‘আহা, আজি এই বসন্তে…’
জামাল আস-সাবেত: কিসের যেন বাতাস বয়ে যায়! কোথায় যেন কোন সুদূরে উড়ে যায় নতুন পাখি! এদিকে ক্ষেতে ক্ষেতে নতুন চারা গজানোর জন্য কৃষকদের প্রস্তুতি চলছে পুরাদস্তুর। পাখিদের কলোরবে জেগে উঠছে ঘুমন্ত গ্রাম। দৃশ্যাবলী ভারি চমৎকার! শিল্পী কামরুল হাসানের আঁকা বিস্ময়কর ছবি যেন! ছবি কথা বলে, বাংলা’র রূপ কথা কয়। পুরো প্রকৃতি কানেকানে কী যেন বলে যায়! যেন প্রকৃতিতে এক হৈচৈ শুরু হয়ে গেল। কে কিভাবে সাজবে, কে কতটা সাজলে কোকিল ধরা দিবে? ভালোবাসার কোকিলকে অভ্যর্থনা জানাতে সবাই প্রস্তুত। -কোকিল আসবে বলে।
দখিনা সমীরণ হাসতে হাসতে মৌ-মৌ গন্ধ ছড়িয়ে যায়। কিষাণী বালিকার খোঁপা’র চুল খোঁপায় থাকেনা, উড়ে উড়ে গন্ধরাজের কথা পাড়ার জোয়ান পোলাদের জানিয়ে দেয়।
বালিকা প্রেম বোঝেনা, আবেগ বোঝেনা; কেবল চোখাচোখি বোঝে, ঠোঁটবাঁকা বোঝে, বোঝে ‘আপনাকে খুব ভালো লাগে’ এ জাতীয় কথা। কেন ভালো লাগে বলতে পারেনা, বোঝে উঠতে পারেনা, শুধু বলতে পারে, ‘আপনাকে দেখলে আমার বুক ধড়পড় ধড়পড় করে’ এসব লজ্জামাখা মুখের সরলীকরণ বাক্য।
বালিকা রাতের কোলে স্বপ্ন আঁকে, স্বপ্ন বুনে; ইশ! না জানি আমায় কমল ভাই কত্ত ভালোবাসে! ঈষৎ প্রদীপ জ্বালিয়ে দর্পণ হাতে নিয়ে চোখজোড়ায় কাজল মাখে, ঠোঁটে লাল-গোলাপি লিপস্টিক লাগায়, খোলা চুল বেণী করে, নিজেকে দেখে, বারবার দেখে; সবশেষে পাগল নারী, নিজের রূপ দেখে নিজেই হাসে!
ভরা চাঁদে জ্যোৎস্না দেখে, একটু হেসে আবার চিন্তায় পড়ে! সত্যি-ই কি কমল ভাই আমায় ভালোবাসে!
রাত যত গড়িয়ে চলে পুব আকাশে, সকল স্বপ্নিল সুন্দর আরাধনাও ক্লান্ত দেহে ঘুমিয়ে পড়ে।
রাত চলে যায়। বালিকা’র ঘুম ভাঙতেই শুনতে পায় দূর ডালে বসে হারিয়ে যাওয়া কোকিল প্রেমিক সেই পরিচিত মধুর সুরে গান ধরেছে, কু-কু-কু। বসন্ত তবে এসে গেল! বালিকা’র মন অজান্তে-ই গেয়ে উঠে-
‘আহা, আজি এ বসন্তে এত ফুল ফুটে,
এত বাঁশি বাজে, এত পাখি গায়,
সখীর হৃদয় কুসুম-কোমল–
কার অনাদরে আজি ঝরে যায়।’
কবি’র ভাষায়,
‘পাখ-পাখালি’র মুখে নতুন হাসি, নতুন সুরের তান!
সকল জরা লীন হয়ে যায়, শুনে অবাক পাখির গান।’
গ্রামের পথে পথে ঋতুরাজ বসন্তের সূর্যতাপ মহাসুখে হাসতে থাকে। উষ্ণ অভ্যর্থনা জানায় গ্রামের মানুষকে। নদীরজলে তার কিরণতরঙ্গ খেলা করতে থাকে। অতিথি পাখিরা ধীরেধীরে কোথায় যেন হারিয়ে যায়। কোন সুদূরের দেশে কোন ঘরে বাসা বাঁধে কে জানে?
বসন্ত কথা কয় গানের, কবিতার, সুরের; বসন্ত কথা কয় নিজের, ফুল- পাখিদের, মাটিচাপা মানুষের; বসন্ত কথা কয় আনন্দের, সুখের, জয়ের; বসন্ত কথা কয় হৃদয়ের।
বসন্ত কেবল মানুষকে সুখ দেয় না; বসন্ত সুখ দেয় প্রকৃতিকে। প্রকৃতি গেয়ে উঠে, নেচে উঠে।
বাউল সম্রাট শাহ আব্দুল করিমের ভাষায়-
‘বসন্ত বাতাসে সইগো
বসন্ত বাতাসে
বন্ধুর বাড়ির ফুলের গন্ধ
আমার বাড়ি আসে
বন্ধুর বাড়ির ফুলবাগানে
নানান রঙের ফুল
ফুলের গন্ধে মন আনন্দে
ভ্রমর হয় আকুল’
বসন্ত স্বপ্ন দেখায়, জয় শেখায়, হতাশা’র চাদর মাড়িয়ে আনন্দের পথ দেখায়। বসন্ত কেবল কবি’র নয়, সাহিত্যিকের নয়, বসন্ত সাধারণেরও। তাই তো বসন্ত উঁকি দিলেই সাধারণ মানুষের ঠোঁটে এক অনাবিল প্রাপ্তির হাসি ফুটে উঠে। জরাজীর্ণ মাস শেষে বসন্ত সত্যি-ই নতুন যৌবন এনে দেয় মানুষের দোরগোড়ায়। প্রকৃতিপ্রেমী মানুষ দখিনা বাতায়ন পাশে বসে মধুর সৌরভ শুঁকতে চায়, রাঙাতে চায় প্রকৃতি’র মতো নিজেদের জীবন। ঋতুরাজ বসন্তে মানুষও সুন্দরের রাজা হতে চায়। মানুষ আর বাসন্ত অন্তরাত্মা’র আত্মীয় উঠে। মানুষ ভালোবাসে বসন্তকে, বসন্ত ভালোবাসে মানুষকে। প্রকৃতি আর মানুষ এই একটি মাসে-ই একে-অন্যের হয়ে যায়। মানুষ হয়ে উঠে প্রকৃতি – প্রকৃতি হয়ে উঠে মানুষ।
লেখকঃ শিক্ষার্থী, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ।
jamalassabet@gmail.com