হাফেজ্জী হুজুরের বড় ছেলে মাওলানা শাহ আহমাদুল্লাহ আশরাফের ইন্তেকাল

AhmaduAllahহযরত মুহাম্মাদুল্লাহ হাফেজ্জী হুজুর (রহ:) এর বড় ছেলে, বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলনের সাবেক আমির মাওলানা শাহ আহমাদুল্লাহ আশরাফ ইন্তেকাল করেছেন (ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)।
শুক্রবার সকালে রাজধানীর ধানমন্ডির শংকর এলাকার ইবনে সিনা হাসপাতালে ইন্তেকাল করেন মাওলানা শাহ আহমাদুল্লাহ আশরাফ।
মাওলানা আহমাদুল্লাহ আশরাফ ২০১৪ সালের মার্চ থেকে অসুস্থ হয়ে বিছানায় শায়িত ছিলেন। জটিল ডায়াবেটিস ও প্রচণ্ড শ্বাসকষ্টসহ জটিলতা দেখা দিলে তাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।
১৯৮৭ সালের ৭ মে হাফেজ্জী হুজুরের ইন্তেকালের পর খেলাফত আন্দোলনের দায়িত্ব ভার গ্রহণ করেন মাওলানা ক্বারি শাহ আহমাদুল্লাহ আশরাফ। একটানা ২৭ বছর আমিরের দায়িত্ব পালন করেন। পরে তিনি পর পর কয়েক বার স্ট্রোকে আক্রান্ত হলে খেলাফত আন্দোলনের দায়িত্ব ভার তার ছোট ভাই ক্বারি আল্লামা শাহ আতাউল্লাহকে বুঝিয়ে দেন।
উল্লেখ্য, ২০১২ সালের ২২ সেপ্টেম্বর নারী নীতিমালা ও মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে নিয়ে কটূক্তির প্রতিবাদে আন্দোলনরত অবস্থায় জাতীয় প্রেসক্লাব থেকে মাওলানা আহমাদুল্লাহ আশরাফ গ্রেফতার হন। তাঁর গ্রেফতারির প্রতিবাদে পরের দিন সারা দেশে শান্তিপূর্ণ হরতাল ও বিক্ষোভ পালিত হয়। সরকারের রক্ত চক্ষু উপেক্ষা করে বারবার ইসলামের মর্যাদা রক্ষা এবং জনগণের ধর্মীয় রাজনৈতিক অধিকার আদায়ে রাজপথে সক্তিয় ও সাহসী ভূমিকা রাখেন তিনি।
মাওলানা আহমাদুল্লাহ আশরাফ ভারত উপমহাদেশের প্রখ্যাত বুজুর্গ হযরত হাফেজ্জী হুজুর (রহ:) এর ঔরসে ১৯৪২ সালে লালবাগ কিল্লার মোড়ে হযরত হাফেজ্জী হুজুর (রহ:) এর জীর্ণ কুটিরে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি প্রাথমিক শিক্ষা অর্জন করেন মুন্সিগঞ্জ জেলাধীন বিক্রমপুরের মোস্তফাগঞ্জ মাদরাসায় অতঃপর বড়কাটারা ও লালবাগ মাদরাসায়। তারপর ইলমে নববী অর্জনের লক্ষ্যে প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশ ছেড়ে চলে যান পাকিস্তানের জামিয়া ইসলামিয়া বিননূরী টাউন মাদরাসায়।
পাকিস্তান থেকে দেশে ফেরার পর মাওলানা আহমাদুল্লাহ আশরাফ ১৯৬৩ সালে হযরত হাফেজ্জী হুজুর রহ. এর নির্দেশে জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমে প্রধান মুয়াজ্জিন হিসেবে যোগদান করেন। অন্যায্য কারণে তাকে এ দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি প্রদান করার কিছু দিন পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নিজে উদ্যোগী হয়ে তাকে উক্ত দায়িত্বে পুনর্বহাল করেন। এছাড়া সাবেক প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের কাছে তিনি ছিলেন বিশেষভাবে সম্মানিত ব্যক্তি।
হযরত হাফেজ্জী হুজুর (রহ:) এর ইন্তিকালের পর মাওলানা ক্বারী আহমাদুল্লাহ আশরাফ বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী দ্বীনি বিদ্যাপিঠ জামিয়া নুরিয়া ইসলামিয়ার (মাদরাসা-ই নূরিয়া) মুহতামিম পদে নিযুক্ত হন। একই সাথে আমিনবাজার মদীনাতুল উলূম মাদরাসা ও লক্ষ্মীপুর জেলার লুধুয়া ইশা’আতুল উলূম মাদরাসার প্রিন্সিপালের দায়িত্ব পালন করেন।
মাওলানা আহমাদুল্লাহ আশরাফের জীবনের বড় একটি অংশ কেটেছে রাজনীতির ময়দানে। ছাত্র জীবন থেকেই আল্লাহর জমীনে আল্লাহর খেলাফত প্রতিষ্ঠার মহৎ লক্ষ্যে জমিয়তে ওলামায়ে ইসলামসহ বিভিন্ন দ্বীনী সংগঠনের কাজে সহযোগিতা করেন। ১৯৮১ সালে হাফেজ্জী হুজুর (রহ:) এর তওবার রাজনীতির আন্দোলনে ঘনিষ্ঠ সহযোগী হিসেবে কাজ করেন।
হযরত হাফেজ্জী হুজুর এর ইন্তিকালের পর তাঁর আকাক্সক্ষা মোতাবেক মাওলানা আহমাদুল্লাহ আশরাফ সংগঠনের ভারপ্রাপ্ত আমীর নির্বাচিত হন। হযরতের জানাজার পূর্বাহ্ণে লাশ সামনে রেখে ৮ ই রমজান ১৪০৭ হিজরী, ৭ই মে ১৯৮৭ ইং শুক্রবার সকাল ৯টায় জামেয়া কোরআনিয়া লালবাগ মাদরাসায় সমবেত দলের নেতা ও কর্মীদের এক সভা খেলাফত আন্দোলনের কেন্দ্রীয় নায়েবে আমীর হযরত মাওলানা ফজলুর রহমানের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত হয়। সভায় সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত মতে মাওলানা আহমাদুল্লাহ আশরাফকে এই প্রথম গুরু দায়িত্ব নিতে হয়। পরবর্তীতে ১ মাস ২৭ দিন পর ৬ জিলক্বদ মাদরাসা-ই নূরিয়ায় আহুত দলের ঐতিহাসিক সর্ববৃহৎ মজলিসে শূরায় তিনি সর্বসম্মতিক্রমে ‘আমীরে শরীয়ত’ নির্বাচিত হন এবং এ অধিবেশনেই সকল সদস্যদের বায়আ’ত পর্ব অনুষ্ঠিত হয়। ১৯৮৭ থেকে গত ২৯ নভেম্বর ২০১৪ ইং তারিখ পর্যন্ত দীর্ঘ ২৭ বছর অত্যন্ত বিচক্ষণতার সাথে এই দায়িত্ব পালন করেন।
১৯৭১ সালে পাক বাহিনীর জুলুম-নির্যাতন থেকে রেহাই পায়নি জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররম এলাকাও। ক্ষুদ্র, অসহায় ব্যবসায়ীদের উপরে পাক বাহিনী যখন জুলুম-নির্যাতন করছিল, তখন মাওলানা আহমাদুল্লাহ আশরাফ বীরবিক্রমে তাদের সহযোগিতায় এগিয়ে আসেন এবং সরাসরি পাক বাহিনীকে প্রতিরোধ করেন। এক পর্যায়ে তারা মাওলানা আহমাদুল্লাহ আশরাফ এর উপর ক্ষিপ্ত হয়ে তাঁকে বেধড়ক প্রহার করে রক্তাক্ত অবস্থায় গ্রেফতার করে। তাঁকে হত্যার উদ্দেশ্যে নারায়ণগঞ্জ ক্যাম্পে নিয়ে যায়। ঐদিকে হযরত হাফেজ্জী হুজুর রহ. এর কাছে গ্রেফতারের সংবাদ আসলে তিনি জায়নামাজ বিছিয়ে সরাসরি আল্লাহর কাছে অভিযোগ দায়ের করেন। হত্যার উদ্দেশ্যে বন্দুক তাক করে দাঁড় করানো হয়েছিল মাওলানা আহমাদুল্লাহ আশরাফকে। হাফেজ্জী হুজুরের দোয়ার বদৌলতে আল্লাহ তাদের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার মাধ্যমে বন্দুকের নলের সামনে থেকে মাওলানা আহমাদুল্লাহ আশরাফকে রক্ষা করেন।
এতীম, অসহায়, গরীব-দুঃখীর জন্য তিনি নিবেদিতপ্রাণ এক অনন্য ব্যক্তিত্ব। রাস্তা থেকে এতীম-গরীব, অসহায়দের কুড়িয়ে এনে অভিভাবকত্ব গ্রহণ করে তাদের শিক্ষা-দীক্ষার ব্যবস্থা করতেন। যাদের অনেকেই আজ কুরআনুল কারীমের হাফেজ, মাওলানা হয়ে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে দ্বীনী খেদমত আঞ্জাম দিয়ে যাচ্ছেন।
ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের শোক: ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ ঢাকা মহানগর দক্ষিণের সভাপতি মাওলানা ইমতিয়াজ আলম, সিনিয়র সহ-সভাপতি আলহাজ আবদুর রহমান ও সেক্রেটারী এবিএম জাকারিয়া এক বিবৃতিতে হাফেজ্জী হুজুর রহ. এর বড় সাহেবজাদা মাওলানা আহমাদুল্লাহ আশরাফ এর মৃত্যুতে গভীর শোক ও পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানিয়েছেন।
বিবৃতিতে তারা বলেন, ‘খেলাফত আন্দোলনের আমীর হিসেবে তিনি ছিলেন সত্য প্রকাশে নির্ভীক। তার মৃত্যুতে জাতি এক প্রথিতযশা আলেমকে হারাল। আল্লাহ তাকে জান্নাতের উচু মাকাম দান করুন।
একই বিবৃতিতে জমিয়ত উলামায়ে ইসলামের সহ-সভাপতি ও ঢাকার ঐতিহ্যবাহী দ্বীনি প্রতিষ্ঠান আরজাবাদ মাদরাসার মুহতামিম মাওলানা মোস্তফা আজাদ এর মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করেছেন ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ ঢাকা মহানগর দক্ষিণের সভাপতি, সহ-সভাপতি ও সেক্রেটারী।
বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের শোক: বিশিষ্ট আলেমেদ্বীন হজরত হাফেজ্জী হুজুর (রহ:) এর ছেলে ও বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলনের সাবেক আমীরে শরীয়ত মাওলানা শাহ আহমদুল্লাহ আশরাফের ইন্তেকালে গভীর শোক ও সমবেদনা জ্ঞাপন করে বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের আমীর প্রিন্সিপাল আল্লামা হাবীবুর রহমান ও মহাসচিব মাওলানা মাহফুজুল হক বলেছেন, মাওলানা আহমদুল্লাহ আশরাফ মাদরাসা মসজিদ প্রতিষ্ঠাসহ বিভিন্নভাবে দ্বীনের খেদমত করে গেছেন এবং ইসলাম ও দেশের স্বার্থে আন্দোলন র্সগ্রামে অবদান রেখেছেন।
বাংলার জমিনে খেলাফত প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন। তার মৃত্যুতে দেশ একনিষ্ঠ দিনের একজন রাহবারকে হারিয়েছেন যা অপূরণীয়। নেতৃবৃন্দ তার রুহের মাগফিরাত কামনা করে তার শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি সমবেদনা জ্ঞাপন করেন।
জামায়াতে ইসলামীর শোক: মাওলানা শাহ আহমদুল্লাহ আশরাফের ইন্তিকালে গভীর শোক ও সমবেদনা জ্ঞাপন করে বিবৃতি দিয়েছে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীসহ বিভিন্ন ইসলামী সংগঠন। বিবৃতিতে তারা বলেন, মাওলানা শাহ আহমাদুল্লাহ আশরাফের ইন্তিকালে যে শূন্যতা সৃষ্টি হয়েছে তা অপূরণীয়। তিনি মাদরাসা মসজিদ প্রতিষ্ঠাসহ বিভিন্নভাবে দ্বীনের খেদমত করে গেছেন এবং ইসলাম ও দেশের স্বার্থে আন্দোলন সংগ্রামে অবদান রেখেছেন।
আরও শোক প্রকাশ করে বিবৃতি দিয়েছেন- সম্মিলিত উলামামাশায়েক পরিষদের আলেমদের মধ্যে জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের সভাপতি শাইখ আবদুল মোমিন, খেলাফত মজলিশের আমীর মাওলানা মোহাম্মাদ ইসহাক, ইসলামী ঐক্যজোটের আমীর মাওলানা আব্দুল লতিফ নেজামী, হাফেজ্জে হুজুরের সাহেবজাদা হাফেজ মাওলানা আতাউল্লাহ, অধ্যক্ষ মাওলানা যাইনুল আবেদীন, মাওলানা জাফরুল্লাহ খান, মাওলানা মহিউদ্দীন রব্বানী, ড. মাওলানা খলিলুর রহমান মাদানী, ইসলামী ঐক্য আন্দোলনের আমীর ড. মাওলানা ঈসা শাহেদী, শাহতলীর পীর ও হক্কানী পীর মাশায়েখ পরিষদের আমীর মাওলানা আবুল বাশার, ফরায়েজী আন্দোলনের আমীর মাওলানা আব্দুল্লাহ মোহাম্মাদ হাসান, মাওলানা তাহের জাবেরী আল-মাদানী, জামেয়া এমদাদিয়া মাদরাসার মুহতামিম মাওলানা আবু তাহের জিহাদী,মাওলানা আহমাদ আলী কাসেমী, মুফতি আবদুর রহমান চৌধুরী, মাওলানা আজিজুল হক ইসলামাবাদী, মুফতি হাফেজ নুর হোসাইন কাসেমী, শর্ষীনার পীর মাওলানা শাহ আরিফ বিল্লাহ সিদ্দীকি, মীরের সরাইর পীর সাহেব মাওলানা আঃ মোমেন নাছেরী, টেকের হাটের পীর সাহেব মাওলানা কামরুল ইসলাম সাঈদ আনসারী, মুফতি ফখরুল ইসলাম, মুফাস্সিরে কুরআন মাওলানা লুৎফুর রহমান প্রমুখ।

আরও পড়ুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও দেখুন...
Close
Back to top button