টাওয়ার হ্যামলেটস মেয়র নির্বাচন: যোগ্য প্রার্থীকে ভোট দেবো
ফরীদ আহমদ রেজা: টাওয়ার হ্যামলেটস বরায় ভোটযুদ্ধ শুরু হয়েছে। মূল কথায় যাওয়ার আগে পাঠকগণ দুটো সংলাপ পাঠ করুন।
এক.
– দোয়া করবেন, আমি এবার নির্বাচনে দাঁড়িয়েছি।
– কিসের নির্বাচন?
– কাউন্সিল নির্বাচন।
– কোন পদে?
– কাউন্সিলার পদে।
– কোন প্যানেলে?
– লুৎফুর রহমান।
– লুৎফুর রহমান? তিনি কি নির্বাচন করছেন?
– না, তিনি না। তিনি ডেকে নিয়ে বললেন, এবার তোমার একটা চান্স এসেছে কাউন্সিলার হবার।
– এর মানে মেয়র প্রার্থী ওহিদ আহমদের প্যানেলে?
- হ্যাঁ, তাই।
– আপনার মতে জন বিগস, ওহিদ আহমদ এবং রাবিনা খান
– এ তিন জনের মধ্যে কে বেশি যোগ্য।
– রাবিনা খান বেশি যোগ্য।
– তা হলে যোগ্য মেয়রপ্রার্থী বাদ দিয়ে ওখানে আপনি কেন গেলেন?
- সাবেক মেয়র লুৎফুর রহমান ডেকে নিয়ে বললেন, তাই গিয়েছি।
দুই.
- আপনাদের মেয়র নির্বাচনের খবর কী?
- আর কি খবর থাকবে? লেবার প্রার্থীর বিজয় নিশ্চিত।
- শুনলাম তো জন বিগস’র প্রার্থী হওয়া চ্যালেজ্ঞের মুখে?
- ও কিছু হবে না। জন বিগস ম্যানেজ করে নিবেন।
– বাঙালি প্রার্থীদের খবর কী?
– ডা আনোয়ারা আসার পর হিসাব-নিকাশ কিছুটা বদলে যাবে।
– কী রকম?
– তিনি ছিলেন লেবার পার্টির লোক। বনিবনা না হওয়ায় কনজারভেটিভ পর্টিতে চলে গেছেন। কনজারভেটিভ পর্টির বেশ কিছু ভোট আছে এখানে। তিনি সে সব পাবেন। তাঁর কিছু লেবার বন্ধু তাঁকে ভোট দেবে। কিছু বাঙালি ভোটও তিনি টানবেন।
– রাবিনা খান এবং ওহিদ আহমদ কেমন ভোট পাবেন?
– রাবিনা খান যোগ্য প্রার্থী। তাঁর জনসমর্থনও আছে। ওহিদ আহমদও অযোগ্য নহেন। তারা দু জন এক হলে এবং সাবেক মেয়র লুৎফুর রহমান সমর্থন দিলে রাবিনা খান পাশ করার সম্ভাবনা ছিল।
– সাবেক মেয়র লুৎফুর রহমান গতবারের মেয়রপ্রার্থী রাবিনা খানকে বাদ দিয়ে ওহিদ আহমদকে কেন সমর্থন করছেন?
- তা বলতে পারবো না। মনে হয় কোন কারণে রাবিনা খানকে তিনি পছন্দ করেন না।
- এর ফলে জন বিগস বিজয়ী হবার পথ পরিস্কার হচ্ছে, এটা কি তিনি বুঝেন না?
– বুঝবেন না কেন, এটা সবাই বুঝে। ওহিদ আহমদকে যারা দাঁড় করিয়েছেন তারা মনে হচ্ছে জন বিগস’র পাশ নিশ্চিত করতে চাচ্ছেন। এখন ৩জন বাঙালি মেয়রপ্রার্থী। সুতরাং জন বিগস হলিডে’তে চলে গেলেও তিনি নিশ্চিত পাশ করবেন।
এ সংলাপ বানানো কোন সংলাপ নয়, বাস্তব ঘটনা। পাঠক এ থেকে কী বুঝলেন?
রাবিনা-ওহিদ-লুৎফুর
আমরা জানি, রাবিনা খান ২০১৫’র নির্বাচনে মেয়রপ্রার্থী ছিলেন। সাবেক লুৎফুর রহমান-ই তাঁকে বাছাই করেছিলেন। রাবিনা খান সে নির্বাচনে মোট ২৫ হাজার ৭ শ’ ৬৩ ভোট পান যা ছিল প্রদত্ত ভোটের ৩৭.৮১% ভাগ। অবশ্য সেকেন্ড চয়েস যোগ করার পর রাবিনা খানের প্রাপ্ত ভোট ছিল ২৬৩৮৪টি। পক্ষান্তরে প্রদত্ত ভোটের ৪০% ভাগ পেয়ে লেবার দলের প্রার্থী জন বিগস নির্বাচনে বিজয়ী হন।
সাবেক মেয়র লুৎফুর এবার নির্বাচনে না থাকলেও তিনি পরোক্ষভাবে সব কিছুতে আছেন বলে বুঝা যায়। তাঁর দুটি নির্বাচনে ব্যক্তিগতভাবে আমি তাঁর পক্ষে পত্র-পত্রিকায় অনেক লেখোলেখি করেছি। আদালত তাঁকে বরখাস্ত করার পর আদালতের বিরুদ্ধে পর্যন্ত লেখেছি। ২০১৫’র নির্বাচনে রাবিনা খান প্রার্থী হবার পর তাঁর পক্ষেও কলম ধরেছি। তখন তাঁর যে সকল গুণাবলী ছিল সেগুলো এখনো আছে। এবার কি কারণে লুৎফুর রহমান এবং তাঁর কিছু সমর্থক রাবিনাকে বাদ দিয়ে ওহিদ আহমদের পক্ষে কাজ করছেন তা আমার বোধগম্য নয়। কোন দোষ না থাকলে আগে যিনি ২৬৩৮৪ ভোট পেয়েছেন তাকে মেয়রপ্রার্থী না করা অপমানজনক ব্যাপার। যাদের আত্মসম্মানবোধ আছে তারা এটা মেনে নিতে পারে না।
রাবিনা খানের গত কয়েক বছরের কার্যক্রম পর্যালোচনা করে কেউ বলতে পারবেন না তিনি অযোগ্য প্রার্থী। তবে, আমার ধারনা, রাবিনার দুটো দোষ আছে। প্রথমত তিনি একজন মহিলা। বাঙালি সমাজের অনেকে মহিলাদের সম্মান করতে জানেন না। তারা মনে করেন, মহিলারা কি নেতৃত্ব দেবে! অথচ আমরা জানি, বৃটেনে যারা বাংলাদেশী রাজনীতির সাথে জড়িত তাদের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ কোন না কোন ভাবে শেখ হাসিনা অথবা বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্ব মেনে নিয়ে রাজনীতি করেন। যাদের হাসিনা-খালিদা জিন্দাবাদ বলতে আপত্তি নেই তারা ‘মেয়েলোক’ বলে রাবিনা খানের প্রতি নাক সিটকানো দেখলে হাসি পায়।
রাবিনা খানের দ্বিতীয় দোষ তিনি কারো ইয়েস-লেডি নয়। যারা পরোক্ষে থেকে নেতৃত্ব নিয়ন্ত্রণ করতে চান তাদের জন্যে রাবিনা খান উপযুক্ত মেয়র প্রার্থী হতে পারেন না। সাবেক মেয়র লুৎফুর রহমান এবং তাঁর সমর্থক লোকেরা হয়তো একজন জ্বি-হুজুর-মার্কা মেয়র চান। ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন মানুষকে মনে হয় তারা পছন্দ করেন না।
রাবিনা খান এবং ওহিদ আহমদ পরাজিত হলে সাবেক মেয়র লুৎফুর রহমানের কোন লাভ-ক্ষতি নেই।আদালত তাঁকে, অন্যায় ভাবে, পাঁচ বছরের জন্যে রাজনীতি থেকে নিষিদ্ধ করেছে। কিন্তু ক্ষতি হবে কমিউনিটির – এ সহজ হিসাবটা আমাদের বুঝতে হবে।
রাবিনা খানের অভিযোগ
রাবিনার সার্জারিতে গিয়ে ওহিদ আহমদ তাঁকে অপমান করে এসেছেন, এটা রাবিনার অভিযোগ। অপরদিকে ওহিদ আহমদ এবং তাঁর সঙ্গী বলছেন, রাবিনা তাদের সাথে দুর্ব্যবহার করেছেন। তারা এটাও বলেছেন, রাবিনা খান ওখানে সার্জারি করেন তা তাদের জানা ছিল না। গত আট বছর ধরে রাবিনা খান সেখানে সার্জারি চালান। একজন পুরানো কাউন্সিলার ওহিদ আহমদ বা তাঁর সঙ্গী তা জানেন না, এ কথা কতটুকু বিশ্বাসযোগ্য?
মেনে নিলাম, তারা জানেন না। ভদ্রতার দাবি হলো, জানার পর ‘সরি’ বলে বেরিয়ে আসবেন। তারা তা না করে রাবিনা খানের সাথে ‘অধিকার’ নিয়ে বিতর্ক শুরু করেছেন। রাবিনা খান বলেছেন, তারা তাকে ‘দেখিয়ে দেবেন বলে আঙ্গুল নাচিয়ে হুমকি’ও দিয়েছেন। যাদের মধ্যে পুরুষতান্ত্রিক মনোভাব আছে তাদের ভাষার সাথে আমরা পরিচিত। তাই তাদের পক্ষে সেটা করা অসম্ভব কিছু নয়। তারা
হয়তো মনে করেন, প্রতিপক্ষ একজন মহিলা মেয়রপ্রার্থীর অফিসে বিনা প্রয়োজনে এবং বিনা অনুমতিতে ঢুকে পড়ে গরম গরম কথা বলে বেরিয়ে আসা খারাপ কোন ব্যাপার নয়।
এ ঘটনার প্রেক্ষিতে সাংবাদিক সম্মেলন করে রাবিনা খান অভিযোগ করেছেন। বিস্ময়ের ব্যাপার হচ্ছে, কেউ কেউ অভিযোগ করাকেও রাবিনা খানের অপরাধ হিসেবে দেখছেন। একজন আমার অফিসে এসে আমাকে শাসাবেন। আর আমি এর প্রতিবাদ করলে আপনি আমাকে দোষবেন, আমরা জানি না এটা কোন্ ধরণের ইনসাফ?
রাবিনা খানের যোগ্যতা
একটা অন-লাইন বাংলা নিউজ পোর্টালে দেখলাম, রাবিনা খানের যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন উত্থাপন করা হয়েছে। ওই সাংবাদিক মনে হয় বাঙালকে হাইকোর্ট দেখাচ্ছেন। এখন যারা রাবিনা খানের চেয়ে অন্য কাউকে যোগ্য বলছেন, তারাই কিন্তু দু বছর আগে রাবিনা খানকে মেয়র পদের জন্যে সবচেয়ে যোগ্য প্রার্থী বলে কেম্পেইন করেছেন। এ দু বছরে রাবিনা খান এমন কী কাজ করেছেন যার ফলে তিনি অযোগ্য হয়ে পড়লেন?
রাবিনা খানের অতীত সাফল্যের মধ্যে রয়েছে ‘ইউরোপিয়ান ডাইভারসিটি এওয়ার্ড ২১০৪’ লাভ। হিরো অব দ্য ইয়ার- ক্যাটাগরিতে বিজয়ী রাবিনা চুড়ান্ত ভাবে সর্টলিস্টেড আট জনের সাথে প্রতিযোগিতা করেন,যার মধ্যে ছিলেন আইটিভি (আইটিএন) এর ম্যানেজিং এডিটর ও হেড অব ডাইভারসিটি রবিন এলিস এবং অভিনেত্রী ফান্সিসকা মার্টিনজ। রাবিনা খানের নেতৃত্বে কাউন্সিলের সোস্যাল হাউজিং (ওশেন এস্টেট) সানডে টাইমস বেস্ট এওয়ার্ড লাভ করে। রাবিনা খান ইউরোপিয়ান ইনফু¬য়েন্স অব মুসলিম উইম্যান এওয়ার্ডের জন্য ২০১০ সালে সর্টলিস্টেড হন। এর প্রস্তাবকারী ছিলেন বিবিসি-র একজন এডিটর।
রাবিনা খান আয়সাস রেইনবো নামে একটি উপন্যাসের লেখিকা। এছাড়াও তিনি ফরেন অফিসের একটি ডকুম্যান্টারীর স্ক্রিপ্ট এডভাইসার (২০০৬), বিবিসি এবং আইটিভি-র ফ্রি ল্যান্স ক্রিয়েটিভ কনসালট্যান্ট হিসেবে কাজ করেছেন। কাজ করেছেন চ্যানেল ফোর ( টিএন ম্যাগাজিন) এবং আর্ট কাউন্সিলের সাথে। তিনি গুড ওয়াইফ সহ দুটি সর্ট ফিল্ম নির্মান করেছেন। যার স্পনসর ছিলো সিক্সটিন ফিল্ম। ২০০৯ সালে ফরেন অফিসের প্রতিনিধি দলের সাথে রাবিনা খান বাংলাদেশ সফর করেন। এটি ছিলো উগ্রপন্থা বিরোধী কর্মসূচীর একটি অংশ। তিনি ২০১২ সালে রয়েল সোসাইটি অব আর্টস-এ বিবিসি রেডিও ফোর এর জন্য মালটি কালাচারালিজমের ওপর বক্তৃতা করেন।
রাবিনা খান তরুন বয়সে ডকল্যান্ডে কমিউনিটি সেইফটি অফিসার হিসেবে তার কর্মজীবন শুরু করেন (১৯৯৪)। তিনি সরকারের রিজেনারেশন কর্মসূচী এবং স্থানীয় কাউন্সিলের সোস্যাল কেয়ার ও এডুক্যাশন সেক্টরে সাফল্যের সাথে কাজ করেন। তিনি এক সময়ের সুপরিচিতি বেথনালিগ্রিন সিটি চ্যালেনজ প্রজেক্ট-এ ওইমেন এবং বিএমই কমিউনিটির ইয়ুথ এমপাওয়ারিং প্রজেক্টের ম্যানেজম্যান্টে যুক্ত ছিলেন। রাবিনা ২০১০ সালে প্রথমে লেবার পার্টি থেকে কাউন্সিলার নির্বাচিত হন, পরে পাটি কর্তৃক মনোনিত হওয়ার পরও লুৎফুর রহমানকে মেয়র পদে ডিসিলেক্ট করায় রাবিনা খান তার সাথে পার্টি ত্যাগ করেন। ২০১০ সালে লুৎফুর রহমান মেয়র নির্বাচিত হওয়া পর টাওয়ার হ্যামেলসের হাউজিং ক্যাবিনেট সদস্য হিসেবে তিনি কাজ করেছেন। বৃটেনে ১ম কোনো মুসলিম বা এশিয়ান নারী এমন গুরুত্বপূর্ণ পদে কাজ করেছেন।
পর পর দু বছর সারা বৃটেনে সোস্যাল হাউজ নির্মানে সেরা পুরস্কার হিসেবে প্রায় ৫০ মিলিয়ন পাউন্ড পুরস্কার পায় কাউন্সিল,যার সরাসরি নেতৃত্বে ছিলেন রাবিনা। সে সময় টাওয়ার হ্যামলেটসে চার হাজারের বেশী সোস্যাল হাউজ নির্মান করা হয়।
মেয়র পদের জন্যে জন বিগস, রাবিনা খান, ডা আনোয়ারা এবং ওহিদ আহমদ – এ চারজনের কেউ অযোগ্য নয়। তবে দেখা দরকার কে বেশি যোগ্য এবং কে মেয়র হলে কমিউনিটির স্বার্থ বেশি রক্ষিত হবে। ভোট একটি পবিত্র আমানত। নিরপেক্ষ বিবেচনায় ভোটারগণ যদি আগামী নির্বাচনে রাবিনা খানকে টাওয়া হ্যামলেটস’র মেয়র পদের জন্যে সবচেয়ে যোগ্য প্রার্থী মনে করেন তা হলে তাদের অবশ্যই তাঁকে ভোট দেয়া উচিত। কে পাশ করবেন এবং কে পরাজিত হবেন সে বিবেচনা এখানে গৌন। কে তাঁকে সমর্থন করছেন এবং কে তাঁর বিরুদ্ধে, সেটাও কোন প্রশ্ন হতে পারে না। অপরের কথায় নয়, নিজের সিদ্ধান্ত নিজে নেবো। আমার ভোট আমি দেবো এবং সবচেয়ে যোগ্য প্রার্থীকে ভোট দেবো।
লন্ডন, ৭ মার্চ ২০১৮