ইরাকে মার্কিন আগ্রাসন: ১৫ বছরে ২৪ লাখ প্রাণহানি

Iraq১০০০ মার্কিন টোমাহক-রকেট ইরাকের আকাশের দখল নিয়েছিল ২০০৩ সালে প্রেসিডেন্ট জর্জ ডাব্লিউ বুশ ‘চূড়ান্ত ইনসাফ প্রতিষ্ঠা’র (অপারেশন ইনফিনিট জাস্টিস) ঘোষণা দেওয়ার কয়েক ঘণ্টার মাথায় মাঝরাতের (ভোর চারটা) বাগদাদ জেগে উঠেছিল  বিস্ফোরকের সশব্দ আতঙ্কে। সেই ইরাক আগ্রাসনের ১৫ বছর অতিক্রান্ত হয় গতকাল।  গণবিধ্বংসী অস্ত্র থাকার মিথ্যে অভিযোগে  প্রত্যক্ষ আগ্রাসন শুরু করেছিলেন বুশ নেতৃত্বাধীন জোট। জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে বুশ বলেছিলেন, ইরাকী জনসাধারণকে মুক্ত করতে এবং বিশ্বকে মহাবিপদ থেকে মুক্ত করতে তিনি এই যুদ্ধ শুরু করেছেন। আর যুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী তার জেনারেল বলেছিলেন, লাশ গোনা তাদের কাজ নয়। বুশের মুক্তির লড়াই আর তার জেনারেলের অবজ্ঞার স্রোতে গত ১৫ বছরে হারিয়ে গেছে আনুমানিক ১৫ থেকে ৩৪ লাখ লাখ তাজা প্রাণ। ডেমিওগ্রাফিক পদ্ধতি ব্যবহার করে নির্ভরযোগ্য ও স্বনামধন্য কয়েকটি জরিপ প্রতিষ্ঠানের পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করে একজন মার্কিন রাজনীতি বিশ্লেষক এবং একজন মানবাধিকার সংগঠক তাদের এক অনুসন্ধানে গত ১৫ বছরে ২৪ লাখ ইরাকির মৃত্যুর সম্ভাব্যতা হাজির করেছেন।
’৯৬ সালে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মেডলিন অরব্রাইট তাদের দেওয়া অর্থনৈতিক অবরোধে ৫ লাখ ইরাকি শিশুর মৃত্যুকে স্বাভাবিক আকারে বর্ণনা করেছিলনে সাংবাদিকদের সামনে।  বলেছিলেন, সিদ্ধান্তটা কঠোর বটে, তবে যে লক্ষ্যে এটা নেওয়া হয়েছে তার মূল্য হিসেবে এটা (৫ লাখ শিশুর জীবন) অস্বাভাবিক নয়। আগ্রাসনের সময়ে ইরাকের দায়িত্বে থাকা জেনারেল টমি ফ্র্যাঙ্কস বলেন, ‘লাশের সংখ্যা গুনে রাখাটা আমাদের কাজ নয়’  তবে গত দেড় দশকে অবিরত বেড়েছে মৃতের সংখ্যা। ক্রমাগত দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হয়েছে লাশের মিছিল। মানবাধিকার পর্যবেক্ষণ ও আন্দোলন সংস্থা ওয়ার্ল্ড বিয়ন্ড ওয়ারের মতে, এই সংখ্যা প্রতিনিয়ত বাড়ছেই। ইরাক যুদ্ধ বইয়ের পাতায় লেখা ইতিহাস হয়ে উঠেনি এখনও। এখনও এটি চলমান বাস্তব।
গণবিধ্বংসী অস্ত্র থাকার ‘নির্ভরযোগ্য গোয়েন্দা তথ্য’ সঙ্গে আছে দাবি করে ইরাকে আগ্রাসন শুরু করে  বুশ নেত্বত্বাধীন সন্ত্রাসবিরোধী জোট। যুদ্ধ শেষে অনেক মার্কিন ও ব্রিটিশ কর্মকর্তাই যুদ্ধে জড়িয়ে পড়াকে ভুল সিদ্ধান্ত ছিল বলে স্বীকার করেন। কিন্তু এই ভুলটি আগ্রাসন শুরু হওয়ার আগেই বুঝতে পেরেছিলেন বাগদাদে নিযুক্ত জাতিসংঘের অস্ত্র পরিদর্শক সংস্থা ‘আনমোভিক’ এর প্রধান হ্যান্স ব্লিক্স। এক সাক্ষাৎকারে হ্যান্স ব্লিক্স বলেন,আগ্রাসন শুরুর তিন সপ্তাহ আগে সম্ভাব্য হামলার খবর পাই আমরা। কিন্তু এটা যে অনেক বড় ধরনের ভুল ছিল সেটা জেনেও কাউকে বোঝাতে পারিনি!” ব্লিক্স বলেন, “কেন ঐ ভয়ংকর ভুলটি করা হয়েছিল তা এখন পর্যন্ত বোধে আসে না আমার। জাতিসংঘের আইন লঙ্ঘন করা হলেও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের নীরবতা ছিল সত্যিই বিস্ময়কর।”
যুক্তরাষ্ট্রের কাছে সংখ্যা বিবেচ্য না হলেও একটি মৃত্যু সংখ্যা কেবল নয়। মৃত মানুষটি কারও সন্তান, বাবা-মা, ভাই-বো কিংবা স্বামী-স্ত্রী কিংবা কোনও হারানো স্বজন। তাদের গণবিধ্বংসী অস্ত্র সংক্রান্ত ভুল অনুমানের বলি হয়েছে অন্তত ২৪ লাখ ইরাকি, এক বিশ্লেষণে বলতে চেয়েছেন দুই রাজনীতি বিশ্লেষক। তারা হলেন উইমেন ফর পিস ও গ্লোবাল এক্সচেঞ্জ নামের দুটি মানবতার পক্ষের সংগঠনের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা মেদেয়া বেঞ্জামিন এবং মার্কিন পররাষ্ট্র নীতির বিশ্লেষক নিকোরাস ডেভিস। বেঞ্জামিন ও ডেভিস বলছেন, ২০০১ সাল থেকে যুক্তরাষ্ট্র তার মিত্রদের নিয়ে যেসব দেশে হামলা করেছে, সে সব দেশের অনেক গুলোতেই ডেমোগ্রাফিক জরিপ পদ্ধতি ব্যবহার করে হতাহতের সংখ্যা নিরুপণ করা হয়েছে। একই পদ্ধতিতে হতাহতের সংখ্যা নিরুপন করা হয়েছে অ্যাঙ্গোলা, বসনিয়া, কঙ্গো, গুয়াতেমালা, কোসোভো, রুয়ান্ডা, সুদান ও উগান্ডাতে।  সাংবাদিক, এনজিও ও সরকারি তথ্য অনুযায়ী তৈরি করা এই জরিপে সব দেশের ক্ষেত্রেই ঘোষিত সংখ্যার ৪/৫ গুণ মৃত্যুর ভয়াবহতা উঠে এসেছে। যুক্তরাষ্ট্র অন্য  দেশের বেলায় এই জরিপ পদ্ধতিকে স্বীকৃত মনে করে, তবে নিজেদের আগ্রাসনের শিকার হওয়া অঞ্চলের বেলায় তারা একে ‘অগ্রহণযোগ্য গবেষণা পদ্ধতি’ নামে ডাকে। অবশ্য ব্রিটিশ সরকারি কর্মকর্তারা গোপনে স্বীকার করেছেন সেই প্রতিবেদনটির তথ্য সঠিক হয়ে থাকতে পারে।

আরও পড়ুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button