অটোমান সাম্রাজ্যের গৌরব পুনরুদ্ধারের চেষ্টায় এরদোগান

Erduganতুরস্কের প্রেসিডেন্ট রজব তৈয়ব এরদোগান তার ক্ষমতার প্রথম দশ বছরে দেশটির সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক খাতে উল্লেখযোগ্য সংস্কার সাধনের উদ্যোগ নেন। বর্তমানে তিনি তার শাসন ব্যবস্থায় ইসলামি জাতীয়তাবাদকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার প্রদান করছেন। এজন্য সমালোচকদের অনেকেই মনে করেন তিনি হঠাৎ করেই ভিন্ন পথে হাঁটছেন এবং নিজের অর্জিত সমস্ত অর্জন ধারাবাহিকভাবে ধ্বংস করে দিচ্ছেন। যাই হোক, এসব কর্মের মাধ্যমে এরদোগান অটোমান সাম্রাজ্যের হারানো গৌরবকে পুনরুদ্ধার করতে চাচ্ছেন- তা অনুধাবন করা কষ্টকর নয়। উসমানীয় সাম্রাজ্য বা অটোমান সাম্রাজ্য ঐতিহাসিকভাবে তুর্কি সাম্রাজ্য বা তুরস্ক বলে পরিচিত। এটি ছিল একটি ইসলামি সাম্রাজ্য। ১২৯৯ সালে তুর্কি বংশোদ্ভূত প্রথম উসমান উত্তরপশ্চিম আনাতোলিযায এই সালতানাত প্রতিষ্ঠা করেন।
প্রথম মুরাদ কর্তৃক বলকান জযরে মাধ্যমে উসমানীয সাম্রাজ্য বহুমহাদেশীয সাম্রাজ্য হযে উঠে এবং খিলাফতের দাবিদার হয। ১৬শ’ ও ১৭শ’ শতাব্দীতে বিশেষত সুলতান প্রথম সুলাইমানের সময উসমানীয সাম্রাজ্য দক্ষিণ-পূর্ব ইউরোপ, পশ্চিম এশিয়া, ককেসাস, উত্তর আফ্রিকা ও হর্ন অব আফ্রিকা জুড়ে বিস্তৃত একটি শক্তিশালী বহুজাতিক, বহুভাষিক সাম্রাজ্য ছিল। ১৭শ শতাব্দীর শুরুতে সাম্রাজ্যে ৩২টি প্রদেশ ও বেশ কযকেটি অনুগত রাজ্য ছিল। এসবের কিছু পরে সাম্রাজ্যের সাথে একীভূত করে নেয়া হয় এবং বাকিগুলোকে কিছুমাত্রায় স্বাযত্ত্বশাসন দেয়া হয়।
উসমানীয সাম্রাজ্য ছয শতাব্দী ধরে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের যোগাযোগের কেন্দ্র হিসেবে কাজ করেছে। তবে দীর্ঘদিনব্যাপী ইউরোপীয়দের তুলনায় সামরিক ক্ষেত্রে পিছিয়ে পড়ে। ধারাবাহিক অবনতির ফলে সাম্রাজ্য ভেঙে পড়ে এবং প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর সম্পূর্ণ বিলুপ্ত হয়ে যায়। এরপর আনাতোলিয়ায় নতুন প্রজাতন্ত্র হিসেবে আধুনিক তুরস্কের উদ্ভব হয। বলকান ও মধ্যপ্রাচ্যে সাম্রাজ্যের সাবেক অংশগুলো বিভিন্ন নতুন রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। উসমানীয় সাম্রাজ্যের একজন উত্তরসূরী হিসেবে এরদোগান যে একজন উচ্চাভিলাষী মানুষ তা কোনো গোপন বিষয় নয়। তিনি সুন্নি মুসলিম বিশ্বের নেতা হতে এবং অটোমান সাম্রাজ্যের হারানো ‘গৌরব’ পুনরুদ্ধারের স্বপ্ন দেখছেন। এই লক্ষ্যে তিনি মধ্যপ্রাচ্য ও ককেশাস অঞ্চলের কয়েকটি দেশের ওপর তুরস্কের ডানাকে প্রসারিত করার সব ধরনের প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছেন। দেশে ও বিদেশে তার কর্মের একটি ভাসাভাসা পর্যালোচনা করলেও অবিশ্বাস্যভাবে দেখা যায় যে, তিনি কেবল তার ব্যক্তি ইমেজকেই পুনরুজ্জীবিত করতে চাচ্ছেন না, বরং অদৃশ্য অটোমান সাম্রাজ্যের প্রভাবকেও ফিরিয়ে আনতে চাচ্ছেন। অটোমান যুগের মহিমাকে ফিরিয়ে আনেত তিনি বিভিন্ন দেশের সঙ্গে সক্রিয দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক তৈরির চেষ্টা করছেন। আঞ্চলিক প্রভাব প্রসারিত করার জন্য এরদোগান শুরুতেই অটোমানদের পদাঙ্ক অনুসরণ করে একটি একট্রাঅর্ডিনারি ব্যবস্থা গ্রহণের মাধ্যমে নিজের ক্ষমতাকে একচ্ছত্র করেছেন।
অটোমানদের পছন্দ পুনঃপ্রবর্তন করতে এরদোগান কাতার ও সোমালিয়াতে সামরিক ঘাঁটি স্থাপন করেছে এবং তিউনিসিয়ার সঙ্গে সামরিক সম্পর্ক স্থাপনের পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন। এখন তিনি কৌশলগতভাবে গুরুত্বপর্ণ সুদানী দ্বীপ ‘সুয়াকিনে’ আরেকটি সামরিক স্থাপনা নির্মাণের পরিকল্পনা করছেন। এরদোগান দ্বীপটিকে সামরিক বাহিনী হিসেবে ব্যবহার করতে চান, কারণ অটোমান যুগে এটি তাদের সামরিক ঘাঁটি ছিল।তুরস্কের চারপাশকে শত্রুমুক্ত করতে এরদোগান সিরিয়ার কুদি ওয়াইপিজি গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে সামরিক অভিযান পরিচালনা করছে। তিনি তার জনগণকে রক্ষা করতে সব সন্ত্রাসী গোষ্ঠীকে নির্মূল করার ঘোষণা দিয়েছেন। তবে,অনেকেই মনে করছে তার প্রকৃত লক্ষ্য হচ্ছে সিরিয়াতে একটি স্থায়ী ঘাঁটি স্থাপন করা, যা অটোমানরা একদা শাসন করেছিল। তার এসব কাজে মিশর ও সৌদি আরব বিশ্বাস করতে শুরু করেছে যে এরদোগানের সামরিক অগ্রগতি এ অঞ্চলের আঞ্চলিক ভারসাম্যকে উল্টে দেবে। বলকান অঞ্চলে তুরস্ক ধারাবাহিকভাবে তার বাণিজ্যিক ও সাংস্কৃতিক উপস্থিতি বৃদ্ধির চেষ্টা করছে; যা অটোমান শাসনের স্মৃতিকে জাগিয়ে তুলছে। ইউরোপের কাছে গ্যাস সরবরাহের জন্য তুরস্ক আলবেনিয়াতে ট্রান্স-অ্যাড্রিয়াটিক পাইপলাইন নির্মাণ করছে এবং তুর্কি একটি কনসোর্টিয়াম দেশটির দ্বিতীয় বিমানবন্দর নির্মাণের চেষ্টা করছে। তিনি কসোভোর অবকাঠামোতেও বিনিয়োগ করছেন। তুর্কি অর্থায়নে দেশটির একমাত্র আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর নির্মিত হচ্ছে। একই সঙ্গে তুরস্ক দেশটির জ্বালানি শক্তিকে পরিচালনা করছে। তুর্কি সহযোগিতা ও সমন্বয় সংস্থা (টিকা) শিল্প, কৃষি, অবকাঠামো, অর্থাযন, স্বাস্থ্যসেবা এবং শিক্ষা ক্ষেত্রে বালকান ও ককেশীয় দেশগুলোকে সহায়তা করছে। উপরন্তু, এরদোগান অন্যান্য প্রতিবেশী দেশে- আফগানিস্তান, আলবেনিয়া, জর্জিয়া এবং কসোভোর বিভিন্ন বিষয়ে হস্তক্ষেপ করছেন। তিনি তুরস্কের আঞ্চলিক প্রসারকে আরো সুদৃঢ় করতে এবং অটোমান সাম্রাজ্যের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে সংরক্ষণের লক্ষ্যে বিদেশি প্রকল্পগুলোতে বিপুল অর্থায়ন করছেন। তার স্বপ্ন তুরস্ককে একটি ইসলামি গণতন্ত্রের মডেল তৈরি করা এবং সে লক্ষ্যে অনেকটা পথ এগিয়েছেন। অটোমান শাসকদের ন্যায় তিনি তুরস্ককে একটি তাত্ত্বিক ইসলামিক রাষ্ট্রে রূপান্তরিত করছেন।
এরদোগান তার প্রভাবকে রাশিযার দিকেও সম্প্রসারিত করছেন। সম্প্রতি, তিনি এস-৪০০ এয়ার ডিফন্স সিস্টেম ক্রয় এবং তিনটি পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণে সহযোগিতা করার জন্য মস্কোর সঙ্গে একটি চুক্তিতে পৌঁছেছেন।তিনি মিয়ানমারে নিপীড়িত রোহিঙ্গা মুসলিমদের নির্যাতনের বিরুদ্ধে প্রথম প্রতিবাদী ভূমিকা পালন করেন। তিনি বিষয়টিকে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থায় তুলে ধরেন। তিনি ট্রাম্পের জেরুসালেমকে ইসরাইলের রাজধানীর স্বীকৃতির ঘোষণায় ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন এবং পাল্টা ব্যবস্থা হিসেবে ওআইসির বিশেষ বৈঠকের মাধ্যমে পূর্ব জেরুসালেমকে ফিলিস্তিনের রাজধানীর স্বীকৃতি দেন এবং মুসলিম বিশ্বসহ বিশ্ব সম্প্রদায়কে স্বীকৃতি দেয়ার জন্য আহ্বান জানান। তার এসব ভূমিকা তাকে সত্যিকার অর্থেই একজন প্রকৃত ইসলামি নেতায় পরিণত করেছে।

আরও পড়ুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button