সংস্কৃতি আমদানি অপসংস্কৃতিরই বহিঃপ্রকাশ

jamalজামাল আস-সাবেত: একটি ঘটনা বলি, এক স্ত্রী তার স্বামীকে বলছে, আজ রাতে তুমি অন্য কোথাও গিয়ে থাকো; আজ আমার বয়ফ্রেন্ড আমার কাছে থাকবে। স্ত্রী’র এমন বেলাল্লাপনা কথা শুনে স্বামী’র তো মেজাজ গরম, এ কেমন কথা! তুমি আমার বউ হয়ে অন্য-একজনের সাথে রাত কাটাবে? শুরু হলো ‘বাক-বিতণ্ডা’। স্ত্রী বলল, তুমি আমার অধিকারের উপর হস্তক্ষেপ করতে পারো না, এটা আমার সাংবিধানিক অধিকার। আমার যা ইচ্ছা তা করবো, তাতে তোমার কি? স্ত্রীর এরকম উল্টা-পাল্টা কথা শুনে, স্বামীর তো মেজাজ ক্রমে-ই খারাপ হয়ে যাচ্ছে, চোখমুখ লাল করে স্ত্রী’র গালে ঠাস করে চড় বসায়ে দিল। স্ত্রী সাথে সাথে ৯৯৯ ডায়াল করল। পুলিশ উপস্থিত। -কী হয়েছে, কেন ডেকেছ?  স্বামী বলল, আমার স্ত্রী অন্য কারো সাথে রাত কাটাতে চায়, এ জন্য আমি তাকে বাধা দিয়েছি। -পুলিশ চেঁচিয়ে উঠল, বেটা! তোর স্ত্রী কার সাথে থাকবে নাকি না থাকবে তাতে তুই নাক গলাবার কে? তুই বাধা দেয়ার কে? তুই জানস না, সংবিধানে কী লেখা আছে?
অগত্যা স্ত্রী’র অধিকার ক্ষুণ্ণ করার অপরাধে স্বামীকে জেলে যেতে হল।
অন্য একটি ঘটনা, স্বামী-স্ত্রী বাসর রাতে মুখোমুখি হয়ে বসে আছে। স্বামী তার স্ত্রী’র ঘোমটা খুলে, হাতে হাত রেখে, হাসিহাসি কণ্ঠে বলল, শিউলি! আজ আমার জীবন স্বার্থক হল। তোমার মতো এতো সুন্দর একটি মেয়েকে পাবো, তা আমি কল্পনাও করিনি। তুমি আমাকে ধন্য করলে শিউলি, ধন্য করলে! আজ থেকে তুমি ছাড়া আমি আর কাউকে কল্পনাও করতে পারবো না। তুমি শুধু আমাকে তোমার ভালোবাসা দিয়ে আকড়িয়ে রেখো।’
স্বামী’র কথা শুনে স্ত্রী’র চোখ টলমল করছে, (মনে মনে বলছে, তুমি তো আমার স্বামী নও, তুমি আমার দেবতা!) – স্ত্রী চোখ মুছতে মুছতে বলল, স্বামী! আজ আমি চিরসুখী; মধুময় হল আজকের এই রজনী। তোমায় ছাড়া আমিও যে আর কাউকে ভাবতে পারবোনা, ভালোবাসতে পারবোনা’। স্ত্রী’র এমন আদরমাখা কথা শুনে স্বামী’র চোখ বেয়ে দু’ফোটা জল গড়িয়ে পড়ল।
পাঠক! নিশ্চয় বুঝতে পারছেন যে, এ দু’টির ঘটনাস্থল ভিন্ন। এবং এই দুই সংস্কৃতির বহিঃপ্রকাশের মাধ্যমে দু’টি দেশের অবস্থা কী রূপ দাঁঁড়িয়ে আছে তা বুঝতে সক্ষম হয়েছেন।
যে দেশে ভোগবিলাস-ই হচ্ছে জীবনে’র মূল লক্ষ্য; যে দেশে অধিকারের মোড়ক পরিয়ে হরণ করা হয় সংসার নামের ঐশ্বরিক প্রেম-ভালোবাসা; যে দেশে বিবাহ নামের সুন্দর ও বৈধ পন্থাকে দেখা হয় বিরক্তি’র কারণ রূপে; যে দেশে বৈধ সন্তানের চেয়ে অবৈধ সন্তানের হার অনেক বেশি; যে দেশে সমকামিতা নামের অভিশপ্ত পন্থাকে পার্লামেন্টে বৈধ বলে ঘোষণা করা হয়; যে দেশে সন্তানের সাথে পিতামাতা’র ভালোবাসা প্রকাশ হচ্ছে একটি বিরল ঘটনা; যে দেশ বৃদ্ধাশ্রম নামের মোড়ক উন্মোচন করে বিশ্বে ছড়িয়ে দিয়ে পিতামাতা’র সাথে সন্তানের দূরত্ব ক্রমে-ই বাড়িয়ে দেয়, আমাদের মনে রাখা উচিৎ, সে দেশ বাহির থেকে দেখতে যত-ই উন্নত ও চাকচিক্যময় হোকনা কেন, সে দেশ কখনো ভালোবাসা ও পবিত্র বন্ধন ‘কাকে বলে’ তা শিখাতে পারবে না। কারণ, সে দেশ দেহের ভিতরটা পরিচ্ছন্ন করার পরিবর্তে বাহিরের জৌলুষতাকেই অধিক গুরুত্ব দিয়ে থাকে।
বিদেশ থেকে আমদানি ঐ জিনিষটাই করা উচিৎ, যে জিনিষটার অভাব দেশে রয়েছে। মাত্রাতিরিক্ত কোন জিনিশ-ই যে ভালো না তা আমাদের স্মরণে রাখতে হবে। ইংরেজিতে একটি কথা আছে, ‘you must not eat too much though the food is good. Eating too much is bad for health.’
এই মাত্রাতিরিক্ত-ই যেন দেশের জন্য আজ ‘কাল’ হয়ে দাঁড়িয়েছে! তাইতো ১৪ ফেব্রুয়ারি আসলেই ‘ভালোবাসা’ নামের পবিত্র জিনিষটার চেহারা পাল্টে যায়! নতুন তকমা লাগানো হয় এর আদ্যোপান্ত চেহারাজুড়ে। যার ফলশ্রুতিতে সেদিন আমরা কেনোনা কোনভাবে শুনতে পাই, প্রেমিকের হাতে প্রেমিকা ধর্ষিত, অথবা প্রেমিকের হাতে প্রেমিকা খুন! ইত্যাদি ইত্যাদি নানারকম নিকৃষ্টসব ঘটনা। এই দিন এলে-ই কপোত- কপোতীদের ভালোবাসার চাহিদা মাত্রাতিরিক্ত হারে বেড়ে যায়! কী থেকে যে কী করবে ভেবেই পায় না! শেষে ভালোবাসা’র বহিঃপ্রকাশ করার জন্য হাতিয়ার হয়ে উঠে দেহ বা যৌন স্বাদ আদান-প্রদান করার মাধ্যমে। এই দিনের এই ‘যৌন- তামাশা, ‘ভালোবাসা’র তামাশা’ প্রজন্ম কোত্থেকে শিখেছে? আজ- কাল তো দেখি, খুব ঘটা করেই আবার এই দিবসকে কেন্দ্র করে ‘কাছে আশার গল্প’ তৈরি করার ইন্ডাস্ট্রি গড়ে উঠেছে!
বিদেশি অপসংস্কৃতি’র এই আগ্রাসন থেকে আমাদের প্রজন্মকে কবে দূরে সরাতে পারবো? নাকি আমরা-ই তাদেরকে ঠেলে দিব সেই আগ্রাসনের যাঁতাকলে!
দিনদিন যদি আমরা বিদেশি সংস্কৃতি-ই লালন করতে থাকি, তাহলে অদূর ভবিষ্যতে যে আমাদের স্বকীয়তা’র প্রশ্ন উঠবে সে কথাটি কি ভুলে গেলে চলবে? একটা দেশের মূল পরিচয়-ই তো হচ্ছে, সে দেশের শিল্প-সংস্কৃতি।
সুতরাং বিদেশি সংস্কৃতিতে মুখ থুবড়ে না পড়ে এবং বিদেশি সংস্কৃতি’র দ্বারস্থ না হয়ে বরং আমাদের স্বদেশী সংস্কৃতিতে মনোনিবেশ ও চর্চা-ই যেন হয় মুখ্য উদ্দেশ্য। আমাদের পরিচয় যেন হয় খাঁটি বাঙালি।  আমাদের মেল-বন্ধন যেন বৈধ পন্থানুসরণ ও স্বদেশীয় সংস্কৃতি’র মাধ্যমে-ই গড়ে উঠে সে চেষ্টাই করতে হবে। তবেই এ দেশ থেকে সকল প্রকার বেহায়াপনা, বেলাল্লাপনা এবং বিদেশি অপসংস্কৃতি’র মূলোৎপাটন করা সম্ভব হবে। আমরা আমাদের ভালোবাসা জড়িয়ে রাখবো সারাবছর ধরে। ভালোবাসা বলতে, শুধু কপোত-কপোতীকে বোঝাবে না বরং ভালোবাসা হবে মনের সাথে, বাবার সাথে, মায়ের সাথে, আত্মীয়-অনাত্মীয়ের সাথে, গরীব-দুঃখী মানুষের সাথে, সর্বোপরি সর্বস্তরের মানুষের সাথে, যেখানে হিন্দু, বৌদ্ধ কিংবা সাম্প্রদায়িকতা বলতে কিছুই থাকবেনা, থাকবে সবার প্রতি সবার সম্প্রীতি ও সচ্চ ভালোবাসা। আমাদের ভালোবাসা যেন অশুচি ও অনাচারের মাধ্যম না হয়। আমাদের ভালোবাসা হবে, সুন্দর ও সত্যের। এটাই তো বাঙালি’র সংস্কৃতি, আমাদের সংস্কৃতি। এ সংস্কৃতি থেকে বের হওয়া জাতির জন্য অশনি সংকেত।
লেখকঃ  শিক্ষার্থী, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়।
jamalassabet@gmail.com

আরও পড়ুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও দেখুন...
Close
Back to top button