ধুলো-মাখা কথা
জামাল আস-সাবেত: রাত বেড়ে চলছে। চাঁদ হেঁটে চলছে। একলা পুকুরটা কেবলই ভিজে যাচ্ছে। তারাগুলি বড় একলা আজ। জোনাকিপোকাও তেমন দেখা যাচ্ছেনা। শিমুলগাছের ‘শিমুল’ রাস্তায় কী চমৎকার দৃশ্য ফুটিয়ে তুলছে! সামনেই একটি চারকোণাকৃতির ‘মাজার’ যেন, জিন্দা হয়ে কিছু শুনাচ্ছে! কে যেন বলছে -‘আমি চলে এসেছি, তোমাকেও মৃত্যুযন্ত্রণা ভোগ করতে হবে’; শুনে শিহরিত হই! শুনি কিনা জানিনা কিন্তু অনুভব করি। ‘অন্তর্যামী’ কাকে বলে’ তা যেন বুঝতে পারি। চারিদিকে কী নিস্তব্ধতা বিরাজ করছে!
নিরবে হেঁটে চলছি। দেখছি প্রকৃতির লীলা খেলা। সামনেই স্তব্ধ বাগান। বিদ্যুৎ চলে যাওয়াতে আরো নিগূঢ় হয়ে উঠছে অন্ধকার। তাতে কি? প্রকৃতি যেন নিজ সুন্দরতা জাগিয়ে তুলছে। যেন প্রকৃতি তার কৃত্রিমরূপ ঝেড়ে ফেলছে। ভাবছে কবি। একটি চেয়ারে বসে মৃদু আলোতে বসে আছি। প্রকৃতি আজ চোখ মেলে তাকিয়ে আছে। কী অস্বাভাবিক মোহেনি রূপ! ঋতুরাজ বুঝি এমনি হয়? আহ, বসন্তী! মনে হচ্ছে, এই যে আমরা যে বসন্ত উদ্যাপন করি তাতে খুব গোলমাল ঠেকে যাচ্ছে যেন। মন বলছে, বসন্তী উৎসব মাথায় ফুল দিয়ে হয়না, গলায় মালা দিয়ে হয়না, ফুলগুলি বিক্রি করে আর সৌন্দর্যকে অবমাননা করে উৎসব হয়না; বসন্তী হয় প্রকৃতির কাছে এসে, কোকিলের গান শুনে, বসন্তীরঙ মেখে, ফুল ফুটছে দেখে নেচে উঠে উৎসব হয়; ফুলের ঘ্রাণ নিয়ে, গ্রাম ঘুরে, চাঁদের সাথে কথা কয়ে বসন্তোৎসব করতে হয়। বসন্তী চাঁদ যে না দেখে সে কী করে বসন্ত বুঝতে পারে? বসন্ত গাইতে পারে, নাচতে পারে, সুর করতে পারে, সাজতে জানে, সাজাতে জানে, হাসতে জানে, হাসাতে জানে। আরো অনেক অনেক কিছু জানে।
বলছিলাম, রাত বেড়ে চলছে। ক্রমেই নিস্তব্ধতা সঙ্গী হয়ে উঠছে। মনের কোণে কেবলি দু’টি কাজল-চোখ ভেসে উঠছে, কানেকানে বলছে ‘ভালোবাসি’। আমি জানিনা, কে বলছে! জানিনা এ শব্দটি আমার মন থেকে উৎসারিত নাকি অন্যকারো বিষাক্ত ঠোঁট থেকে। যখন ভালোবাসা জন্ম নেয় তখনি বুকের ভিতর আর মাথার চতুর্দিকে পাহাড় পরিমাণ ঘৃণা তোলপাড় সৃষ্টি করতে থাকে। ‘ভালোবেসে বড় ভুল করেছিস’ কারণ সে যে ‘বহুগামি’ এ জাতীয় কিছু অস্বাভাবিক বাক্য, কে যেন বারবার বলে দেয়।
জীবন চলতে থাকে। সময় গড়িয়ে যায়। শুধু বুকের কোনখানে যেন ‘ভালোবাসা’ থেকে যায়। কিন্তু আকর্ষণ আর থাকেনা, কমতে থাকে। ‘একা’ থাকাটাই তখন ‘ভালোবাসা’ হয়ে উঠে। ‘পাথর’ হয়ে যায় মন, নিরবতাকে খুব কাছে টেনে নেয়। কোলাহলমুক্ত ‘পরিবেশ’ আপন করে তুলে। মানুষের কাছ থেকে অনেক দূরে চলে যায়। দূরে চলে আসে। বিশ্বাস হয়না আর মানুষজাতের মানুষকে। মানুষ তখন পর হয়ে উঠে, আপন হয়ে উঠে প্রকৃতি; আপন হয় পাখপাখালি আর ফুলের সৌরভ। চাঁদের আলোকে মনে হয় বড্ড প্রতারক। প্রতারণা করেই সে খুব খুশি। তেমনি কিছু মানুষরূপী মানুষের প্রতারণার ফাঁদে পড়ে অনেক মানুষ আর মানুষ থাকেনা, প্রকৃতি হয়ে উঠে। লতাপাতাহীন চলন্ত প্রকৃতিমানুষ। কারো অবহেলা তখন আর গায়ে মাখেনা। সান্ত্বনা খুঁজে না কোন মানুষরূপী’র কাছে। এখানেই সে হয়ে উঠে অনেকটা দার্শনিকের মতো। জীবনের সুখ নির্দিষ্ট কারো মধ্যে খুঁজে ফিরেনা; সুখ খুঁজে নিজের চিন্তা’র মধ্যে। সে ভাবে আমার ‘এটা’ নয় বরং ‘ওটা’ ভাবা উচিৎ। যা দুঃখ দেয় তা আর ভাবতে চায়না, শুনতে চায়না। এখানেই সে নিষ্ঠুর। মানুষরূপী কারো সৌন্দর্যে তখন মোহিত হয়না। ভাবে এসবের ভিতর কোন সুখ নেই, আশা নেই, আছে কেবল প্রতারণা।
বরাবরি একটি দীর্ঘশ্বাস! বুকের মধ্যে একটি হতাশার অব্যক্ত কম্পন! ‘আমি তাকে ভালোবেসে ছিলাম, খুব বেসেছিলাম’ মাঝপথে দাঁড়িয়ে সেটাই যেন বলে যায়। আর কখনো হয়তো দেখা হবেনা তার সাথে। কখনো আর কথা বিনিময় হবেনা; হবেনা রাত জেগে কোনো মিষ্টি আলাপন! হবেনা কোনো খুনসুটি অথবা ক্ষণস্থায়ী কোনো অভিমান! হবেনা কোনরকম প্রণয়কলহ! ভাবতেই চোখেরজল কী সুন্দর করে গড়িয়ে পড়ে!
সত্যিই তো মানুষ একসময় মৃত্যুকেও ভুলে যায়। ভুলে যায় কোনো ভালোবাসা পাওয়ার তীব্র আকাঙ্ক্ষা। এভাবে শরীরী মানুষ আর রয়না সে; অশরীরী দৃশ্যমান মানবের প্রতিচ্ছায়া বিচরণ করে। শরীরী মরার আগে মনের মরণদশা সাঙ্গ করে ফেলে!
অবহেলা হেমলকের বিষের চেয়েও বড় ভয়ংকর বিষ! এ বিষ যার শরীরে একবার পুষ করা যায় সে আর বেঁচে থাকতে পারেনা।
তবে, জীবনে বড় একটি ধাক্কা না লাগলে হয়তো মানুষ প্রকৃত ‘মানুষ’ হয়ে উঠতে পারেনা। ভাবতে পারেনা সঠিক রাস্তা। কোনো উত্তম জিদ হয়তো কাজ করেনা। কিছু মানুষ জিদকে নিয়ে চলে যায় আত্মহননের দিকে আর কিছু মানুষ জিদকে নিয়ে চলে যায় সাফল্যের শিখরে। তবে সাফল্য যাঁরা পায় তাঁরা বড্ড অভিমান করেই পথ চলতে শিখেছিল। খুব আপন কারো অবহেলায় জিদ লালন করেছিল। এঁরা আর সব আনন্দকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে এগিয়ে চলেছিল দুর্বার গতিতে। লক্ষ্যে না পৌঁছা পর্যন্ত নিশ্বাস ফেলেনি কোথাও।
আর অধিকাংশ মানুষই এ অবহেলা সহ্য করতে না পেরে নিঃশেষ হয়ে যায়। মহামূল্যবান জীবনকে তুচ্ছ করে তোলে। জীবনের পদেপদে পরাজিত হয়। বেঁচে থাকলেও একরকম পরজীবী হয়ে বাঁচে।
অবহেলাকে অভিশাপ নয় বরং আশীর্বাদ হিসেবে নেয়াটাই বুদ্ধিমত্তার কাজ। যাকে ভালোবেসে দাম পাওয়া যায়না বরং বিনিময়ে অবহেলা পাওয়া হয় তার জন্য কেঁদে কেটে নির্বাক হওয়া কোনো মানুষের কাজ হতে পারেনা। শতবার আবেগি হওয়ার চেয়ে একবার বিবেক দিয়ে চিন্তা করে তবেই কোনো বিষয়ে হাত দেয়া উচিত। যার হৃদয়ের কুঠিরে কোনো স্থান নেই, সে হৃদয়ে জোর খাটানো আর যাই হোক, ভালোবাসা পাওয়া যায়না। সুতরাং চাঁদ হেলে পড়ুক, চাঁদের কিরণ স্মৃতিকে যতই নাড়া দিক তবু নিজেকে না নাড়লেই হলো। এভাবেই একদিন স্মৃতিগুলো বিলীন হয়ে যাবে। কাঁদতে হবেনা সফলতার মঞ্চে দাঁড়িয়ে বরং কাঁদবে সে যে অবহেলা করেছিল।
হেঁটে চলি অন্ধকার রাতে। ভাবছি জীবনে কী পেলাম আর কী পাইনি। সবই তো অনাদরে অবহেলায় হারিয়ে গেল। ফিরে দেখি, ধুলো-মাখা পথের বাঁকে বাঁকে পা’য়ের ছাপ এখনো লেগে আছে। তবে কি হারাইনি? ভাবি, এসবই কি আমি?
লেখকঃ শিক্ষার্থী, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়।
jamalassabet@gmail.com