ছোট গল্প
‘নীল-নদী’
জামাল আস-সাবেত: আমাদের বিবাহবার্ষিকী’র দুই বছর পূর্ণ হল আজ। তাই শুভেচ্ছা জানাতে ভোরের আলোয় নাদিয়া’র ঠোঁটে হাত বুলিয়ে দিলাম। ওর চোখ খুলে গেল। বললাম- ‘হ্যাপি ম্যারিজ ডে’। সাথে সাথে ও হাত বাড়িয়ে দিল। আমিও কিছু না বলে- তার শুভ্র হাতের আঁচল সরিয়ে ‘নীল রঙের দুই জোড়া চুড়ি পরিয়ে দিলাম। ও মুচকি হেসে কাজলযুক্ত নয়ন যুগল আমার নয়নে রেখে কইল- ‘হ্যাপি ম্যারিজ ডে’। একটু চুপ থেকেই আবার বলল- এতো ভালোবাসো আমায়?
আমি তার চোখের দিকে তাকিয়ে বিভোর হয়ে রইলাম। মন থেকে বেরিয়ে পড়লো- কীভাবে আমায় বদলে দিলো সে, এতো ভালোবাসা নারীর বুকে!
বললাম-নাদিয়া! ‘আমি তোমার- তুমি আমার’। সে কান্না-চোখে মৃদু-স্বরে বলল- ‘ ঠিক-ই কইছো, ‘নাদিয়া তোমার- সখা আমার।’
নাদিয়া’র চোখ জুড়ে তখনো ঘুমের রেষ কাটছে না। নদীকে ( নাদিয়াকে এ নামেই ডাকতাম) ঘুমের মধ্যে যত ভালো লাগে তার চেয়ে শতগুণ ভালো লাগে ওর বিরক্ত হওয়া ঘুম ভাঙার ভঙ্গিটা। তাই প্রতিদিন রুটিন মাফিক তাকে ঘুম থেকে জাগাতে আমার ভীষণ ভালো লাগে। মনে হয়, আমার সমস্ত দিনের আনন্দের লাস্যময়ী ঘুমপরীকে জাগাচ্ছি। ও পাশে থাকলেই আমি স্বর্গের এক সৌভাগ্যবান পুরুষ।
শাড়ির আঁচল বিছিয়ে দিয়ে কফি হাতে নিয়ে পাশে বসলো নদী।
কফি’র পেয়ালায় ধীরেধীরে চুমুক দিচ্ছি। হঠাৎ নাদিয়া’র কমনীয় চোখের উদাস চাহনি আমাকে চঞ্চল করে তোললো।
জিজ্ঞেস করলাম- সোনা, ওতো উদাস চোখে কী ভাবছো?
নাদিয়া- না, মনটা কেন যেন পাখির শব্দে গভীর হয়ে গেলো।
বললাম- ‘অপূর্ব’।
কথাটি শুনে সে এদিক-ওদিক তাকাল। বলল- কে অপূর্ব?
বললাম- ‘নদী অপূর্ব, তুমি অপূর্ব।’
সে খলখল করে হাসতে লাগল।
-ও, তাই নাকি? (বসা থেকে উঠতে উঠতে বলল)- হইছে হইছে।
– না, নদী। আর একটু থাকো। তোমাকে দেখি।
নদী আমার চোখের দিকে তাকিয়ে ঠোঁটে আবেশ লাগিয়ে উচ্চাঙ্গ সুরে বলল- না, না, আর না সোনা। আমার কাজ আছে। সকাল পৌনে দশটা। ঝমঝম ঝমঝম করে বৃষ্টি আরম্ভ হয়ে গেল। বউকে ডাক দিলাম- বউ!
– কী হলো আবার!
– কী হলো দেখতে পাচ্ছো না?
– কৈ, কী?
– আরে! বৃষ্টি, বৃষ্টি।
– তা তো দেখছি। ভিজবে নাকি?
– হাঁ, চলো।
– না।
– কেন?
– জ্বর হবে।
– হোক। মন মানে না। মন কয় -বউকে নিয়ে জলছবি হবো।
– তুমি না! একটা আস্ত গাধা!
– আর তুমি?
– আমি ছাই। হলো?
– না হয়নি, হবে।
– কী হবে?
ওর হাতটি ধরে ছাদে উঠলাম। ভেজা চুলে হাত বুলাতে বুলাতে বললাম- তোমাকে নীল শাড়ি পরতে বলছে কে?
-কে আবার? তুমি। তুমি না বলো- নীল তোমার ভীষণ পছন্দ।
সখা! আমাকে দেখো, নয়নভরে দেখো। তোমার মনে আছে? আমরা যে, এই দিনে ‘এক’ হয়েছিলাম। এই তোমার সামনে বসলাম। তোমার বৃষ্টিচোখে তোমার নদীকে চেয়ে থাকবে। মুখফোটে একটা শব্দও বের করবে না। প্রশংসা শুনবো না। শুধু চেয়ে থাকবে। আমাকে দেখবে। আমার সমস্ত হৃদয় দেখবে। এই আমাকে হারাতে দিবে না। যত কিছুই হোক আমাকে একা করবেনা। আমি যে শুধুই তোমার। তুমি আর কারো নও, কারো নও, এ জগত-সংসারে আমি- তোমার, তুমি- আমার।
বলতে বলতে নদী চোখেরজলে ভাসিয়ে দিল বুক।
বললাম- নদী! আমি বুঝেছি কত ভালোবাসলে পরে নারী এমন করতে পারে!
দুপুরের গোসল শেষে দু’জন দু’জনের পাশে খেতে বসছি। এ এক মধুর মুহূর্ত। বধূ ভাত পেতে দেয়। চামচের সাথে হাতের চুড়ি লেগে হঠাৎ হঠাৎ ঝনঝন করে উঠে। কাঁকনের এ বাজনা যেন দু’টি হৃদয়কে ডাকতে থাকে ‘ভালোবাসি’। সে শব্দ পৃথিবী’র আর কেউ শুনেনা। বধূ ইলিশ মাছেরডিম ভাজা’র সবটা আমার পাতে দিয়ে দেয়। আমি অর্ধেক খেয়ে বাকীটা তার প্লেটে দেই। সে রাগ করে। বলে- আমাকে দিলা কেন? তুমি জানো না আমার ‘নীল’ (আমি নীল রঙ পছন্দ করি বলে সে আমাকে নীল বলে ডাকতো) খেলেই আমার খাওয়া হয়ে যায়।
আমি চোখেরজল মুছি। বুক ফেটে কান্না চলে আসে।
বধূ! আমি তোমাকে সারাজীবন ভালোবাসলেও তোমার ভালোবাসার ঋণ এ জনমে শোধ করতে পারবো না। চেয়ে দেখি- তার চোখেও জল খসে পড়ছে।
ধীরেধীরে দিন চলে যায়, পশ্চিমা আভা নিভে যেতে থাকে। নদী’র দিকে চেয়ে দেখি, উদাস চোখে দিনের শেষ আলো দেখে নিচ্ছে সে।
-কি গো সোনা! ওমন করে কী দেখছো?
-আজকের আনন্দ আবার কবে ফিরে আসবে বলতে পারবে, নীল?
কথাটি শুনেই বেদনার নীল রঙ আমার বুকে জোরে আঘাত করলো। আমি মুচড়ে গেলাম।
চোখেরজল ফেলা ছাড়া আর কী-ই-বা থাকতে পারে আমার! জল গড়িয়ে পড়ছে।
নাদিয়াকে জড়িয়ে ধরে বললাম- নদী! বিদায় মুহূর্তে ওমন করে বলো না। আমি সইতে পারবো না সোনা, আমি সইতে পারবো না।
চেয়ে দেখি নদী অঝোরে কাঁদছে।
সকল আয়োজন ফুরিয়ে এলো আমার। পরশু দিন এগারোটায় প্লাইট। দুবাই’র উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিবো। সারাদিনের আনন্দ ঘন মুহূর্ত বেদনার রঙে এঁকে চলছে। নাদিয়া অসহায়ের মতো চুপ করে বসে আছে। আত্মীয়- অনাত্মীয় সবার করুণার দৃষ্টি আমার দিকে। রাতের এই মুহূর্তই যে, আমার শেষ মুহূর্ত। আবার কবে ফিরবো, কবে দেখা হবে!
মায়ের চোখের দিকে তাকাতে পারছিনা। বাবার চোখের পাতা ছলছল করছে। নাদিয়া’র এখন যে কী অবস্থা আমি বুঝতে পারি! এই বেদনার্ত পরিবেশে আমার অজ্ঞান হওয়া’র উপক্রম। এতোগুলো আপন মানুষদের রেখে আমি কেমন করে ‘বিদেশ- বিভূঁই’য়ে থাকবো?। তবু যে যেতে হবে। বিদায় হতে হবে। আমি পুরুষ- আমাকে শক্ত হতে হবে। টাকা রোজগার করতে হবে। সবার ভরণপোষণ মিটাতে হবে। সবাইকে সুখে রাখতে হলে আমাকে টাকা পাঠাতে হবে। এসব ভাবতে ভাবতে একেবারে অন্যমনস্ক হয়ে পড়ি।
হঠাৎ পাশের রুম থেকে নাদিয়া’র গোঙ্গানো আওয়াজ ভেসে এলো। ওর প্রতিটি শব্দ আমার বক্ষদেশ বিদীর্ণ করে ফেলছে। নদী চিৎকার দিয়ে উঠলো- ‘আমি পারবো না’ আমি নীল’কে ছাড়া এক মুহূর্ত ‘থাকতে পারবো না’। ‘নীল, তুমি যেওনা’ আমাকে একা ফেলে তুমি কোথাও যেও না, নীল’, নীল, আমাকে কোথায় রেখে যাও, কোথায় রেখে যাও তুমি, ও আল্লাহ গো- আমি বাঁচবো না, আমি বাঁচবো না’।
-আমি দিশেহারা’র মতো দৌড়ে গিয়ে নদীকে জড়িয়ে ধরলাম। না, নদী’, কোথাও যাইনি। এই যে, তোমার কাছেই আমি। এই দেখো।
-নীল, কৈ তুমি? কৈ? নীল! নীল! বলতে বলতে সে অজ্ঞান হয়ে গেলো।
আমি চিৎকার করে উঠলাম। নদী………….., আমার নদী……….।
বড় ভাই আমাকে কোলে করে সিএনজিতে নিয়ে উঠালো। আমি তখনো অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছি। বাড়ির সবাই তখনো বলছিলো- রাহেলকে বিদেশে পাঠাইয়েন না। ও থাকতে পারবেনা। ও দেশেই ব্যবসা বাণিজ্য ধরুক ।
রাত তখন সাড়ে দশটা। গাড়ি চলছে ঢাকার পথে। গাড়িতে আমি, বড় ভাই আর ড্রাইভার। মোহাম্মদপুরে মামার বাসায় একদিন থেকে পরের দিন মামা-সহ বিমানবন্দরে পৌঁছাবো। গাড়ি চলছে। গাড়ির ঝাঁকুনিতে ধীরেধীরে জ্ঞান ফিরে আসে আমার।
ড্রাইভারকে বললাম- ভাই, একটু আস্তে চালান। ভয় করছে খুব।
-আরে ভাই, কি যে কন, ভয় কিসের? রাইতে রাস্তা ফাঁকা, তাড়াতাড়ি পুঁছতে পারমু।’
কথা শেষ না হতেই ড্রাইভারের ফোন এলো। কথা বলছে আর একহাতে গাড়ি চালাচ্ছে। হঠাৎ পিছন থেকে একটি হর্ণ বেজে উঠলো, তারপর আর কী হলো কিছুই বুঝতে পারলাম না। চোখেমুখে নীল দৃশ্য ভেসে এলো। মনে পড়ে, পিছনে হর্ণ বাজানো গাড়িটির একটি চাকা আমাকে পিষ্ট করে ফেলল। এরপর তিনটি লাশ রক্তমাখা শরীরে পড়ে রইলো রাস্তায়। আমার মাথাটা থেতলে গেছে। নাদিয়াকে তখন খুব মনে পড়ে গেল। নাদিয়া’র সাথে কাটানো সারাদিনের আনন্দঘন মুহূর্তগুলো স্মৃতিতে ভেসে উঠল। চলে আসার সময় তাকেই তো জড়িয়ে ধরে ছিলাম, জানিনা এখনো তার জ্ঞান ফিরছে কিনা। জ্ঞান ফিরে যদি জানতে পারে, গাড়ি এক্সিডেন্ট করছে, তার ‘নীল’ লীন হয়ে গেছে, তখন সে কী করবে?
আমি আর ভাবতে পারছিনা। আমার হৃদয় ফেটে অশ্রু ঝরতে লাগল। ধীরেধীরে আয়ুর টিমটিম করা বাতিটি জনমের মতো মিশে গেলো ওপারে।
–চাঁদপুর
jamalassabet@gmail.com