ঢাকার প্রাণে নতুন দোলা
উবায়দুর রহমান খান নদভী: পিঁপড়ের যেমন পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায় না, ঠিক তেমনই নিঃশব্দে আড়াই লাখের বেশী আলেম-উলামা, পীর-মাশায়েখ, মাদরাসা শিক্ষক ও প্রতিনিধি ২৭ জানুয়ারি ২০১৮ ঢাকা এসে ঘুরে গেলেন। কেউ ধারণাও করতে পারেনি এতো সংখ্যক ধর্মীয় ও সামাজিক নেতা জমিয়াতুল মোদার্রেছীন প্রধানের শর্ট নোটিশে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে এসে সমবেত হবেন। এরা কিন্তু তাদের সম্প্রদায়ের সব নন। এরা কেবল বাছাই করা প্রতিনিধির একাংশ। এশিয়ার বৃহত্তম একক মাদরাসা শিক্ষক সংগঠন জমিয়াতুল মোদার্রেছীনের সদস্য। যদি এরা সবাই চলে আসতেন তাহলে লোক হতো ৫ লাখ। সবাই গড়ে ২০ জন করে ভক্ত অনুসারী আনলে লোক হতো ২ কোটি। ২০ জন কেন বললাম, কারণ এখানে ছিলেন শর্ষীনার প্রতিনিধি, ফুলতলির পীর, চরমোনাইয়ের পীর, নেছারাবাদের পীর, কাগতিয়াসহ চট্টগ্রামের সব ঘরানার পীর-মাশায়েখ প্রতিনিধি, মৌকারার পীর, জৈনপুরী পীরসহ দেশের প্রতিটি খানকাহ ও দরবারের প্রতিনিধি। এদের প্রত্যেকের ভক্ত অনুসারী কি ২০ জন? গড়ে বলেছি ২০ জন করে। ২০ জন থেকে ২০ লাখ পর্যন্তও হতে পারে। আসলে কোনো ইস্যুতে আক্ষরিক অর্থেই কোটি কোটি মানুষ তাদের ডাকে রাজপথে নেমে আসতে পারে, এতে কোনো সন্দেহ নেই। সম্মেলনের সভাপতি জমিয়াতের সভাপতি দৈনিক ইনকিলাবের সম্পাদক যথার্থ বলেছেন, ‘আজকের এই মহাসম্মেলনই বাংলাদেশ।’ সংগঠনের মহাসচিব মাওলানা শাব্বীর আহমাদ মোমতাজী বলেছেন, ‘কোনো পোস্টার, লিফলেট, চিঠি নেই। কেবল সাংগঠনিক যোগাযোগের মাধ্যমে আজ দেশের প্রতিটি গ্রাম, ইউনিয়ন, উপজেলা, জেলা ও বিভাগ থেকে লাখো ডেলিগেট এখানে এসেছেন। প্রধানমন্ত্রী যদি কোনো শুভ বার্তা দিতে চান, লাখো উলামা-মাশায়েখের মাধ্যমে কোটি কোটি মানুষের সাথে কথা বলতে চান, তাহলে আমাদের সভাপতি বাহাউদ্দীন ভাইয়ের কাছে একটি টেলিফোনই যথেষ্ট। শাসক ও সরকার দেশবাসীকে বাদ দিয়ে চলে না, আর সিংহভাগ দেশবাসী এইসব আলেম-উলামা, পীর-মাশায়েখের আন্তরিক অনুসারী। জমিয়াতের মাধ্যমে তারা এখন অনন্য এক নেটওয়ার্কে ঐক্যবদ্ধ।’ উদ্বোধক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, ‘হাজার হাজার নয়, সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে আজ লাখো মানুষ।’ শিক্ষামন্ত্রীসহ অন্যান্য বক্তার কণ্ঠেও ছিল বিস্ময়ের চিহ্ন। মরহুম মাওলানা এম এ মান্নান যে স্বপ্ন দেখেছিলেন তা আজ বাস্তব। যিনি নানা মত ও পথের ধর্মীয় নেতৃত্বকে এক মোহনায় এনে জমা করতেন। দেশের শীর্ষ পীর-আউলিয়ার দোয়া নিয়ে তিনি হযরত খতীব উবায়দুল হক, শাইখুল হাদীস আল্লামা আজিজুল হক, মাওলানা মোহাম্মদ আমিনুল ইসলাম, মাওলানা মুহিউদ্দীন খান প্রমুখকে সাথে নিয়ে বলা চলে দীন ও দেশের সুরক্ষায় ঝাঁপিয়ে পড়তেন। মরহুম পিতার রূহানী ফয়েজ, দোয়া ও তাওয়াজ্জুহপ্রাপ্ত তাঁর সংগঠক সুপুত্র নির্ভুল নেতৃত্ব দিয়ে গোটা বাংলাদেশের ধর্মীয় আধ্যাত্মিক ও সামাজিক নেতৃত্বকে একটি সূতোয় গেঁথে ঐক্য ও শক্তিমত্তার ফুল ফুটিয়েছেন। যার সুরভি ২৭ তারিখ দেশের ওপর থেকে নিচ পর্যন্ত পৌঁছে গেছে। কয়েকবছর আগে এই কারিশম্যাটিক সংগঠক ইনকিলাব সম্পাদকের আহ্বানে বাংলাদেশে ইতিহাসের বৃহত্তম উলামা-মাশায়েখ ঐক্য সম্মেলন রাজধানীর উসমানী মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত হয়। যাতে উপস্থিত ছিলেন, খতিব উবায়দুল হক, সাহেব কেবলা ফুলতলী, শাইখুল হাদীস আল্লামা আজিজুল হক, আল্লামা আহমদ শফীর প্রতিনিধি, পীর সাহেব শর্ষীনা, পীর সাহেব চরমোনাই সৈয়দ মোহাম্মদ ফজলুল করিম, মুফতি ফজলুল হক আমিনী, প্রতিনিধি পটিয়া মাদরাসা, মাওলানা জালালউদ্দীন আল কাদেরী, পীর সাহেব নেছারাবাদসহ দেশের সব ঘরানার সকল ধর্মীয় নেতৃত্ব। যাদের অনেকেই আজ দুনিয়ায় বেঁচে নেই।
ট্রেন, বাস, গাড়ি ও লঞ্চযোগে টেকনাফ থেকে তেতুলিয়া আর রূপসা থেকে পাথুরিয়ার শিক্ষকরা (যারা পেশায় শিক্ষক হলেও ভিন্ন পরিচয়ে কেউ পীর, কেউ শাইখ, কেউ ইমাম, কেউ খতীব, কেউ সমাজকর্মী, কেউ মানবাধিকার কর্মী, কেউ কাজী, কেউ ওয়ায়েজ, কেউ বিকল্প চিকিৎসক, কেউ জনদরদী উপদেশক ইত্যাদিরূপে বিশাল জনপ্রিয় ও ব্যাপক জনঘনিষ্ঠ) যখন ঢাকায় এসে পৌঁছুতে শুরু করেন, তখন রাত আড়াইটা। শীত ও কুয়াশায় নূব্জ্য সোহরাওয়ার্দী উদ্যান যখন অন্ধকারের চাদর গায়ে কুঁকড়ে আছে, তখন তাহাজ্জুদ পার্টি এসে ঢুকে গেছে তার বুকে। কর্মীরা হতভম্ব। রাত তিনটায়ই ভেতরের গাড়ি পার্কিং ভরে গেছে। ফজর পর্যন্ত মৎস্য ভবন থেকে শাহবাগ, দোয়েল চত্বর থেকে হাইকোর্ট রাস্তার ধারে গাড়ির সারি। ন’টায় মহাসম্মেলন শুরু। লোকজন সাতটা আটটার মধ্যেই এসে গেছে। দশটার পর আর কেউ ঢুকতে পারেনি মাঠে। অনেকেই বহু দূর থেকে সম্মেলন পাবে না বলে ফিরতি পথ ধরেছে।
মঞ্চের পেছনে কিছুদূর গেলেই হাজি শাহবাজ মসজিদ। বনিক বেশে তিনি ছিলেন একজন দরবেশ। পারস্য থেকে এসে ঢাকায় বাড়ি করেছিলেন টঙ্গি ব্রিজের কাছে। নামাজ পড়তে আসতেন শাহবাগ। মূলত তিনি ছিলেন, তখনকার ঢাকার কুতুব। প্রতিদিন এতোটা পথ পাড়ি দিয়ে নামাজ পড়তে আসা, না মুসলিম মহানগরী ঢাকার আধ্যাত্মিক পাহারাদারী? যে মঞ্চে আজ দেশের বিপুল পীর-মাশায়েখ, এর ২০০ শ গজ দূরে শুয়ে আছেন হযরত শরফুদ্দিন চিশতী রহ.। পশ্চিমে এতোটা দূরেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় জামে মসজিদ। পাশে শোয়া জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম। অসিয়ত ছিল তার ‘‘মসজিদেরই পাশে আমায় কবর দিও ভাই, যেন গোরে থেকেও মুয়াজ্জিনের আযান শুনতে পাই।…. কত পীর আউলিয়া ফকিররে ভাই মসজিদের আঙ্গিনাতে, আল্লাহর নাম জিকির করে লুকিয়ে গভীর রাতে। আমি তাদের সাথে কেঁদে কেঁদে নাম জপতে চাই। আল্লাহর নাম জপতে চাই।’’ কবি কাজীর এই প্রত্যাশা ইদানিং কেন জানি বারবার বাস্তবায়িত হচ্ছে এই শাহবাগে। সম্প্রতি সোহরাওয়ার্দী উদ্যানেও অনেক দীনি সংগঠনের সভা, সমিতি হয়েছে। অনেক পীর-মাশায়েখ এখানে এসে জিকিরের মাহফিল করেছেন। সর্বশেষ ২৭ জানুয়ারি পূর্ব রাতের শেষ প্রহর থেকে মধ্যদুপুর পর্যন্ত এতো পরিমাণ ‘পীর আউলিয়া ফকির’ গভীর রাত থেকে লুকিয়ে আর দুপুর অবধি আকাশ বাতাস মুখরিত করে আল্লাহর নাম ও তার দীনের উচ্চকিত পয়গাম যেভাবে তুলে ধরলেন, আমি নিঃসন্দেহ, মরহুম কবি কাজী নজরুল ইসলাম এর রূহ এতে খুবই শান্তি পেয়েছে। কবির বাসনা মতো তার আত্মা আল্লাহর জিকিরে প্রশান্তি লাভ করেছে। ধীরে ধীরে যে বাংলাদেশ হাজার ষড়যন্ত্র ভেদ করে এগিয়ে যাচ্ছে ইসলামী রাষ্ট্র সমাজ ও সংস্কৃতির দিকে, এর একটি ঝলক ছিল এই মহাসম্মেলন। যদি অন্যান্য ব্যানারে সমবেত বাকী উলামা-মাশায়েখদের ইসলামের প্রয়োজনে ঐক্যবদ্ধ হয়ে রাস্তায় নামতে হয়, তাহলে আল্লাহ ও রাসুল সা. এর অভিন্ন কাজে তারা একে অপরের সাথী হবেন। এতে কোনো সন্দেহ নেই। জমিয়াতের সদস্য হিসাবে দেশের বহু আলেম এমনও ছিলেন, যারা কওমী ব্যাকগ্রাউন্ড থেকে আলীয়ায় এসেছেন। ব্যক্তিগত জীবনে যারা আল্লামা আহমদ শফী, আল্লামা আশরাফ আলী, আল্লামা মাহমুদুল হাসান প্রমুখ শাইখদের ভক্ত-মুরিদ, খলিফা ও মাজায। আল্লামা জুনাইদ বাবুনগরীসহ বিখ্যাত আলেমদের দোয়া নিয়ে ঢাকায় রওয়ানা হয়েছেন এমন আলেমও ছিলেন সমাবেশে। বিভিন্ন নদী যেমন সাগরে গিয়ে এক হয়ে যায়, তেমনই নানা স্রোতস্বিনী এক হয়ে সময়ে এসে মিশবে ইসলামের বিজয় মিছিলে। হাজার বছর ধরে বহমান সব নদী এক হবে আউলিয়াদের এঁকে দেওয়া মহাসমুদ্রে। খুব কষ্ট হয় একশ্রেণীর নেতা, বুদ্ধিজীবী ও অন্ধ মিডিয়া মালিকের জন্য। যারা ১০/১২ জনের মিটিংকে ক্যামেরা ও কলমে ‘বিশাল সমাবেশ’ বলে দেখান। দেশের দু’য়েকটি মিডিয়া সব জেনে শুনেও ঐতিহাসিক এ মহাসমাবেশটিকে সম্পূর্ণ গায়েব করে ফেলেছে। যেন কিছুই ঘটেনি। এদের সুমতি হোক। বাকী সব মিডিয়াকে অন্তর থেকে দোয়া করি, তাদের পেশাদারিত্ব ও সততার জন্য। পুলিশের ভাষ্য, ‘আমরা ভেবেছিলাম, ১৫/২০ হাজার মানুষ হবে। মানুষ হলো দুই আড়াই লাখ। আমাদের চেয়ার ছেড়ে দাঁড়াতেও হয়নি। স্বেচ্ছাসেবক আলেমরাই সব শৃঙ্খলা মেন্টেইন করেছেন।’ মিটিং শেষে সংশ্লিষ্টরা অনেকেই বলেছেন, ‘এখানে কি মানুষের সম্মেলন হয়েছে না কি আড়াই লাখ ফেরেশতা এসেছিলেন এখানে? একটু ময়লা নেই, এক টুকরো কাগজ নেই, নেই একটি সিগারেটের টুকরা। হইচই তো দূরের কথা। একটু ফিসফাস আওয়াজ বা কথাবার্তা পর্যন্ত নেই। নীরবে আলোচনা শোনা আর নিয়ম মেনে ফিরে যাওয়া। যেভাবে শেষ রাত থেকে নীরবে এসেছিলেন তারা জোহরের আগেই সেভাবে নিঃশব্দে চলে গেলেন। অসাধারণ এক জনসমাবেশ।’
বাংলাদেশের রাজধানী ‘ঢাকা’ আসলে কি দিয়ে ঢাকা? হাজার বছর আগে যখন কুসংস্কারাচ্ছন্ন ও উদ্ভ্রান্ত বঙ্গ সন্তানরা এখানে বাস করতো তখন ইসলামের উদার শান্তির বাণী নিয়ে যারা এখানে এসেছিলেন তারাই ‘ঢাকা’কে ঢেকে দিয়েছিলেন আল্লাহর রহমত দিয়ে। পীর-আউলিয়াদের হাতে আবাদ এই নগরী আল্লাহর রহমত দিয়ে ঢাকা। পাখতুন ভাষায় ‘ঢাকা’ অর্থ সেনা চৌকি। আসলেই ঢাকা ছিল সুলতানি আমলের সেনা চৌকি। রাজধানী সোনার গাঁ যাওয়ার আগে চারদিক নদী বেষ্টিত এ শহরের নাম ‘ঢাকা’ পীর-আউলিয়া ও দরবেশরাই দিয়েছেন। ঢাকার প্রাণকেন্দ্রে আটশ বছর আগে দীন প্রচারে এসে এখানেই জীবনশেষে ঘুমিয়ে আছেন খাজা শরফুদ্দিন চিশতী রহ., হাইকোর্টে তার মাজার। বঙ্গভবনের ভেতর ঘুমিয়ে আছেন জালাল দকিনী ও তার সাথী। দিলকুশায় শুয়ে আছেন বুতশিকান নেয়ামতুল্লাহ রহ.। পীর ইয়ামেনী, হযরত জারিফ শাহ, বাগে মুসায় খাজা ওয়ালী খান, মুসা খাঁ, সিদ্দীক বাজারে মুনাওওয়ার খাঁসহ কত শত পীর আউলিয়া শাসক ঢাকাকে আল্লাহর রহমত দিয়ে ঢেকে জিন্দা ও আবাদ করেছেন। এরা সবাই আজ ঢাকার বুকে চিরনিদ্রায় শায়িত।
ঢাকার নবাব সলিমুল্লাহ ছয়শ একর জায়গা দান করেছিলেন মুসলমানদের উন্নতি কল্পে। তাদের পারিবারিক বিনোদন উদ্যান শাহবাগ, পরীবাগ, রমনা ইত্যাদি পেয়েই শুরু হয়েছিল আধুনিক রেনেসাঁ। ১৯২১ সালে তার দেওয়া জায়গাতেই প্রতিষ্ঠিত হয় ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।’ উন্নয়ন ও নির্মাণে টাকা পয়সা ঢেলে দেন ঢাকার আশপাশের মুসলমান রাজা জমিদাররা। ধনবাড়ির নবাব নওয়াব আলী চৌধুরী বিশাল অবদান রাখেন। অনেক নারী তাদের মূল্যবান অলংকারাদি এজন্য দান করেছিলেন। অনেকে আবার শুরুতেই বাধা দিয়েছিলেন। বলেছিলেন, ‘এ বাংলায় বিশ্ববিদ্যালয় কেন? এরা পড়বে গিয়ে পশ্চিমবঙ্গে। তাছাড়া এদের এগ্রিকালচার ছাড়া কি আর কোনো কালচার আছে?’ এরপর যখন ঢাবি চালু হয়ে যায়, বিশ্বজুড়ে এর নাম ছড়িয়ে পড়ে, জ্ঞানী-গুনিরা এর নাম দেন ‘প্রাচ্যের অক্সফোর্ড।’ তখনও কিছু লোক ঠাট্টা করে বলতো, ‘এ যে মক্কা বিশ্ববিদ্যালয়!’ যেমন, আত্মপরিচয় হারা কিছু ‘অসুস্থ’ মানুষ আজও বলার চেষ্টা করে, ‘ঢাবিতে ৬০ ভাগ ছাত্রই এখন মাদরাসা থেকে আগত। ঢাবি কি তাহলে মাদরাসা হয়ে যাচ্ছে?’ এসব লোকের জানা নেই যে, ইংরেজ আসার আগে আমাদের জাতীয় শিক্ষা ছিল মাদরাসা শিক্ষা। দুনিয়ার সবকিছুই তখন মাদরাসায় পড়ানো হতো। মাদরাসাগুলোকেই ইংরেজরা স্কুল, কলেজে পরিণত করে। স্বাধীন মুসলিম শিক্ষা তুলে দিয়ে প্রবর্তন করে পরাধীন ইংরেজি শিক্ষা। যা দিয়ে মানুষ প্রকৃত শিক্ষিত হয় না। হয় ইংরেজদের অফিস চালানোর কেরানী। এ পরাধীনতা থেকে মুক্ত হয়ে স্বাধীন শিক্ষিত জাতি তৈরির জন্য মুসলমানরা রক্ত দিয়ে ঢাবি স্থাপন করেছিলেন। যারা তখন ঠাট্টা করে একে মক্কা বিশ্ববিদ্যালয় বলতো, তারা যখন দেখলো এটি ‘প্রাচ্যের অক্সফোর্ড’ বলে স্বীকৃতি লাভ করেছে তখন তারাই একে বিশ্বের একটি বাজে বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিণত করার মিশন নিয়ে কাজে নামে। শুরু করে সন্ত্রাস, জালিয়াতি, যৌন হয়রানি, অপসংস্কৃতি চর্চা, শত্রুর দালালি ইত্যাদি। যার ফলে আজ বিশ্বের ভালো ৫০০ বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকায়ও ঢাবি নেই। মাদরাসার ছাত্ররা সব শর্ত পূরণ করে মেধার জোরে ঢাবিতে পড়তে এসে আবার সেই ‘রুগ্ন’ মানসিকতার লোকেদের গালি শুনছে। অথচ ঢাবি থেকেই এদেশের মানুষ স্বাধীনতা, স্বাতন্ত্র্য ও সম্মান লাভ করেছিল। ইনশাআল্লাহ, দীনদার নতুন প্রজন্মের মাধ্যমে ঢাকা আবার এ অঞ্চলের ১০০ কোটি মুসলমানের নেতৃত্ব দিবে। এর স্বাপ্নিক ও প্রতিষ্ঠাতাদের স্বপ্ন বাস্তবায়ন করবে। হিংসুকরা বারবার যে উদ্দেশ্য ও স্বপ্নকে বিপথে নিয়ে যেতে চেয়েছে, সচেতন মানুষ তা হতে দেয়নি।
স্বাধীনতার প্রায় ৫০ বছর হয় হয়। এখনও অনেকের চোখে ঢাকা ‘মসজিদ নগরী’ রূপে ভালো লাগে না। তারা নানা কায়দায় চায় এ পবিত্র শহরটিকে মূর্তিতে ঢেকে দিতে। ৯২ ভাগ মানুষের বিশ্বাস ও চেতনা, পীর আউলিয়া, দরবেশদের প্রেরণা এবং বাংলার স্বাধীনতার জন্য আজীবন সংগ্রামী ও শহিদ বীর শাসকদের ত্যাগ ইত্যাদি সবই মুছে দিয়ে কিছু মানুষ চায় ঢাকাকে গুরুত্বহীন করে রাখতে। পূর্ববঙ্গের ক্ষেত করে রাখতে। অন্যের পদানত করে রাখতে। ঢাকা যেন নিজের পরিচয়, গৌরব, সংস্কৃতি ও স্বকীয়তা নিয়ে টিকতে না পারে। মসজিদ নগরীর আযানের ধ্বনি ম্লান করে দিতে তাই এখানে নানাজন নানা ধ্বনি তুলে। ঈমানের বাগানে বসে স্বপ্ন দেখে নাস্তিক্যবাদের অরণ্য রচনার। তাওহীদের দুর্গে বসে জাল বুনে শিরকের। ঢাকার প্রাণ আহত হয়। মাঝে মাঝে ঢাকা বিষণ্ণ ও বিপন্ন হয়। কিন্তু তাই বলে দমে যায় না। মাথানত করে না। আবার প্রাণ ফিরে পায় তার স্থপতি, জনক, রূপকার ও অভিভাবকদের অভয়বাণী শুনে। তাদের আধ্যাত্মিক প্রহরায় ঢাকা নিরাপদবোধ করে। প্রাণ ফিরে পায় শান্তির সৈনিকদের পায়ের আওয়াজ শুনে। নতুন করে দোলা লাগে তার প্রাণে।
অন্তত নয়শ বছর আধ্যাত্মিক আবহে অবস্থিত এই উদ্যান ও এর আশপাশ বহু ঘটনার সাক্ষী। চারপাশে শত ওলীর পূত: নিঃশ্বাস, হৃদয় মথিত জিকির ও মোনাজাত, তাদের জীবন সাধনার অমর সুবাসে ছেয়ে আছে এখানকার আকাশ বাতাস। যেখান থেকে বাংলার স্বাধীনতা ও মুক্তির ডাক দিয়েছিলেন বাংলাদেশের স্থপতি। বলেছিলেন, ‘এদেশকে মুক্ত করে ছাড়বো ইনশাআল্লাহ।’ এর রেশ এখনো বাকী আছে বলেই এদেশের স্বাধীনতা ও মুক্তির সমকালীন প্রজন্ম তাদের প্রত্যয় ঘোষণা করে গেলেন সেই একই জায়গা থেকে। কিছুদিন আগে এখানেই মাত্র ২৫ হাজার লোকের সমাগম হয়। ভ্যাটিকান থেকে পোপ এসেছিলেন বাংলাদেশে। দুনিয়ার যত খ্রিষ্টান রাষ্ট্রের কূটনীতিক ঢাকায় আছেন সবাই এসেছিলেন সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে পোপের সাথে প্রার্থনায় যোগ দিতে। আমরা ধারণা করতে পারবো না ওই অনুষ্ঠানটি করতে কি পরিমাণ অর্থ ব্যয় হয়েছিল। বিশ্ব মিডিয়ায় সেটি কত বেশী গুরুত্ব পেয়েছিল। আমাদের রাষ্ট্র ও প্রশাসন সেটি নিয়ে কতটুকু সিরিয়াস ছিলেন। তবে বাংলাদেশের শীর্ষ ধর্মীয় ও আধ্যাত্মিক নেতৃবৃন্দের এই মহাসম্মেলন ধারণাতীত স্বল্পব্যয়ে, অসম্ভব নীরবতায়, অল্প প্রচারণায় যে নজির দেখিয়ে গেল তা বাংলাদেশের ইতিহাসে চির স্মরণীয় হয়ে থাকবে। এদেশ উলামা-মাশায়েখ ও ইসলামপ্রিয় যোগ্য নতুন প্রজন্ম যে আঙ্গিকে গড়ে তুলতে চায়, তার নমুনা দেশের প্রতিটি অঙ্গনে প্রতিদিন স্পষ্ট হয়ে উঠছে। শাহবাগ, পরীবাগ, ঢাবি, সোহরাওয়ার্দী উদ্যান, বঙ্গভবন, নিমতলী, গুলিস্তান, দিলকুশা, মতিঝিলের আকাশে যে আশার বাণী আযান হয়ে বাজে প্রতিদিন পাঁচবার। ইথারে কান পাতলে পীর-ফকির ও ওলী-দরবেশদের অভয় বাণী যেন তারই প্রতিধ্বনি। আর সারা বাংলার সেই পথিকৃত দলের নতুন অনুসারীরা ওই ধ্বনিরই অনুরণন শুনিয়ে গেলেন ২৭ তারিখ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে। যেন পাওয়া গেল সেই চিরচেনা সুরভি। সেই চিরায়ত শব্দলহরি। ঢাকায় লাগলো নতুন প্রাণের দোলা।