‘বঙ্গবন্ধুরও বুঝে আসেনি’
জামাল আস-সাবেত: বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর সুবিখ্যাত গ্রন্থ ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’র ৯৮ পৃষ্ঠায় উল্লেখ করেন যে, ‘যারা উর্দু ভাষা সমর্থন করে তাদের একমাত্র যুক্তি হল উর্দু ‘ইসলামিক ভাষা’। উর্দু কি করে যে ইসলামিক ভাষা হল আমরা বুঝতে পারলাম না।’ অর্থাৎ শেখ মুজিবুর রহমান বুঝতে-ই পারেননি যে, উর্দু কী করে ইসলামিক ভাষা হয়!? বঙ্গবন্ধু’র কথাটি এখানে এ জন্য প্রাসঙ্গিক যে, ‘এখনো অনেক আলেম মনে করেন বাংলাদেশে বাংলা ভাষা না থেকে বরং উর্দুভাষা থাকলেই ভাল হতো, কারণ ইসলামি অনেক কিতাব (বই) উর্দু ভাষায় লেখা হয়েছে অর্থাৎ ইসলাম বুঝতে সহজ হতো। পরোক্ষভাবে এখনো পর্যন্ত সে ধ্যানধারণা-ই রয়ে গেল! এখনো তারা বাংলাকে মনে’র মধ্যে জায়গা দিতে পারেননি। তৎকালীন সময়ে ছাপ্পান্ন ভাগ লোকের মাতৃভাষা ছিল বাংলা। অথচ কিছু কিতাব বুঝতে সহজ হবে বলে সেই ছাপ্পান্ন ভাগ মানুষের প্রাণের ভাষাকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে উপস্থাপন করা হল! অবজ্ঞা করা হল! উপস্থাপন করা হল ইসলামিক ভাষা বলে! ধর্মের সাথে কী জঘন্য ন্যাকামি!
শেখ মুজিবুর রহমান ঠিক কথাটি-ই বলেছিলেন, ভাষা ইসলামিক হয় কিভাবে?
ধর্ম এক জিনিস, ভাষা আরেক জিনিস। সবকিছু গুলিয়ে ফেললে হবে? বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান খুব সুন্দর করে বলেছেন, ‘শুধু পূর্ব-পাকিস্তানের ধর্মভীরু মুসলমানদের ইসলামের কথা বলে ধোঁকা দেওয়া যাবে ভেবেছিল, কিন্তু পারে নাই।’ অর্থাৎ উর্দুকে বাঙালিজাতি’র ঘাড়ে চাপিয়ে দেয়ার জন্য তারা ধোঁকা স্বরূপ ভাষাকে ইসলামিক বলে চালিয়ে দিতে চেয়েছিল কিন্তু শেষ পর্যন্ত পেরেছিল কি? -পারে নাই। আল্লাহ কখনো জালেমদের পক্ষাবলম্বন করেন না। -এটা মনে রাখতে হবে। কোন ভাষা যে ইসলামিক হতে পারেনা তা তিনি (বঙ্গবন্ধু) আরো পরিষ্কার করে বলেন যে, “দুনিয়ার বিভিন্ন দেশের মুসলমানরা বিভিন্ন ভাষায় কথা বলে। আরব দেশের লোকেরা আরবি বলে। পারস্যের লোকেরা ফার্সি বলে, তুরস্কের লোকেরা তুর্কি ভাষা বলে, ইন্দোনেশিয়ার লোকেরা ইন্দোনেশিয়ান ভাষায় কথা বলে, মালয়েশিয়ার লোকেরা মালয়া ভাষায় কথা বলে, চীনের মুসলমানরা চীনা ভাষায় কথা বলে। এ সম্বন্ধে অনেক যুক্তিপূর্ণ কথা বলা চলে।” – (অর্থাৎ) কৈ তারা তো মুসলমান হওয়া সত্ত্বেও উর্দু ভাষায় কথা বলেনা। সুতরাং পাকিস্তানে কী করে যে, উর্দুভাষা ইসলামিক হয়ে উঠল! -এটা নিতান্ত-ই স্বার্থসিদ্ধ কথা নয় কি? একটা দেশে তো কেবল আলেমরা বাস করেননা, জনসাধারণও তো বসবাস করেন। শুধু আলেমদের সুবিধা নিয়ে তো দেশ চলতে পারেনা, আপামর জনতার দিকেও তো তাকাতে হবে, নাকি? সবচেয়ে মজার বিষয় হচ্ছে, সেসময় আলেমদের বহুলাংশ ভাষা’র গুরুত্ব না বুঝলেও জনসাধারণ অর্থাৎ সালাম, বরকত, রফিক, জব্বারের মতো মানুষরা ঠিক-ই উপলব্ধি করতে পেরেছিল। আরো মজার বিষয় হচ্ছে, আল্লাহ তা’আলা আলেমদের মনোবাসনা কবুল না করলেও জনসাধারণের মনোবাসনা ঠিক-ই কবুল করেছিলেন। -এ থেকে প্রতীয়মান হয় যে, জনসাধারণের দাবি-ই ছিল সত্য ও ন্যায়সঙ্গত। জালিমের বিরুদ্ধে মজলুমের আর্তনাদ।
দুঃখজনক হলেও সত্য যে, ভাষা আন্দোলনে আলেম সমাজ জনবিচ্ছিন্ন না থেকে যদি জনসম্পৃক্ত হতো তাহলে পরবর্তী স্বাধীনতা যুদ্ধেও তারা বিরাট ভূমিকা রাখতে পারোতো।
কিন্তু সে ক্ষেত্রেও তাদের ব্যর্থতা পুরোপুরিভাবে পরিলক্ষিত হয়। -ভুল বুঝা আর ভুল সিদ্ধান্ত নিয়েই তারা একেবারে চুপচাপ ছিলেন; অনেকে-ই আবার স্বাধীনতা সংগ্রামে পাকিস্তানী দোসর হয়ে হক কাজ (তাদের চিন্তাধারায়) করেছিলেন! দেশে কেবল ইসলাম প্রচারের জন্য বাস করলে তো হবেনা, দেশের জন্য যখন যা প্রয়োজন সে ক্ষেত্রেও তো ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে, নাকি? ইসলামে তো কেবল ধর্মানুষ্ঠান পালন করতেই নির্দেশ করেনি বরং দেশ ও দশের জন্যও তো কাজ করতে বলে। -এই কাজ আঞ্জাম দিলেই তো ইসলামের মূল শিক্ষা ভেসে উঠে। বাংলা ভাষাকে অবজ্ঞা নয় বরং এর সঠিক ব্যবহারের মাধ্যমেই ইসলামী ধ্যানধারণা জনসম্মুখে উপস্থাপন করতে হবে। মনে রাখা দরকার, মাতৃভাষায় ইসলামকে জনসম্মুখে উপস্থাপন করা যতটা সহজ হবে (এবং মানুষ যত তাড়াতাড়ি বুঝবে) ভিনদেশি ভাষায় উপস্থাপন করলে ততটা কি সহজ হবে? – হবেনা। জনগণ ধর্ম শিখতে চায় মায়ের ভাষায়, পরিচিত ভাষায়; অপরিচিত ও অজানা ভাষায় নয়।
তাই বাংলা ভাষার কবিতা, গল্প, উপন্যাস পড়ুন, শিখুন, বাংলাকে লালন করুন অন্তরের মণিকোঠায়। বাংলা ভাষা’র চর্চা বাড়িয়ে দিন। ভিনদেশি ইসলামিক ভাষা’র যত জ্ঞানগর্ভ গ্রন্থগুলি আছে তা বাংলায় অনুবাদ করুন। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য সহজভাবে ইসলামের প্রচার করুন মা-মাটি’র ভাষায়, প্রাণের ভাষায়। আরবি, উর্দু যতনা চর্চা করবেন তারচেয়ে বরং বাংলা ভাষা চর্চা করুন। সভাসমিতিতে বাংলা ভাষাকে সুন্দরভাবে উপস্থাপন করুন। আমাদের মনে রাখা দরকার, এই প্রজন্ম বাংলা যত চর্চা করবে, আগামী প্রজন্মও তত চর্চা করবে। তারা জানবে, বুঝবে, শিখবে। ভাষার মর্যাদা দিতে সচেষ্ট হবে। কিন্তু আমরা-ই যদি ভাষার অবহেলা করি তাহলে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম কী করে ভাষার মর্যাদা দিবে? সর্বোপরি আলেম শ্রেণি-ই নয় শুধু, সর্বশ্রেণি’র মানুষ-ই যেন মাতৃভাষা চর্চায় অধিক যত্নবান হয় সে আশা-ই করি। আর সব সমালোচনাকে ‘বিরুদ্ধ’ হিসেবে না নিয়ে, বাস্তবতা’র দিকে তাকিয়ে এগিয়ে আসা-ই শ্রেয়। বঙ্গবন্ধু’র সোনার বাংলা গড়ার প্রত্যয়ে সকলেরই এগিয়ে আসা অবশ্য কর্তব্য। একটি সুন্দর ও মার্জিত সমাজ উপহার দিতে হলে ভাষা’র সঠিক ব্যবহার শিখতে হবে। উন্নত সংস্কৃতি গড়তে হলে ভাষা’র বিকল্প অন্যকিছু নেই।
লেখকঃ শিক্ষার্থী, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ।
jamalassabet@gmail.com