ফারাক্কা বাঁধ সম্পর্কে প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য বাস্তবতারই প্রতিফলন
সরদার আবদুর রহমান: ফারাক্কাসহ ভারতের দেয়া বিভিন্ন বাঁধের কারণে বাংলাদেশের নদীগুলোতে পানির প্রবাহ কমে গেছে বলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যে মন্তব্য করেছেন তাতে দেশের বাস্তবতারই প্রতিফলন ঘটেছে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। ভারত বাংলাদেশমুখী সবক’টি অভিন্ন নদীতে অসংখ্য প্রকল্প তৈরি করে নদীর স্বাভাবিক গতি ও প্রবাহ বাধাগ্রস্ত করে চলেছে। এই স্বাভাবিক গতি-প্রবাহ ফিরিয়ে না দেয়া পর্যন্ত নদী ভরাট হওয়া রোখা যাবে না। এজন্য নদীর মুখের সব বাঁধ খুলে দিতে হবে বলেও মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। তাঁদের মতে, চীন ব্রহ্মপুত্রে বাঁধ দেয়ার কথা উঠলে ভারত যেভাবে প্রতিক্রিয়া প্রদর্শন করে একইভাবে গঙ্গার ক্ষেত্রেও বাংলাদেশর জনগণও প্রতিক্রিয়া দেখিয়ে আসছে। কিন্তু তাতে কোন আমল দেয়া হয় না।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত ২৫ জানুয়ারি বৃহস্পতিবার যমুনা ও পদ্মার তীর স্থিরকরণ এবং ভূমি পুনরুদ্ধারে প্রস্তাবিত পাইলট প্রকল্পের রূপরেখা উপস্থাপন সংক্রান্ত এক বৈঠকে এই মন্তব্য করেন। প্রধানমন্ত্রী বলেন, ফারাক্কাসহ ভারতের দেয়া বিভিন্ন বাঁধের কারণে বাংলাদেশের নদীগুলোতে পানির প্রবাহ কমে গেছে। তিনি উল্লেখ করেন, বিশ্বজুড়েই যোগাযোগের সবচেয়ে সহজ ও সস্তা মাধ্যম হচ্ছে নৌপথ। এক সময় বাংলাদেশেও তাই ছিল। কিন্তু সময়ের সাথে সাথে হারিয়ে গেছে সেই পথ। আর অনেক নদীও এখন মৃতপ্রায়। কিন্তু ঠিক সময়ে ঠিক ব্যবস্থা নিলে এমনটা হতো না বলে মনে করেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেন, আমাদের যে নদীগুলো খরস্রোতা ছিল, যেমন ভারত যখন ফারাক্কা বাঁধ দিল, বিভিন্ন নদীতে বাঁধ দিল, তাতে আমাদের পানির ফ্লো (প্রবাহ) আগে যেভাবে ছিল সেভাবে সব জায়গায় নেই। কিন্তু পলি আসে, সিল আসে। এই সিল জমে জমে, পলি জমে জমে আমাদের নদীর অনেক ক্ষেত্রে নাব্যও হারিয়ে যায়।’ প্রধানমন্ত্রী নদীগুলোর স্বাভাবিক গতিপ্রবাহ বজায় রাখতে প্রতি বছর যথাসময়ে ড্রেজিং কার্যক্রম চালাতেও সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের নির্দেশ দেন।
শত-সহস্র বাঁধ-প্রকল্প: সরকার ও সরকারের সংশ্লিষ্ট সকল মহল এবং পানিসম্পদ বিষয়ে জ্ঞাত সকলেরই জানা যে, বাংলাদেশমুখি আন্তর্জাতিক নদীগুলোতে ভারত শত-সহস্র বাঁধ ও প্রকল্প নির্মাণ করে চলেছে। হিমালয় পর্বতমালা থেকে উৎপত্তি হওয়া নদীগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করে একতরফা পানি প্রত্যাহারের এক বিপুল কর্মপরিকল্পনা বাস্তবায়ন করে চলেছে ভারত। এর ফলে শুধু পদ্মা কিংবা যমুনা নয়, বাংলাদেশের সমস্ত নদীই ব্যাপকভাবে পানিশূন্য হয়ে পড়ছে। ‘গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্র-মেঘনা বেসিন’ বলে যে নদী-উপত্যকা বিরাজমান বাংলাদেশে তার অস্তিত্বই বিপন্ন হয়ে পড়তে চলেছে। একসময় তা মরুময় হয়ে পড়বে বলেও বিশেষজ্ঞদের আশংকা। প্রাপ্ত তথ্যে দেখা যায়, বাংলাদেশে প্রবাহিত কমপক্ষে ৫৪টি নদীর উৎস ভারতে অবস্থিত। এর প্রায় প্রত্যেকটিতেই ভারত বাঁধ নির্মাণ করেছে এবং তাদের অংশে এসব নদী-উপত্যকায় সেচ প্রকল্প বা বিদ্যুৎ প্রকল্প করেছে। এর ফলে এসব নদীর পানি প্রবাহ বাংলাদেশ অংশে সীমিত হয়ে পড়েছে। এসব নদী হলো, রায় মঙ্গল, ইছামতি-কালিন্দী, বেতনা-কোদালিয়া, ভৈরব-কপোতাক্ষ, মাথাভাঙ্গা, গঙ্গা, পাগলা, আত্রাই, পুনর্ভবা, তেতুলিয়া, টাঙ্গন, কুলিক, নাগর, মহানন্দা, ডাহুক, করতোয়া, তালমা, ঘোড়ামারা, দেওনাই-যমুনেশ্বরী, বুড়ি তিস্তা, তিস্তা, ধরলা, দুধকুমার, ব্রহ্মপুত্র, জিনজিরাম, চিলাখালি, ভোগাই, নিতাই, সোমেশ্বরী, যদুকাটা, ধামালিয়া, নোয়াগঞ্জ, ইউসিয়াম, ধলা, পিয়ান, সারিগোয়াইন, সুরমা, কুশিয়ারা, সোনাই বড়দাল, জুরি, মনু, ধলাই, লংগলা, খোয়াই, সুতাং, সোনাই, হাওড়া, বিজনী, সালদা, গোমতি, ফেনী-ডাকাতিয়া, সেলুনিয়া, মুহুরী ও ফেনী। এসব নদীর মধ্যে ভারত কর্র্তৃক নির্মিত বৃহদাকার প্রকল্পের মধ্যে আছে, গঙ্গায় ফারাক্কা বাঁধ, মহানন্দায় মহানন্দা বাঁধ, তিস্তা নদীতে তিস্তা বাঁধ, মনু নদীতে মনু বাঁধ, খোয়াই নদীতে খোয়াই বাঁধ, গোমতি নদীতে মহারাণী বাঁধ, মুহুরী নদীতে কালনি বাঁধ, বরাক নদীতে টিপাইমুখ বাঁধ প্রভৃতি।
ভারত পদ্মা-যমুনা বেসিনে যে অসংখ্য মূল সেচ ও বিদ্যুৎ অবকাঠামো নির্মাণ করছে তার প্রতিক্রিয়ায় বাংলাদেশের শত শত নদী ও খালবিল পর্যায়ক্রমে পানিশূন্য হয়ে পড়ছে। এর প্রতিক্রিয়ায় এমনকি মেঘনা ও তার শাখাগুলোও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এর ফলে বাংলাদেশের মধ্যাঞ্চলের কিছু এলাকা ছাড়া বাকি বৃহত্তর রাজশাহী, খুলনা, ঢাকা ও সিলেট অঞ্চলের প্রায় ৩০টি জেলার ৭০ হাজার বর্গকিলোমিটার এলাকার প্রায় ৭ কোটি অর্থাৎ মোট জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেক লোকই সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। লাখ লাখ হেক্টর কৃষি জমি হারাচ্ছে আবাদের যোগ্যতা। এই সকল প্রকল্প বাস্তবায়নের ফলে বাংলাদেশের উত্তর-পশ্চিম-দক্ষিণাঞ্চলের পদ্মা-ব্রহ্মপুত্র-যমুনা নদীর পুরো অববাহিকা এক সময় মরুভূমিতে পরিণত হওয়ার উপক্রম হয়েছে। বিশেষ করে এসব অঞ্চলের একদিকে চাঁপাইনবাবগঞ্জ, রাজশাহী, নাটোর, পাবনা, কুষ্টিয়া, রাজবাড়ি, ফরিদপুর, শরিয়তপুর, খুলনা, যশোর, সাতক্ষীরা এবং অন্যদিকে সিলেট, সুনামগঞ্জ, নীলফামারী, লালমনিরহাট, কুড়িগ্রাম, রংপুর ও গাইবান্ধা, বগুড়া, জামালপুর, মোমেনশাহী, টাঙ্গাইল, সিরাজগঞ্জ প্রভৃতি জেলার কৃষি, সেচ, মৎস্য ও নৌ যোগাযোগসহ প্রাকৃতিক পরিবেশ হবে বিপর্যস্ত। দেশে এ যাবত ফারাক্কা, তিস্তা ও টিপাইমুখ বাঁধ নিয়ে আলোচনা হলেও সামগ্রিক প্রকল্পগুলো সম্পর্কে তেমন কোন আলোচনা হচ্ছে না।
গঙ্গা বেসিনকে কেন্দ্র করে বৃহৎ প্রকল্প: বহুল আলোচিত ফারাক্কা ব্যারেজ ছাড়াও গঙ্গা বেসিনকে কেন্দ্র করে যে সকল বৃহৎ প্রকল্প বাস্তবায়িত হয়েছে এবং হচ্ছে তার মধ্যে রয়েছে, আপার গঙ্গা ক্যানেল প্রজেক্ট, মধ্য গঙ্গা ক্যানেল প্রজেক্ট, লোয়ার গঙ্গা ক্যানেল প্রজেক্ট, ইস্ট গঙ্গা ক্যানেল প্রজেক্ট, আগ্রা গঙ্গা ক্যানেল প্রজেক্ট, ইস্টার্ন ইয়ামুনা (যমুনা) ক্যানেল প্রজেক্ট, ওয়েস্টার্ন ইয়ামুনা (যমুনা) ক্যানেল প্রজেক্ট, বেতওয়া ক্যানেল প্রজেক্ট, ধাসান ক্যানেল প্রজেক্ট, কেন ক্যানেল প্রজেক্ট, ঘাগর ক্যানেল প্রজেক্ট, সারদা ক্যানেল প্রজেক্ট, তেহরি ড্যাম প্রজেক্ট, লাখওয়ার ড্যাম প্রজেক্ট, তপোবন ভিষ্ণুগড় প্রজেক্ট, রামগঙ্গা মালটিপারপাস প্রজেক্ট, ধালিপুর হাইড্রোপাওয়ার প্রজেক্ট, রাইহান্ড ড্যাম, চিলা হাইড্রোপাওয়ার প্রজেক্ট, তানাকপুর ব্যারেজ, কিসাউ ড্যাম, মানেরি ভালি হাইড্রোপাওয়ার প্রজেক্ট, খারা হাইড্রোপাওয়ার প্রজেক্ট, খোদরি হাইড্রোপাওয়ার প্রজেক্ট, ছোবরো হাইড্রোপাওয়ার প্রজেক্ট, রাজঘাট ড্যাম, হালালি ড্যাম, গান্ধি সাগর ড্যাম, রাণাপ্রতাপ সাগর ড্যাম, জাওহার সাগর ড্যাম, চম্বল ভ্যালি প্রজেক্ট, ওবরা ড্যাম, বনসাগর টোনস ড্যাম, পার্বতি ড্যাম, মাতাতিলা রিজার্ভার, রামসাগর ড্যাম, মাশানজোড় রিজার্ভার, ধাউলিগঙ্গা পাওয়ার প্রজেক্ট, তিলাইয়া ড্যাম, কনোর ড্যাম, মাইথোন ড্যাম, পানচেট ড্যাম।
ক্যানেল দিয়ে পানি প্রত্যাহার: ভারত ফারাক্কা বাঁধ ছাড়াও ফারাক্কার কাছাকাছি যে প্রকল্পগুলো নির্মাণ করেছে তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো, ভাগীরথী নদীর উপর জঙ্গিপুরের কাছে ৩৯ কিলোমিটার দীর্ঘ ফিডার ক্যানেল। জঙ্গিপুর ব্যারাজ নামের এই প্রকল্পের লক্ষ্যই হলো ফারাক্কা পয়েন্টের ৪০ হাজার কিউসেক পানি হুগলী ও ভাগীরথী নদীতে সরিয়ে নেয়া। এর ফলে একদিকে হুগলী নদীর নাব্য বৃদ্ধি পেয়ে কোলকাতা পোর্ট সারাবছর সচল থাকবে এবং অন্যদিকে ভাগীরথী নদীর বাড়তি পানি ব্যবহার করে বিস্তীর্ণ এলাকায় সেচ সুবিধা বৃদ্ধি করা যাবে। এখানেই শেষ নয়, ফারাক্কার উজানে উত্তর প্রদেশ রাজ্যের কানপুরে গঙ্গার ওপর আর একটি বাঁধ নির্মাণ করা হয়েছে। এতে ব্যয় হয়েছে প্রায় ৯৫০ কোটি রুপি। এছাড়া উত্তর প্রদেশ ও বিহারে সেচের জন্য প্রায় চারশত পয়েন্ট থেকে পানি সরিয়ে নেওয়া হচ্ছে। এসব পয়েন্ট থেকে হাজার হাজার কিউসেক পানি প্রত্যাহার করা হচ্ছে। পরিণতিতে ফারাক্কা পয়েন্টে পানির প্রবাহ যে কমে যাবে তা পানির মতোই পরিষ্কার। ফলে বাংলাদেশের হাজারো চিৎকার আর আহাজারি সত্ত্বেও ফারাক্কা পয়েন্টে পানি না থাকার ফলে বাংলাদেশ তার ‘ন্যায্য হিস্যা’ দূরে থাক সাধারণ চাহিদাটুকুও পূরণ করতে পারবে না। ভারত তার বহু সংখ্যক সেচ ও পানিবিদ্যুৎ প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য মূল গঙ্গা এবং এর উপনদীগুলোর ৯০ ভাগ পানি সরিয়ে নিচ্ছে। ফলে নদীতে পানি প্রবাহিত হতে পারছে মাত্র ১০ ভাগ। অন্যদিকে, আন্তর্জাতিক এই নদীতে বাঁধের পর বাঁধ দিয়ে প্রবাহ বাধাগ্রস্ত করার ফলে মূল গঙ্গা তার উৎসের কাছে হারিয়ে যেতে বসেছে। অর্ধশতাব্দীর মধ্যে গঙ্গা নদীর প্রবাহ ২০ ভাগ হ্রাস পেয়েছে। সব মিলিয়ে ভারতের নানা উচ্চাভিলাষি কর্মপরিকল্পনার শিকার হয়ে ভাটির দেশ বাংলাদেশ এক ভয়াবহ প্রাকৃতিক ও পরিবেশগত বিপর্যয়ের দিকে এগিয়ে চলেছে। শুধু ফারাক্কা নয়- গঙ্গা-পদ্মাকেন্দ্রিক বাঁধ, জলাধার, ক্রসড্যাম, রেগুলেটরসহ কমপক্ষে ৩৩টি মূল অবকাঠামো নির্মাণ করছে ভারত। এরসঙ্গে রয়েছে আনুষঙ্গিক আরো অসংখ্য ছোট-বড় কাঠামো। নতুন করে উত্তরাখণ্ডের রাজ্য সরকার ৫৩টি বিদ্যুৎ উৎপাদন প্রকল্প বাস্তবায়নের পরিকল্পনা নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে।
নদীসদৃশ ৬টি ক্যানেল প্রকল্প: ভারত নদীসদৃশ ৭টি ক্যানেল বা কৃত্রিম খাল প্রকল্পের মাধ্যমে হাজার হাজার কিউসেক পানি গঙ্গা থেকে সরিয়ে নিয়ে কয়েক লাখ হেক্টর জমিতে সেচ প্রদান করছে। তারা অনেক আগে থেকেই গঙ্গায় বৃহদাকার তিনটি খাল (ক্যানেল) প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছে। এর মধ্যে রয়েছে, ‘আপারগঙ্গা ক্যানেল প্রজেক্ট’, ‘মধ্যগঙ্গা ক্যানেল প্রজেক্ট’, ‘নি¤œগঙ্গা ক্যানেল প্রজেক্ট’, ‘পূর্ব গঙ্গা ক্যানেল প্রজেক্ট’, ‘মধ্যগঙ্গা ক্যানেল ২য় পর্যায়’ এবং ‘সমান্তরাল নিম্ন গঙ্গা ক্যানেল’। এ ধরনের প্রকল্পের হাজার হাজার কিলোমিটার খালের মাধ্যমে গঙ্গার পানি সরিয়ে নিয়ে সেচ দেবার ব্যাপক কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। ‘আপার গঙ্গা ক্যানেল প্রকল্পের’ মাধ্যমে উত্তর প্রদেশের ২৫ লাখ একর জমিতে সেচ দেয়ার লক্ষ্যে ৬ হাজার কিলোমিটারের বেশী খাল কেটে পদ্মার পানি সরিয়ে নেওয়া হচ্ছে। ‘মধ্যগঙ্গা ক্যানেল প্রজেক্ট’ নামের প্রকল্পে মূল ও শাখাসহ খননকৃত খালের মোট দৈর্ঘ্য প্রায় ১,৬০০ কিলোমিটার। ‘নিম্নগঙ্গা সেচ প্রকল্পের’ জন্য ৬ হাজার কিলোমিটার খালের মাধ্যমে গঙ্গার পানি সরিয়ে নেওয়া হচ্ছে। এভাবে এসব উৎসের শতকরা ৯০ ভাগ পানি সরিয়ে নেওয়া হচ্ছে। ফলে নদীতে মাত্র ১০ ভাগ পানি স্বাভাবিকভাবে প্রবাহিত হতে পারছে।
৬০টি নদীর অস্তিত্ব বিপন্ন: উজানে পানি প্রত্যাহার অব্যাহত থাকায় বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের অধিকাংশ নদী বছরের ৮/৯ মাসই থাকছে প্রবাহহীন। শাখা-প্রশাখা মিলে অন্তত ৫০টি নদীর তলদেশ বিস্তীর্ণ মরুসদৃশ বালুচরের দখলে। এই সঙ্গে সেতু, রেগুলেটর ও বাঁধের অপরিকল্পিত কার্যক্রমও সামগ্রিক পরিবেশের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিপন্ন হয়েছে আরো ১০টি নদী। গঙ্গায় ফারাক্কা বাঁধ দেবার পর গত কয়েকছরে নদীর স্বাভাবিক প্রবাহ প্রায় ৫৫ হাজার কিউসেক হ্রাস পেয়েছে। পরিসংখ্যানে দেখা যায়, শুকনো মৌসুমে ১৯৩৪ সাল থেকে ১৯৭৪ সাল পর্যন্ত হার্ডিঞ্জ পয়েন্টে পানির গড় প্রবাহ ছিল ১ লাখ ৫ হাজার কিউসেক, কিন্তু ফারাক্কা বাঁধ চালু করা মাত্র এই প্রবাহ ৭৪ হাজার কিউসেকে নেমে যায়। আবার ১৯৭৫-৭৬ সালের রেকর্ড থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত প্রবাহ হ্রাস পায় আরো ২৪ হাজার কিউসেক। পানির প্রবাহ প্রতিবছর গড়ে ১০০০ কিউসেক হারে এবং পানির উচ্চতা ১৪ সে.মি. থেকে ২০ সে.মি. হারে হ্রাস পেয়ে চলেছে। পদ্মায় শুকনো মওসুমে প্রায় ৪০০ কিলোমিটার জুড়ে চর পড়েছে।
নদীর উভয় প্রান্তের বাংলাদেশবর্তী ২০টি জেলার ৩২টি শাখা-উপশাখাও বিলুপ্তির কবলে। এসব নদীর মধ্যে আছে ছোটপদ্মা, গড়াই, মধুমতি, কালিগঙ্গা, পশুর, ভোলা, বড়দিয়া, কারিকুমার, হিসনা, সাগরখালি, চন্দনা, ভৈরব, ভদ্রা, কপোতাক্ষ, বৈতলা, কুমার, চিত্রা, বেগবতি, হরিহর, চিকনাই, নবগঙ্গা, মাথাভাঙ্গা, উছামতি, ধলাই, কাজলা, হুরাসাগর, বড়াল, আড়িখাল খাঁ, বেতর, নাগর, মরাবড়াল, মুসাখান প্রভৃতি। এসব নদী পদ্মার ধারা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। ফলে হয়ে যাচ্ছে ভরাট, নদী শুন্য হয়ে পড়ার উপক্রম হয়েছে এই অঞ্চলের প্রকৃতি।
এদিকে দেশের অন্যতম প্রধান নদী যমুনায় অসংখ্য চর পড়ায় এবং এর প্রবাহ মারাত্মকরকম হ্রাস পাবার ফলেও এর শাখা-উপশাখা নদীগুলি হারিয়ে যেতে বসেছে। যমুনায় প্রায় ২০০ কিলোমিটার ও শাখাগুলোর ১,৫০০ কিলোমিটার এলাকার দু’পাশের হাজার হাজার জনপদে পরিবেশ বিপর্যয় দেখা দিয়েছে। যমুনা সেতু যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি ঘটালেও এই সেতু নদীর প্রবাহকে থামিয়ে দিয়েছে। নদীর স্রোতধারা থেকে প্রাণ ফিরে পাওয়া নদীগুলোর অস্তিত্বও মুছে যাবার উপক্রম। এসব নদীর মধ্যে রয়েছে, পুরাতন ব্রহ্মপুত্র, করতোয়া, আত্রাই, বারনই, শিব, ছোট যমুনা, তিস্তা, ধরলা, তুলসীগঙ্গা, বাঙালী, নাগর, যমুনেশ্বরী প্রভৃতি। যমুনা সেতু নির্মাণের ফলে যে পরিবেশগত সমস্যা হবে তা দূর করার জন্য ১৪ কোটি টাকার প্রকল্প থাকলেও তা কেবল সেতুর পাশর্^বর্তী এলাকাজুড়ে বাস্তবায়িত হবে। কিন্তু সুদুর চিলমারী-রৌমারী থেকে শাহজাদপুর দৌলতপুর পর্যন্ত অঞ্চলের পরিবেশ রক্ষায় কোন ব্যবস্থা নেই। বিশ্বের পঞ্চম বৃহৎ যমুনা নদীর সুবিশাল বক্ষকে গাইড বাঁধের ডান্ডাবেড়ি পরিয়ে তার আকার ও প্রবাহকে এক সংকীর্ণ পরিসরে সীমাবদ্ধ করায় নদীর অস্তিত্ব বিপন্ন হয়ে পড়েছে।
চুক্তির হালচাল: ফারাক্কাকেন্দ্রিক ভারতের সঙ্গে একটি চুক্তি থাকলেও প্রতিদিন প্রতি কিস্তিতেই গঙ্গার ফারাক্কা পয়েন্টে পানিপ্রবাহ কমে যাচ্ছে। বারবার বাংলাদেশের পক্ষ থেকে তাগাদা দেয়া হলেও গঙ্গাচুক্তি অনুযায়ী পানি নিশ্চিত করছে না ভারত। বিশেষজ্ঞদের মতে, এমনিতেই গঙ্গার ফারাক্কা পয়েন্টে বাঁধ দিয়ে ব্যারাজ নির্মাণের কারণে নদীতে পানিপ্রবাহ কমে গেছে, তার ওপরে চুক্তি অনুযায়ী পানি না পেলে বাংলাদেশের ত্রাহি ত্রাহি অবস্থা হবে। তাদের মতে, গঙ্গাচুক্তি অনুযায়ী বাংলাদেশ যতটুকু পানি প্রাপ্য তা নিশ্চিত করা ভারতের কর্তব্য। তা না হলে শুষ্ক মওসুমে বাংলাদেশের গঙ্গা অববাহিকা এলাকায় পানির অভাবে কৃষি, পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্যে ভয়াবহ বিপর্যয় দেখা দেবে।
নদী গবেষক ও লেখক মাহবুব সিদ্দিকী বলেন, এ অঞ্চলের নদীর মধ্যে সবচেয়ে বেশি আলোচিত নাম ভারতে গঙ্গা আর বাংলাদেশে পদ্মা। পদ্মার রয়েছে একটি উপনদী মহানন্দা আর ৬০টিরও বেশি শাখা-প্রশাখা। অবশ্য বেশির ভাগ শাখা এখন বিলুপ্ত। ভারতের পানিনীতি আর এ অঞ্চলের মানুষের কাছে মরণব্াধ হিসেবে খ্যাত ‘ফারাক্কা ব্যারাজ’ গত সাড়ে চার দশকে পদ্মা ও এর শাখা-প্রশাখাগুলোর দফারফা করে ছেড়েছে। তিনি বলেন, ভারতের সঙ্গে যৌথ নদী কমিশনের বৈঠকে বাংলাদেশপক্ষ যথাযথভাবে নিজেদের সংকটের কথা তুলে ধরতে পারে না। স্বাভাবিক গতি-প্রবাহ না থাকলে নদীর ভরাট হওয়াও রোখা যাবে না। এজন্য নদীগুলোর স্বাভাবিক গতি ফিরিয়ে দিতে হবে। এজন্য একমাত্র উপায় হলো, সবগুলোর নদীর মুখ ও বুক থেকে প্রতিবন্ধকতা সরিয়ে ফেলা। মাহবুব সিদ্দিকী প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যকে ইতিবাচক হিসেবে উল্লেখ করলেও তিনি বলেন, নদী ড্রেজিং একটা সাময়িক কিন্তু অত্যন্ত ব্যয়বহুল সমাধান। যা বাংলাদেশের মত দেশের পক্ষে বহন করা সম্ভব হবে না। সংকট সৃষ্টিকারী ভারতকেই এর সমাধান দিতে হবে। তাঁর মতে, চীন ব্রহ্মপুত্রে বাঁধ দেয়ার কথা উঠলে ভারত যেভাবে প্রতিক্রিয়া প্রদর্শণ করে একইভাবে গঙ্গার ক্ষেত্রেও বাংলাদেশর জনগণও প্রতিক্রিয়া দেখিয়ে আসছে। কিন্তু তাতে কোন আমল দেয়া হয় না।