অনন্য বৈশিষ্ট্যে সমুজ্জ্বল সাহেব কেবলা ফুলতলী (রহ:)
এ এম এম বাহাউদ্দীন: বাংলাদেশে ইসলাম প্রচারিত হয়েছে পীর, আওলিয়া ও উলামা মাশায়েখের মাধ্যমে। যারা মহানবী (সা:) এর অনুপম আদর্শ ও সুন্দরতম আখলাক নিজেদের মধ্যে লালন করতেন। মানুষের কল্যাণে একনিষ্ঠভাবে কাজ করতেন। সমাজ ও মানবতার কল্যাণে নিজেদের জীবনকে বিলিয়ে দিতেন। এসব বুযুর্গেরা আধ্যাত্মিক শক্তির বলেই জাহেলিয়্যাত পরাজিত হয়। স্বর্ণযুগের এসব ওলি-দরবেশের মধ্যে একটি উজ্জ্বল নিদর্শন ছিলেন ওলিয়ে কামিল সাহেব কিবলা ফুলতলী শামছুল উলামা হযরত আল্লামা আবদুল লতিফ চৌধুরী ফুলতলী (রহ:) (১৯১৩-২০০৮)। তিনি বাল্য বয়সেই দ্বীনি শিক্ষা অর্জন করার পাশাপাশি আধ্যাত্মিক শিক্ষার প্রতি অনুরাগী ছিলেন। কেবল গতানুগতিক আলেম বা পীরের মতো কাজ করেন নি। তিনি আল্লাহর নৈকট্য লাভের জন্য ইবাদত বন্দেগী, তসবিহ তাহলিল, জিকির মুরাকাবা পাশাপাশি সৃষ্টির সেবাকে বিশেষ গুরুত্ব দিতেন। এজন্য তার অবদান তার চলে যাওয়ার পরেও পত্র-পল্লবে বিকশিত হচ্ছে। শুধু তাই নয়, তার কিরাত পদ্ধতির ফলে সৃষ্ট লাখো ছাত্র, দ্বীনি উচ্চ শিক্ষার মাধ্যমে তৈরি শত সহস্র শিষ্য ও আধ্যাত্মিক দীক্ষাপ্রাপ্ত অসংখ্য মুরিদ ছাড়াও তার রয়েছে ঔরসজাত নেক সন্তান। যা একজন মানুষের পরকালীন অব্যাহত মর্যাদা বৃদ্ধির অন্যতম কারণ হয়ে থাকে। দুনিয়াতেও যারা তার মিশনকে অগ্রসর করেন। এদিক দিয়ে সাহেব কিবলা ফুলতলী (রহ:) অনন্য। তার সন্তানদের মধ্যে সবাই উল্লেখযোগ্য। হযরত আল্লামা মোহাম্মদ ইমাদউদ্দিন চৌধুরী, হযরত আল্লামা মোহাম্মদ নজমুদ্দীন চৌধুরী, হযরত মাওলানা মোহাম্মদ শিহাবউদ্দিন চৌধুরী, মুফতি মাওলানা মোহাম্মদ গিয়াসউদ্দীন চৌধুরী, মাওলানা মোহাম্মদ কমরউদ্দীন চৌধুরী, হাফিজ মাওলানা মোহাম্মদ ফখরউদ্দীন চৌধুরী ও মাওলানা মোহাম্মদ হুছামুদ্দীন চৌধুরী। সাহেব কিবলা ফুলতলী কেবল সিলেট অঞ্চলেই দ্বীনের খেদমত, সমাজকল্যাণ ও মানব উন্নয়ন করেন নি দেশের বাইরেও তার কার্যক্রম বিস্তৃত ছিল।
যুক্তরাজ্যে কয়েকটি প্রতিষ্ঠান ও সংগঠন: হযরত আল্লামা ফুলতলী সাহেব কিবলা (রহ:) এর দ্বীনী খেদমতের পরিধি বাংলাদেশ, ভারত তথা সমগ্র উমহাদেশ ছাড়িয়ে সুদূর ইউরোপ, আমেরিকা পর্যন্ত বিস্তৃত হয়েছে। ইলমে কিরাত, ইলমে হাদিস, ইলমে তাসাওউফসহ সব ধরনের খেদমত পরিচালনার জন্য তিনি যুক্তরাজ্যে বহু সংখ্যক দ্বীনী প্রতিষ্ঠান ও সংগঠন প্রতিষ্ঠা করে গেছেন। আল্লামা ফুলতলী সাহেব কিবলা (রহ:) প্রতিষ্ঠিত এ সকল প্রতিষ্ঠান ও সংগঠন সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত আলোকপাত করা হলো।
দারুল হাদীস লতিফিয়া: হযরত আল্লামা সাহেব কিবলা (রহ:) ১৯৭৮ সালে সর্বপ্রথম বৃটেনে সফরকালে সে দেশে অভিবাসী মুসলিম সমাজের ভবিষ্যত প্রজন্মের কথা চিন্তা করে ইসলামী শিক্ষা বিস্তারে উদ্যোগী হন। সেই বছরই পূর্ব লন্ডনের নিউ রোডে ভাড়া করা ঘরে ‘মাদরাসায়ে দারুল কিরাত মাজিদিয়া’ নামে একটি মাদরাসা শুরু করেন। ১৯৮১ সালে ক্যানন স্ট্রিট রোড, লন্ডন ঊ-১ এর ফ্ল্যাট কিনে মাদরাসা স্থানান্তর করা হয়। তখনকার সময়ে লন্ডনে মসজিদ কেন্দ্রিক প্রাথমিক ইসলামী শিক্ষার ব্যবস্থা থাকলেও তা ছিল অত্যন্ত অপ্রতুল। ২০০৫ সালের নভেম্বর পর্যন্ত এখানেই এ প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম পরিচালিত হয়। ইতোমধ্যে প্রতিষ্ঠানটি মক্তব ও প্রাইমারী ইসলামী শিক্ষার গন্ডি পেরিয়ে সেকেন্ডারি স্কুল, কলেজ ও উচ্চতর ইসলামী শিক্ষার পর্যায়ে উন্নীত হয়। ক্যানন স্ট্রিট রোডের ‘মাদরাসায়ে দারুল কিরাত মজিদিয়া’য় কামিল (টাইটেল) ক্লাস পর্যন্ত শিক্ষাদানের ব্যবস্থা করা হলে ছাত্রদের স্থান সংকুলান অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়। তাই মাদরাসার জন্য বৃহত্তর পরিসরে ভবন ক্রয়ের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। এ লক্ষ্যে বেথনাল গ্রীনে একটি ভবন কেনার উদ্যোগ গ্রহণ করা হলে সাহেব কিবলা নিজে লন্ডনে গিয়ে তহবিল সংগ্রহের ব্যবস্থা করে দেন। ২০০৫ সালের ২৭ নভেম্বর শিক্ষক-ছাত্রদের সাথে নিয়ে বর্তমান ভবনটি তিনি উদ্বোধনও করেন। উচ্চতর ইসলামী শিক্ষার সুযোগ বৃদ্ধি তথা কামিল জামাত পর্যন্ত মাদরাসা উন্নীত হওয়ার কারণে নতুন আঙ্গিকে মাদরাসা কার্যক্রম শুরু হয়। এ সময় মাদরাসার নামকরণ করা হয় ‘দারুল হাদীস লতিফিয়া’। ইলম-আমল, তাহযীব-তামাদ্দুন এবং আদব আখলাকের বাস্তবসম্মত প্রশিক্ষণে আদর্শ মুসলিম গঠনের প্রত্যয় নিয়ে দারুল হাদীস লতিফিয়া তার কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে।
আনজুমানে আল ইসলাহ ইউকে: ইংল্যান্ডে অবস্থানরত মুসলিম সমাজকে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের আকীদা, আদর্শের উপর টিকিয়ে রাখা ও দ্বীনী খেদমত আনজাম দেওয়ার লক্ষ্যে ১৯৭৮ সালে আল্লামা ফুলতলী সাহেব কিবলা (রহ:) তার প্রথম বৃটেন সফরকালে গঠন করেন ‘আনজুমান আল ইসলাহ ইউকে’। বর্তমানে ইংল্যান্ডের প্রত্যেকটি বড় নগরে ‘আনজুমানে আল ইসলাহ’ এর শাখা রয়েছে।
লতিফিয়া উলামা সোসাইটি ইউকে: বৃটেনে বসবাসরত আহলে সুন্নাহ ওয়াল জামাতের উলামায়ে কিরামের একতা ও পারস্পরিক সহযোগিতার ভিত্তিতে দ্বীনী খেদমত আনজাম দেওয়ার মহান লক্ষ্য নিয়ে ১৯৮৭ সালের নভেম্বর মাসে হযরত আল্লামা ফুলতলী সাহেব কিবলা (রহ:) প্রতিষ্ঠা করেন ‘আল ইসলাহ উলামা সোসাইটি ইউকে’। হযরত আল্লামা ফুলতলী সাহেব কিবলা (রহ:) এর ইন্তিকাল পরবর্তী সময়ে এ সংগঠনের নামকরণ করা হয় ‘লতিফিয়া উলামা সোসাইটি ইউকে’।
লতিফিয়া কারী সোসাইটি ইউকে: আল্লামা ফুলতলী সাহেব কিবলা (রহ:) এর নিকট ইলমে কিরাতের সনদগ্রহণকারী বৃটেন প্রবাসীদের ঐক্যবদ্ধ রেখে তাদের মাধ্যমে সমাজের ইলমে কিরাতের খেদমত জারি রাখার লক্ষ্যে ১৯৯৩ সালের অক্টোবর মাসে তিনি প্রতিষ্ঠা করেন ‘লতিফিয়া কারী সোসাইটি ইউকে’। প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে এ সংগঠনটি ইংল্যান্ডের বিভিন্ন স্থানে কিরাত শিক্ষাকেন্দ্রগুলোর তত্ত্বাবধান ও সহযোগিতা করে আসছে।
আল ইসলাহ ইয়ুথ ফোরাম: বৃটেনের তরুণ ও যুব সমাজকে সঠিক ইসলামী চিন্তা ও চেতনায় উজ্জীবিত করে সংঘবদ্ধভাবে কাজ করার লক্ষ্যে ১৯৯৯ সালের অক্টোবর মাসে হযরত আল্লামা ফুলতলী সাহেব কিবলা (রহ:) গঠন করেন ‘আল ইসলাহ ইয়ুথ ফোরাম ইউকে’।
কিরাত প্রশিক্ষণ কেন্দ্র: হযরত আল্লামা ফুলতলী সাহেব কিবলা (রহ:) এর নির্দেশনায় এবং তাঁর নিকট থেকে কিরাত সনদপ্রাপ্ত কারী সাহেবগণের পরিচালনায় ইংল্যান্ডের বিভিন্ন স্থানে বিশুদ্ধ কোরআন তিলাওয়াত শিক্ষাদানের নিমিত্তে গড়ে উঠেছে অনেক কিরাত প্রশিক্ষণকেন্দ্র। দারুল কিরাত মাজিদিয়া ফুলতলী ট্রাস্টের সিলেবাস অনুসরণে এ সকল কেন্দ্রে কোরআন তিলাওয়াত শিক্ষা দেওয়া হয়। ইংল্যান্ডের অনেকগুলো শহরে এ সকল কিরাত প্রশিক্ষণ কেন্দ্র চালু রয়েছে।
বার্মিংহামে সিরাজাম মুনিরা জামে মসজিদ ও অ্যাডুকেশন সেন্টার: ফুলতলী ছাহেব কিবলার রুহানী আওলাদদের মাধ্যমে বার্মিংহামে সিরাজাম মুনিরা জামে মসজিদ ও অ্যাডুকেশন সেন্টার প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। এটি অনেক বড় একটি প্রতিষ্ঠান। ২০১৭ সালের মে মাসের শেষের দিকে এর উদ্বোধন করেছেন ওলিয়ে কামিল আলামা ইমাদ উদ্দিন চৌধুরী ফুলতলী। সুবৃহৎ এই প্রতিষ্ঠান মুসলমানদের ইমান-আকিদা ও ইসলামের প্রচার প্রসারে ভূমিকা রাখবে বলে আমার বিশ্বাস। এটি ফুলতলী সিলসিলার মানুষের জন্য সুখবর। আমি এই প্রতিষ্ঠানে গিয়েছি। ঘুরে ঘুরে প্রতিষ্ঠানটি দেখেছি। এই প্রতিষ্ঠানের কাজে ১.২ মিলিয়ন ডলার ব্যয় হয়েছে বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন। এর ফাউন্ডার হচ্ছেন উপমহাদেশের বিশিষ্ট ওলিয়ে কামিল আলামা ইমাদ উদ্দিন চৌধুরী ফুলতলী। যুক্তরাজ্যের বার্মিংহামের কভেন্ট্রি সড়কের ইয়াডলিতে আজদা শপিং মলের পাশে অবস্থিত মনোরম এই প্রতিষ্ঠানটির প্রথম তলায় মসজিদ এবং দু’তলা সম্পন্নের পর সেখানে আবাসিক কলেজ করা হবে। যার পাঠ্যসূচিতে বৃটিশ কারিকুলাম ও ইসলামিয়াত বিষয় থাকবে। মসজিদের পুরো কাজ শেষ হলে সেখানে একসাথে প্রায় ৫ হাজার মুসলি নামাজ আদায় করতে পারবেন।
ফুলতলী ইসলামিক সেন্টার কভেন্ট্রি ইউকে: কভেন্ট্রিতে ফুলতলী ইসলামিক সেন্টার নামে আরেকটি প্রতিষ্ঠান রয়েছে ফুলতলী সিলসিলার। এটি পরিচালনা করছে সিলসিলা ইসলামিক সোসাইটি ইউকে নামীয় সংগঠন। এটি অত্যন্ত সুন্দর জায়গায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এই প্রতিষ্ঠানে ছোট ছোট বাচ্চাদের সহিহ শুদ্ধভাবে কুরআন তেলাওয়াত শিখানো হয়। তাজবীদ শিক্ষা দেওয়া হয়। মিলাদ শরীফ পড়া হয় ও কসিদায়ে বুরদা শরীফের খতম হয়। প্রতিদিন ঘুম থেকে উঠে বাচ্চারা কুরআনের তেলাওয়াত দিয়ে দিনের শুরু করেন। যুক্তরাজ্যের মতো জায়গায় এরকম পরিবেশ খুবই কম। সব সময় এক নূরানী পরিবেশ বিরাজ করে। এর প্রিন্সিপাল বিশিষ্ট ইসলামি বক্তা মাওলানা আবুল হাসান।
লতিফিয়া ফুলতলী কমপ্লেক্স: লতিফিয়া ফুলতলী কমপ্লেক্স একটি বৃটিশ কারিকুলাম অনুসারে পরিচালিত মুসলিম স্কুল। প্রতিষ্ঠানটিতে আবাসিক ও অনাবাসিক ব্যবস্থা রয়েছে। এর প্রিন্সিপাল ফুলতলী ছাহেবের স্নেহধন্য মাওলানা এম এ কাদির আল হাসান। এর ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান হযরত আল্লামা মুফতি গিয়াসউদ্দিন চৌধুরী ফুলতলী। প্রতিষ্ঠানটি অনেক বড়। এর মাধ্যমে ব্রিটেনেও মুসলিম বাচ্চারা ইসলামিক পরিবেশে গড়ে উঠবে আমার বিশ্বাস।
আল মাজিদিয়া ইভিনিং মাদরাসা: হযরত আল্লামা ফুলতলী সাহেব কিবলা (রহ:) ইসলামী শিক্ষার নানাবিধ খেদমত আনজাম দিতে গঠন করেন ‘আল মাজিদিয়া ট্রাস্ট ইউকে’। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে অধ্যয়নরত কোমলমতি শিশুদের বিশুদ্ধ কোরআন তিলাওয়াত শিক্ষাদানের পাশাপাশি দ্বীনী প্রাথমিক শিক্ষায় পারদর্শী করে গড়ে তোলার লক্ষ্যে এ ট্রাস্টের অধীনে ‘আল মাজিদিয়া ইভিনিং মাদরাসা’ এবং ‘আল মাজিদিয়া উইকেন্ড ইভিনিং মাদরাসা’ প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে।
মসজিদ-মাদরাসা: হযরত আল্লামা ফুলতলী সাহেব কিবলা (রহ:) এর নির্দেশ, তত্ত্বাবধান, পৃষ্ঠপোষকতা, প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সহযোগিতা এবং তার মুরীদীন-মুহিব্বীনের উদ্যোগে ইংল্যান্ডের বিভিন্ন শহরে গড়ে উঠেছে অনেক মাদরাসা, মক্তব, মসজিদ ও ইসলামিক সেন্টার। কোনো শহরে মসজিদ, মক্তব প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ গ্রহণের সংবাদ শুনলেই হযরত আল্লামা ফুলতলী সাহেব কিবলা (রহ:) স্বয়ং উপস্থিত থেকে তহবিল সংগ্রহ করেছেন। উদ্যোক্তাদের উৎসাহ-অনুপ্রেরণা যুুগিয়েছেন। হযরত আল্লামা ফুলতলী সাহেব কিবলা (রহ:) এর উৎসাহ, অনুপ্রেরণা ও সহযোগিতার মাধ্যমে গড়ে উঠেছে ওল্ডহ্যাম জালালিয়া মাদরাসা, লতিফিয়া একাডেমী ওল্ডহ্যাম। সর্বশেষ ২০০৭ সালে বৃটেন সফরকালে তিনি ওল্ডহ্যামে একটি পূর্ণাঙ্গ মাদরাসা প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ অনুমোদন করেন। তার দোয়া, ইজাযত ও সহযোগিতায় লন্ডন, বার্মিংহাম, ম্যানচেস্টার, কার্ডিফ, টিপটপ, ওয়ালসল, ওল্ডহ্যাম, লুটনসহ সমগ্র ইংল্যান্ডের বিভিন্ন স্থানে গড়ে উঠেছে অনেক মসজিদ, মাদরাসা, মক্তব ও ইসলামিক সেন্টার। তাঁর ইন্তিকালের পরবর্তী সময়ে তার সুযোগ্য সাহেবজাদা ও শাগরিদগণ তার এ সকল খেদমতের ধারাবাহিকতা রক্ষায় প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। প্রতিষ্ঠা করছেন নতুন নতুন মাদরসা, মসজিদ, মক্তব ও ইসলামিক সেন্টার। শুধু ইউরোপ নয়, আমেরিকাসহ অন্য অনেক স্থানে এ ধারার বহু প্রতিষ্ঠান ও ইসলামিক সেন্টার ফুলতলী সিলসিলার প্রসারে কাজ করছে।
ফুলতলী হুজুরের বৈশিষ্ট্য অনেক। এরমধ্যে লক্ষ্যণীয় তার সমাজকর্ম। অন্য অনেক পীরের মতো তিনি দরবার স্থাপন করে অর্থ ও ক্ষমতা নিয়ে বসে থাকার পথ ধরেন নি। তিনি তার সকল অর্জনকে মানবতার সেবায় বিলিয়ে দিয়েছেন। তার প্রভাব তিনি কাজে লাগিয়েছেন কোরআন প্রচারে। দ্বীনী শিক্ষার প্রসারে। তার সরলতার নমুনা এখনো দেখা যায় তার উত্তরসূরী হযরত আল্লামা ইমাদ উদ্দিন চৌধুরী বর্তমান পীর সাহেব ফুলতলীর মধ্যে। তার অন্যান্য সন্তানদের মাঝেও তিনির দুনিয়া বিরাগী খেদমতের মানসিকতা। বর্তমান যুগে একজন প্রভাবশালী ও পুরনো আমল থেকে বহু সম্পদশালী একজন পীর এতোটা দুনিয়াবিমুখ হতে পারেন তা বর্তমান পীরসাহেব আল্লামা ইমাদ উদ্দিন চৌধুরীকে না দেখলে বুঝা যাবেনা। মনে হবে তিনি একজন আল্লাহর ধ্যানে সদা নিমজ্জিত ব্যক্তি। শুধু বিদেশে নয় দেশেও আদর্শ শিক্ষিত ও আদব কায়দা সংবলিত আলোকিত ঈমানদার যোগ্য, দক্ষ মানুষ তৈরির জন্য ফুলতলীর প্রয়াস প্রশংসনীয়। সিলেটে সাহেব কিবলা (রহ:) এর প্রতিষ্ঠিত দুটি অনার্স কোর্সসহ মাস্টার্স মানের কামিল মাদরাসা রয়েছে। আরো রয়েছে দেশব্যাপী ভবিষ্যৎ ইসলামী নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠার জন্য ‘আনজুমানে আল ইসলাহ’ নামের সংগঠন। যার দ্বারা তৈরি হচ্ছে আদর্শ ও কর্মবীর আলেম উলামা। লন্ডন সফরের সময় সেখানকার দায়িত্বশীলদের দেওয়া তথ্য মতে জানতে পেরেছি যে, বৃটেনে অন্তত ২৫০ মসজিদে ফুলতলী সাহেবের দীক্ষাপ্রাপ্ত ইমাম ও খতিব রয়েছেন। যার সংখ্যা দিনদিন বাড়ছে। তারা ফুলতলীর পীর সাহেবের হাতে গড়া। বর্তমান যুগে দুনিয়ার লোভ ছেড়ে শুধু দ্বীনী কাজ ও মানবকল্যাণকে নিজের জীবনের ব্রত হিসেবে গ্রহণ করা এসব ইমাম ও আলেম অতীতযুগের ইসলাম প্রচারক আউলিয়া দরবেশদেরই উত্তরসূরী। দুনিয়া যখন অর্থবিত্ত, ক্ষমতা ও ভোগবিলাসের পেছনে ছুটছে, যখন আরব শাসকরাও পথ হারাচ্ছে, যখন বহু খান্দানী পীর আউলিয়া ও খানকাহ দরবার পরিচালকদেরও পদস্খলন ঘটছে। তখন ফুলতলীর নীতি আদর্শ চোখে পড়ার মতো। হুজুরের নাতি আহমদ হাসান চৌধুরী শাহান এক প্রতিশ্রুতিশীল আলেম। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতার পাশাপশি ঢাকা হাইকোর্ট মাজার মসজিদের খতিব হিসেবে তার মেধা, প্রতিভা ও আধ্যাত্মিকতার সূচনা খুবই আশাপ্রদ। দাদার যোগ্য উত্তরসূরী হিসেবে আল্লাহ তাকে কবুল করুন। বৃটেনে যারা সাহেব কেবলা ফুলতলী (রহ:) এর মিশনকে এগিয়ে নিচ্ছেন তাদের মধ্যে সিরাজাম মুনিরা জামে মসজিদ ও অ্যাডুকেশন সেন্টারের পরিচালক মাওলানা হাফিয সাব্বির আহমদ, মাওলানা আবদুল কাদের সালেহ প্রমুখ উজ্জলমুখ পাশ্চাত্যে বাংলাদেশী ঐতিহ্যবাহী তরিকার প্রচারকরূপে পরিচিতি লাভ করেছেন।
ব্যক্তিগতভাবে আমি একটি ঐতিহ্যবাহী উলামা মাশায়েখ পরিবারের সন্তান। আমার দাদাজি হযরত আল্লামা শাহ মুহাম্মাদ ইয়াসিন (রহ:) ছিলেন ঐতিহাসিক ফুরফুরা দরবারের খলিফা। আমার পিতা হযরত মাওলানা এম এ মান্নান (রহ:) নিজেও ছিলেন আধ্যাত্মিক ব্যক্তিত্ব। ছোটবেলা থেকে দেশের বরেন্য উলামা মাশায়েখ ও পীর আউলিয়াদের মায়া মমতা ও আদর স্নেহে আমি বড় হয়েছি। নিজের জীবনও তাদের সান্নিধ্যে থেকে তাদের খেদমতের মধ্য দিয়ে কাটাচ্ছি। ঢাকায় খতিব উবায়দুল হক জালালাবাদী (রহ:) শায়খুল হাদীস আল্লামা আজিজুল হক (রহ:) ও বিশেষভাবে মাওলানা মোহাম্মদ আমিনুল ইসলাম (রহ:) আমাকে বেশী স্নেহ করতেন। শর্ষিনাসহ দেশের প্রখ্যাত সকল দরবারের পীর সাহেবান আমার খুবই নিকটের ও শ্রদ্ধাভাজন। তবে আমার ব্যক্তিগত জীবনে সাহেব কেবলা ফুলতলী রহ. এর স্নেহ ছায়া একটু ভিন্ন মাত্রার। ইসলামী আরবী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা আন্দোলনে যখন আমরা অনেকটাই দিকভ্রান্ত, কিংকর্তব্যবিমূঢ় তখন সকল ষড়যন্ত্র ও বাধা বিপত্তি মোকাবেলা করে এগিয়ে যাওয়ার সাহস দিয়েছেন তিনি। তার ঐতিহাসকি লংমার্চের ঘটনা আমি কোনোদিন ভুলবনা। তিনি প্রবল আধ্যাত্মিক ক্ষমতা ও আল্লাহ প্রদত্ত দূরদৃষ্টির অধিকারী ছিলেন। তার ইন্তেকালের সামান্য আগে তিনি যাদের সাথে কথাবার্তা বলেন তার মধ্যে আমিও একজন। যবান বন্ধ হয়ে যাওয়ার আগ পর্যন্তও তিনি ইসলামের কথাই ভেবেছেন। মোবাইলে সিলেট থেকে আমাকে বলেছেন, ‘বাহাউদ্দীন, তুমি কোনো চিন্তা করোনা। আল্লাহ তোমার সাথে আছেন। ইনশাআল্লাহ কেউই তোমার কোনো ক্ষতি করতে পারবে না।’ সম্ভবত এই ছিল তার শেষ কথাগুলির একটি। এই দোয়া ও আশ্বাসবাণী আমাকে অবিশ্বাস্য শক্তি ও সাহস যুগিয়েছে। আমি তার প্রতি কৃতজ্ঞ। তার উত্তরাধিকারী সকলের প্রতিও আমার আন্তরিক শুভেচ্ছা ও মোবারকবাদ। সাহেব কেবলা রহ. এর মিশন সামনে এগিয়ে নেওয়ার ক্ষেত্রে আল্লাহ আমাদের সবাইকে কবুল করুন।