নারগিস ফুলে মিলেছে ‘ক্যান্সার নিরাময়ের উপাদান’
ড্যাফোডিল ফুলে ক্যান্সার প্রতিরোধের উপাদান খুঁজে পেয়েছেন ইউরোপীয় বিজ্ঞানীরা। ফুলটির বৈজ্ঞানিক নাম আমারিলিদেসি নারসিসাস (Amaryllidaceae Narcissus)। ব্রাসেলসভিত্তিক চিকিৎসা বিজ্ঞানীদের দাবি, ওই ফুল থেকে এমন এক উপাদান তৈরি করা সম্ভব, যা মানবদেহে ক্যান্সার কোষের বৃদ্ধি থামিয়ে দিতে সক্ষম। বাংলায় এই ফুলটিকেই নারগিস বলা হয়। গ্রিক পুরাণে নিজ সৌন্দর্যে আত্মমগ্ন নার্সিসাসের কান্নার সঙ্গে জড়িয়ে আছে নারগিস ফুল সংক্রান্ত নানা উপকথা। নিরাময়ের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতার জায়গা থেকে এরইমধ্যে ক্যান্সার সংক্রান্ত বহু প্রতিষ্ঠান তাদের প্রাতিষ্ঠানিক প্রতীক হিসেবে নারগিসকে ব্যবহার করতে শুরু করেছে।
নার্গিস: নিউ ইয়র্কভিত্তিক চিকিৎসা বিষয়ক দৈনিক এ সংক্রান্ত প্রতিবেদনে জানিয়েছে, ব্রাসেলস বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও ‘বেলজিয়ান ন্যাশনাল ফান্ড ফর সাইন্টিফিক রিসার্চের’ পরিচালক ডেনিস লাফোন্টেইনের নেতৃত্বে গবেষকরা নারগিস ফুলে ওই হওয়া গবেষণায় ক্যান্সার নিরাময়ে এই নতুন আশার আলো পাওয়া গেছে। এর আগে আলঝাইমারের চিকিৎসায় ব্যবহার করার উদ্দেশ্যে ড্যাফোডিল ফুলকে ব্যবহার করার জন্য এর পাতা ও কা- থেকে গ্যালান্টামিন প্রস্তুত করা হয়েছিল।
অসংখ্য কোষের সমন্বয়ে তৈরি মানবদেহে কিছু কোষের অস্বাভাবিক, অনাকাঙ্ক্ষিত বৃদ্ধির ফলে আমাদের শরীরের টিস্যু ধ্বংস হতে থাকে। একেই মূলত ক্যান্সার বলে। এখনও এটি মরণব্যাধি। স্থায়ী চিকিৎসা এখনও অনাবিষ্কৃত। বিশ্বে সকল মৃত্যুর প্রায় ১৩ শতাংশের কারণ এই ক্যান্সার। ২০১৭ সালে ৮২ লাখ মানুষ ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন। নতুন করে আক্রান্ত হয়েছেন ১ কোটি ৪০ লাখ। এই বিপন্ন অবস্থাতেই ইউরোপীয় চিকিৎসা বিজ্ঞানীরা নারগিস ফুলে আশার আলো খুঁজে পাওয়ার কথা জানালেন।
সম্প্রতি বিজ্ঞানভিত্তিক জার্নাল সেলপ্রেস-এ প্রকাশিত গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, নার্গিস ফুলের মাঝে এমন একটি ক্যান্সার-প্রতিরোধক উপাদান পাওয়া গেছে, যা ওই কোষ বৃদ্ধি থামায়। ‘ক্যান্সার কোষগুলো প্রোটিন সিনথেসিস কমে যাওয়ার ওপর নির্ভরশীল। রাইবোসোমগুলো একত্রিত হয়ে একটি প্রোটিন তৈরি করে। সেটার কারণেই মূলত ক্যান্সারের আশঙ্কা বৃদ্ধি পায়’- বলা হয় এতে।
আরএনএ মোলিকিউলার বায়োলজি পরীক্ষাগারের গবেষকদের দাবি, ড্যাফোডিল ফুল থেকেমরফিন ও কুইনিনের মতোই আর একটি উপাদান প্রস্তুত করা গেছে, যার নাম হেমানথেমিন। পরীক্ষায় দেখা গেছে, ওই উপাদনটি ক্যান্সার কোষ বৃদ্ধি ঠেকাতে কার্যকর ভূমিকা রাখতে সক্ষম। বিজ্ঞানীদের দাবি, কোষের নিউক্লিওলাসে এমন ন্যানোমেশিন উৎপাদন বাধাগ্রস্ত করবে ওই উপাদান।
ক্যান্সার সৃষ্টিকারী টিউমারের অর্ধেকেরও বেশি ক্ষেত্রে দায়ী হচ্ছে একটিমাত্র জিনগত সমস্যা। গবেষণায় দেখা গেছে, নির্দিষ্ট একটি জিন মানবদেহের অভ্যন্তরে সঠিকভাবে কাজ না করলে ক্যান্সার কোষ সৃষ্টির প্রবণতা বেড়ে যায়। এরই নাম দেওয়া হয়েছে পি-৫৩। গবেষণায় বলা হয়, পি-৫৩ জিনটি মানবদেহে এক ধরনের প্রোটিন তৈরি করে থাকে, যা ক্ষতিগ্রস্ত কোষকলা পুনর্গঠনে সাহায্য করে এবং ক্যান্সার কোষ সৃষ্টি হলে তাকে ধ্বংস করে দেয়। কিন্তু কোনো অসঙ্গতি বা রূপান্তরের কারণে এই কোষীয় জিন স্বাভাবিকভাবে তার কাজ করতে না পারলে সেই নির্দিষ্ট প্রোটিনটিও আর তৈরি হয় না। আর এর ফলে মানবদেহের ভেতরে ক্যান্সার কোষগুলো বেড়ে উঠতে সুযোগ পায় এবং ক্যান্সার সৃষ্টিকারী টিউমার দ্রুত বাড়তে শুরু করে দেয়। প্রাকৃতিকভাবে তৈরি কোষ হেইম্যানথেমিন এই বৃদ্ধি ঠেকিয়ে দিতে সক্ষম । মরফিন, কুইনিন, এফিদ্রিনের মতোই এটাও উদ্ভিদ থেকে প্রাপ্ত উপাদান, যা চিকিৎসার কাজে ব্যবহার করা হবে।
বহু ক্যান্সার সংক্রান্ত সহায়তাদানকারী প্রতিষ্ঠানের প্রতীক ড্যাফোডিল ফুল। প্রাকৃতিকভাবে পাওয়া ওষুধ হিসেবে ফুলটির ব্যবহার শতাব্দী প্রাচীন। যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, আয়ারল্যান্ড ও অস্ট্রেলিয়ার মতো দেশগুলো ক্যান্সারের বিরুদ্ধে তাদের প্রচারণা কার্যক্রমকে ড্যাফোডিল ফুলের সঙ্গে যুক্ত করেছে। ক্যান্সার সচেতনতা দিবসকে তারা ড্যাফোডিল দিন নামে অভিহিত করে থাকে। তবে ড্যাফোডিল ফুলের অনিয়ন্ত্রিত ব্যবহারের বিপদ নিয়েও সতর্ক করেছেন বিজ্ঞানীরা। কারণ, ড্যাফোডিল ফুলের ডাঁটা চুষে খেলে ফুসকুড়ি, কাঁপুনি দেখা দিতে পারে। এমনি চেতন হারানোর মতো ঘটনাও ঘটতে পারে। চরম অবস্থায় মস্তিষ্ক বিকৃতি ও ফুসফুস নষ্ট হয়ে যাওয়ায় মতো দুর্ঘটনাও ঘটতে পারে।
গবেষক লাফোন্টেইন ও তার সহযোগী গবেষকরা এই গবেষণা আরও চালিয়ে নেওয়ার প্রস্তুতি নিয়েছেন। এ পর্যায়ে তাদের উদ্দেশ্য হচ্ছে, রাইবোসোমের বায়োজেনেসিসের ওপর নতুন উপাদানটির প্রভাব পর্যবেক্ষণ করা। একই সঙ্গে নতুন উপাদানটির গোত্রভুক্ত আরও চারটি অ্যালকালয়েডের ব্যবহার নিয়েও গবেষণা চালিয়ে যাবেন তারা। তারা দেখতে চান, ঠিক কোন উপাদানটি ক্যান্সার নিরাময়ে প্রধান উপাদান হিসেবে ব্যবহার করা সম্ভব।