যশোরের ভাসমান সেতু এখন দেশের অন্যতম পর্যটন আকর্ষণ
মোস্তফা রুহুল কুদ্দুস যশোর থেকে: যশোরের মনিরামপুর উপজেলার রাজগঞ্জে ঝাঁপা বাঁওড়ের উপর ভাসমান সেতু নির্মাণের পর দু’পাড়ের মানুষের আয় বেড়েছে। কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়েছে কিছু বেকার মানুষের। প্রতিদিন দূর-দূরান্ত থেকে আসা দর্শনার্থীদের ভিড়ে এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। যশোরের সাংবাদিকদের একটি প্রতিনিধিদল সেতু পরিদর্শনে গিয়ে এ দৃশ্য প্রত্যক্ষ করেন।
এর আগে যশোরের বৃহত্তম ঝাঁপা বাঁওড় পার হওয়ার একমাত্র বাহন ছিল নৌকা। দু’পাড়ের কর্মচারী, ছাত্র-ছাত্রী ও সাধারণ মানুষকে অনেক কষ্টে নৌকায় বাঁওড় পার হয়ে এপার-ওপার যাতায়াত করতে হতো। তাদের সমস্যা লাঘবে এলাকার ৬০ ব্যক্তি একত্রিত হয়ে স্থানীয় প্রযুক্তিতে ভাসমান সেতু নির্মাণের উদ্যোগ নেন। ‘ভাসমান সেতু’ তারই ফসল।
এক হাজার ৩শ’ ফুট দীর্ঘ এই সেতুর এক হাজার ফুটই প্লাস্টিকের ড্রাম দিয়ে নির্মিত। এতে ব্যবহৃত হয়েছে ৮শ’ ৩৯টি ড্রাম। ভাসমান ড্রামের ওপর স্টিলের সিট ফেলে নির্মাণ করা হয়েছে সেতু। দু’পাশে রয়েছে নিরাপত্তা রেলিং। সেতুটি পানির পর এমনভাবে ভেসে আছে যে, চলাচলের সময় যে কোন মানুষের মনে অন্যরকম রোমাঞ্চ সৃষ্টি হয়। কৌতুহলী মনে জাগ্রত হয় পানির ওপর দিয়ে হেঁটে যাওয়ার মতো অনুভূতি।
যশোর জেলা প্রশাসক আশারাফ উদ্দিন গত ২ জানুয়ারি সেতুটি উদ্বোধন করেন। নতুন প্রযুক্তির এই ভাসমান সেতুর খবর পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত হবার পর সারাদেশে ব্যাপক সাড়া পড়ে। যার প্রমাণ মেলে প্রতিদিন দেশের প্রত্যন্ত এলাকা থেকে আসা নারী-পুরুষের ভিড় দেখে।
সেতু পরিচালনা কমিটির সভাপতি মেহেদী হাসান টুটুল জানান, প্রতিদিন গড়ে ১০ হাজার মানুষ সেতু পরিদর্শনে আসছেন। সিলেট, ফেনীসহ দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে প্রায় প্রতিদিনই আসছেন অসংখ্য পরিবার ও পিকনিক পার্টি।
গতকাল বুধবার চৌগাছার আন্দারকোটা গ্রাম থেকে মোটরসাইকেলে আসেন শাওন ও উজ্জ্বলসহ ৮ তরুণ। মনিরামপুরের পূর্বাঞ্চলের মাছনা খানপুর থেকে ‘টিগার’ (স্থানীয় বাহন) ভাড়া করে আসেন গৃহবধূ আমেনা ও ইয়াসমিন। তারা জানান, ভাসমান সেতুর নাম কখনো শুনিনি। তাই দেখতে এলাম।
সেতুটি দেখার জন্যে মানুষের ভিড় বেড়ে যাওয়ায় দু’পাড়ের মানুষের আয়-উপার্জন বেড়েছে। পূর্বপাড়ের মসজিদ ও ঈদগাহ কমিটি দর্শনার্থীদের জন্যে গাড়ি রাখার ব্যবস্থা করেছে। মসজিদের একজন খাদেম আব্দুর রহিম জানান, গাড়ি হেফাজতে রাখার মাধ্যমে প্রতিদিন মসজিদে গড়ে ১৫শ’ টাকা এবং ঈদগাহে ১ থেকে ২ হাজার টাকা আয় হচ্ছে। আয়-উপার্জনের পথ পেয়েছে কিছু বেকার মানুষ। সেখানে হোটেল করে প্রথম দিন এক বিধবা মহিলা সাড়ে ৪ হাজার টাকার ফুচকা বিক্রি করেছেন। প্রতিদিন গড়ে বিক্রি হচ্ছে ১ হাজার টাকা। এ ধরনের বেশ কয়েকটি স্থায়ী হোটেল বসেছে দু’পাড়ে। ভাজা মুড়ি, ফল-ফলারি, খেলনাসহ নানা রকম দোকান বসেছে।
ফুলের রাজধানী গদখালী থেকে মাসুদ রানা এসে ছোটটো একটি টেবিল পেতে বিক্রি করছেন ফুল। তিনি জানালেন প্রতিদিন গড়ে তার ১ হাজার টাকার ফুল বিক্রি হচ্ছে। ৭শ’ থেকে ১৫শ টাকার খেলনা বিক্রি করছেন দুর্গাপদ। সব মিলিয়ে প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে অনেকের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করেছে এই সেতু।
এখানে পারাপারের জন্যে ৫ টাকা করে নেয়া হলেও তা নিয়ে কোন অঘটন বা চাঁদাবাজির খবর শোনা যায়নি। সেতুটিকে আরও আকর্ষণীয় করার পরিকল্পনা রয়েছে বলে জানান সেতু পরিচালনা কমিটির উপদেষ্টা ঝাঁপা ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান মফিজুর রহমান। তিনি বলেন, ইতিমধ্যে একটি পিকনিক স্পট গড়ে তোলা হয়েছে। সাধারণ সম্পাদক লিটন হোসেন বললেন, একটা ঝুঁকিপূর্ণ ও ব্যয়বহুল পদক্ষেপ নিয়ে প্রথমে বেশ শঙ্কিত ছিলাম। এখন মানুষের আগ্রহ দেখে খুবই উৎসাহিত হচ্ছি। মানুষের সহযোগিতাও পাচ্ছি।
সোমবার যশোরের সাংবাদিকদের একটি প্রতিনিধিদল সেতুটি পরিদর্শন করেন। পরিদর্শনকালে তারা বিভিন্ন শ্রেণি পেশার মানুষের সাথে কথা বলেন। সেতু পরিচালনা কমিটির সভাপতি মেহেদী হাসান টুটুল সাংবাদিকদের জানান, রাজগঞ্জ যশোরের একটি বড় মোকাম। উন্নয়ন অগ্রগতিতেও এটা পিছিয়ে নেই। অথচ, এর পাশের বৃহৎ জনপদ ঝাঁপা অনেক পিছিয়ে রয়েছে। ছোঁয়া লাগেনি উন্নয়নের। প্রধানত বাঁওড়ের কারণেই গ্রামটি একটা বিচ্ছিন্ন দ্বীপের মতো ছিল। কোন অপরাধ কর্মকা- ঘটলে রাজগঞ্জ থেকে আধা কিলোমিটার দূরে অবস্থিত ঝাঁপা গ্রামে পুলিশ পৌঁছাতে কয়েক ঘণ্টা সময় লাগতো। তার আগেই অপরাধীরা চলে যেত নাগালের বাইরে। এসব কথা বিবেচনা করে মানুষের যোগাযোগ ব্যবস্থা সহজ ও নিরাপদ করার পরিকল্পনা ঢোকে আমাদের মাথায়।
আজকের ভাসমান সেতু সেই স্বপ্নের ফসল। এতে পশ্চাদপদ ঝাঁপা অঞ্চলের মানুষের শিক্ষা, চিকিৎসা, নিরাপত্তা অনেকটা নিশ্চিত হবে। বাড়বে জীবনযাত্রার মান।