সরকার সংসদে যে বিল উত্থাপনের লক্ষ্যে খসড়া তৈরি করেছে তাতে সনদের কথাটি উল্লেখই নেই বলে বেফাক সংশ্লিষ্টরা জানান। মূলত কওমি শিক্ষার পুরো ব্যবস্থাপনা সরকারের নিয়ন্ত্রণে নেয়ার বিধানেরই প্রস্তাব রয়েছে বিলে।
গত ১৭ আগস্ট শিক্ষাসচিব কামাল আবদুল নাসের চৌধুরী বেফাকের মহাসচিবের নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধি দলের সাথে বৈঠক করে তাদের সরকারের ওই পদক্ষেপের কথা জানিয়ে বিলের একটি খসড়া কপি দেন। শিক্ষাসচিব বেফাকের কাছে বিলটির ব্যাপারে মতামত চান। তবে বেফাক প্রতিনিধিদল শিক্ষাসচিবকে মতামত দিতে অপারগতা প্রকাশ করলেও নিজেরা দেশের শীর্ষস্থানীয় সব কওমি আলেমদের নিয়ে জরুরি সভা করে বিলটি পর্যালোচনা করে প্রত্যাখ্যানের সিদ্ধান্ত নেন, যা গত সোমবার বৈঠকের পর প্রেস বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে জানানো হয়। একই বিজ্ঞপ্তিতে সভার সিদ্ধান্ত জানাতে গিয়ে ‘কওমি মাদরাসা শিক্ষা সংরক্ষণ কমিটি’ গঠনের কথাও জানানো হয়। বিলটির ব্যাপারে গোপনীয়তা রক্ষার অনুরোধ করা হলেও শেষ পর্যন্ত তা গোপন থাকেনি। নয়া দিগন্তে বিলটির ব্যাপারে সরকারের মতামত চাওয়ার বিষয়সহ বেফাকের আমেলার বৈঠকের ব্যাপারে আগাম রিপোর্ট প্রকাশিত হয়। বেফাক প্রথমে নির্বাহী কমিটির বৈঠকে খসড়া বিলটি নিয়ে আলোচনা করে পরে হাটহাজারী গিয়ে বেফাকের সভাপতি আল্লামা শাহ আহমদ শফীর সাথে দেখা করে তার মতামত নেন। তিনিই বেফাকের আমেলার সভা করে সিদ্ধান্ত নেয়ার পরামর্শ দেন। বেফাকের আহ্বানে গত সোমবারের সভাটি মূলত বেফাকের আমেলার ৫০ সদস্যকে নিয়ে হওয়ার কথা থাকলেও পরে বাইরে থাকা আঞ্চলিক কওমি শিক্ষা বোর্ডের কর্মকর্তাসহ সারা দেশে শীর্ষ কওমি আলেমদের অংশগ্রহণে অনুষ্ঠিত হয়। বেফাকের নেতারা ছাড়াও সভায় ইসলামিক রিচার্স সেন্টার বসুন্ধরার মুফতি আব্দুর রহমান, পটিয়া মাদরাসার প্রিন্সিপাল মাওলানা আব্দুল হালিম বুখারী, চট্টগ্রাম দারুল মাআরিফের প্রিন্সিপাল মাওলানা সুলতান যওক উপস্থিত ছিলেন।
বেফাকের মহাসচিব মাওলানা আব্দুল জব্বার ওই বিলসহ কওমি সনদের ব্যাপারে বলেছেন, কওমি মাদরাসার সনদের স্বীকৃতি চেয়েছিলাম; কিন্তু সরকার কওমি মাদরসাকে আষ্টেপৃষ্টে বাঁধার পদক্ষেপ নিয়ে স্বীকৃতি দিতে চাইলে তা আমরা নেবো না। কওমি মাদরসার ঐতিহ্য ধ্বংস করে, সিলেবাস পরিবর্তনে সরকারের হাতে তুলে দেয়ার বিনিময়ে কোনো সনদ চাই না। কওমি আলেমরা আগে কওমি সনদের স্বীকৃতির ব্যাপারে দাবি জানিয়ে আসছিলেন। তারই পরিপ্রেক্ষিতে সরকার গত বছর কওমি শিক্ষা কমিশন গঠন করেছিল। ২০১২ সালের ১৫ এপ্রিল বেফাকের সভাপতি আল্লামা শফীকে চেয়ারম্যান করে ১৭ সদস্যের ওই কমিশন গঠন করে সরকার। তবে আল্লামা শফীসহ বেফাক সংশ্লিষ্ট সদস্যরা কমিশন থেকে সরে আসেন। পরে সরকার সমর্থিত আলেম হিসেবে পরিচিত কমিশনের কো-চেয়ারম্যান মাওলানা ফরিদ উদ্দিন মাসউদ ও সদস্যসচিব মাওলানা রুহুল আমিন কমিশনের কার্যক্রম চালিয়ে যান। তারা প্রায় এক বছরের মাথায় গত ১৩ এপ্রিল শনিবার প্রধানমন্ত্রীর কাছে একটি সুপারিশ পেশ করেন।
খসড়া বিলে যা আছে: ‘বাংলাদেশ কওমি মাদরাসা শিক্ষা কর্তৃপক্ষ আইন-২০১৩’ খসড়া বিলের শুরুতে বলা হয়েছে, যেহেতু কওমি মাদরাসার সুষ্ঠু এবং মূলধারার শিক্ষাব্যবস্থার সাথে সামঞ্জস্য রেখে শিক্ষাদানের বিষয়ে একটি কওমি মাদরাসা শিক্ষা কর্তৃপক্ষ প্রতিষ্ঠা এবং তৎসম্পর্কিত বিধান করা সমীচীন ও প্রয়োজন সেহেতু এতদ্বারা নিম্নরূপ আইন করা হলো। আইনের ধারা-৩(১) এ বলা হয়েছে, এ আইন বলবৎ হওয়ার পর সরকার শিগগির সম্ভব, এ আইনের উদ্দেশ্য পূরণকল্পে, সরকারি গেজেট প্রজ্ঞাপন দ্বারা ‘বাংলাদেশ মাদরাসা কওমি শিক্ষা কর্তৃপক্ষ’ নামে একটি কর্তৃপক্ষ প্রতিষ্ঠা করবে। বিলের ৫ ধারায় কর্তৃপক্ষ গঠনের বিষয় বলা হয়েছে। এতে চেয়ারম্যানের পর সদস্য হিসেবে যারা থাকবেন তাদের ব্যাপারে বলা হয়েছে, কওমি শিক্ষা ক্ষেত্রে শীর্ষস্থানীয় আলেম পাঁচজন, মহিলা কওমি মাদরাসার প্রতিনিধি একজন, সরকারের নিয়োগকৃত সদস্য একজন যুগ্ম সচিব বা তদূর্ধ্ব পদমর্যাদার, পদাধিকার বলে কওমি মাদরাসা বোর্ডগুলোর প্রধানরাও পদাধিকার বলে কর্তৃপক্ষের সচিব। ধারা-৬ এ চেয়ারম্যান ও সদস্যদের নিয়োগের ব্যাপারে বলা হয়েছে, কওমি শিক্ষা, ইসলামি শিক্ষা ও সংস্কৃতি, আরবি ভাষা ও সাহিত্য, প্রশাসন ও ব্যবস্থাপনায় অভিজ্ঞ ব্যক্তিদের মধ্য থেকে চেয়ারম্যান এবং অন্য সদস্যরা সরকার কর্তৃক নিযুক্ত হবেন। ধারা-৯ এ প্রস্তাবিত কওমি মাদরাসা কর্তৃপক্ষের ক্ষমতা ও কার্যাবলী নির্ধারণ করে দেয়া হয়েছে। ১৪টি মৌলিক কাজের ক্ষমতা দেয়া হয়েছে। উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হলো বাংলাদেশ কওমি মাদরাসা শিক্ষা কর্র্তৃপক্ষের কার্যাবলী সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা, কওমি বোর্ডগুলোর কার্যক্রম পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন; কওমি মাদরাসাগুলোর পরিদর্শন পদ্ধতি নির্ধারণ; কওমি মাদরাসাগুলোর সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা ও পরিচালনার লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় নীতিমালা প্রণয়ন; কওমি মাদরাসা শিক্ষা কর্তৃপক্ষ চারটি স্তরের- ইবতেদাইয়্যাহ ( প্রাথমিক), মওতাওয়াসসিতাহ (নিম্ন মাধ্যমিক), সানাবিয়্যাহ আম্মাহ (এসএসসি), সানাবিয়্যাহ খাসসাহ (এইচএসসি)- কার্যক্রম পরিচালনার জন্য কওমি বোর্ডগুলো প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দেবে; পৃথক কওমি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত না হওয়া পর্যন্ত কর্তৃপক্ষ কওমি উচ্চশিক্ষার দুটি স্তর মারহালাতুল ফজিলত (স্নাতক সম্মান) ও মারহালাতুত তাকমিল (দাওরা-ই-হাদিস) স্নাতকোত্তর পর্যায়ের মাদরাসাগুলোর অ্যাফিলিয়েটিং অথরিটি হিসেবে কার্যক্রম পরিচালনা করবে; কওমি শিক্ষার মান উন্নয়নে কওমি মাদরাসা স্থাপন, প্রয়োজনীয় ভৌত অবকাঠামো নির্মাণ ও উন্নয়ন কার্যক্রম পরিচালনা ও এ সংক্রান্ত প্রতিবেদন সরকারের কাছে প্রেরণ; কওমি মাদরাসা শিক্ষার জন্য যুগোপযোগী পাঠ্যক্রম নির্ধারণ করা; কওমি মাদরাসা শিক্ষায় জ্ঞানের বিকাশ, বিস্তার ও অগ্রগতির লক্ষ্যে শিক্ষাদান ও গবেষণার ব্যবস্থা করা। ধারা-১১ এ সচিব এর ব্যাপারে বলা হয়েছে, কর্তৃপক্ষের সচিব সরকার কর্তৃক নিযুক্ত হবেন। সচিব কর্তৃপক্ষের সার্বক্ষণিক মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা হবেন এ আইনের বিধানাবলী সাপেক্ষে সরকার কর্তৃক নির্দেশিত কার্যাবলী সম্পাদন, ক্ষমতা প্রয়োগ ও দায়িত্ব সম্পাদন করবেন। ধারা-২০-এ বলা হয়েছে, এ আইন প্রবর্তনের অব্যবহিত পূর্বে যেসব কওমি মাদরাসা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে তা পূর্ববৎ বহাল থাকবে এবং কর্তৃপক্ষ কর্তৃক তাদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য আইনকানুন পরিবর্তিত হওয়া পর্যন্ত জনবল সম্পর্কিত নিয়োগ ও পদোন্নতির শর্তাবলি অপরিবর্তনীয় থাকবে। বিলটি আগামী ১২ সেপ্টেম্বর সংসদ অধিবেশনে উত্থাপন করা হতে পারে। শিক্ষাসচিব বেফাক প্রতিনিধিদলকে বিলটি আসন্ন অধিবেশনে উত্থাপন ও পাস হওয়ার কথা জানিয়েছেন বলে জানা গেছে।

আরও পড়ুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button