স্বাদের দোহাই আর নয়…
জামাল আস-সাবেত: খ্রিস্টপূর্ব ঊনবিংশ শতাব্দীকাল থেকে শুরু করে এই একবিংশ শতাব্দীকাল পর্যন্ত নারীদেরকে আমরা কেবলই শরীরী চাহিদা মেটানোর বস্তু এবং সন্তান উৎপাদনের ক্ষেত্র হিসেবেই দেখে আসছি। আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি কখনোই বদলাতে পারিনি। পারিনি, নারীকে একজন পরিপূর্ণ মানুষ হিসেবে দেখতে। তাকে কষ্ট দিয়েছি বাহ্যিক দেহেই নয় শুধু; তাদের গুপ্তাঙ্গও আমাদের অত্যাচার থেকে রেহাই পায়নি। প্রজনন রোধ করতে গিয়ে, কখনো জীবজন্তুর মল জরায়ুতে স্থাপন করে, কখনো বা মলম তৈরি করে, কখনোবা পাউডার, কখনোবা পেস্ট তৈরি করে জরায়ুতে স্থাপন করেছি জন্মনিয়ন্ত্রণ করার জন্য। অথচ, বাচ্চা জন্মের মূল হোতা হচ্ছেন পুরুষ। তবুও আমরা সন্তান জন্মানো বা রোধ করার জন্য পূর্ণ দায়িত্ব নারীদের কাঁধেই তুলে দিয়েছি।
এই আধুনিক যুগেও যে সকল জন্মনিরোধ পদ্ধতি রয়েছে, তার অধিকাংশ পদ্ধতিই গ্রহণ করতে হচ্ছে নারীদেরকে। যেমন, নন- ক্লিনিক্যালের (যে পদ্ধতিগুলো অন্যের সাহায্য ছাড়া নিজেই ব্যবহার করতে পারে) মধ্যে রয়েছে, ডায়াফ্রাম, সারভাইকেল ক্যাপ, স্পঞ্জ – এসব মিলনের পূর্বে স্ত্রীর জননপথের ভিতরে প্রবেশ করাতে হয়। যা খুবই অস্বস্তিকর এবং সংক্রমণের আশঙ্কা থাকে।
কর্ট্রাসেপটিক পিল- এই পিল ইস্ট্রোজেন এবং প্রোজেস্টেরন হরমোন দ্বারা তৈরি হয়। চিকিৎসা বিজ্ঞনীরা বলেন, ‘ইস্ট্রোজেন এবং প্রোজেস্টরন সমন্বিত পিল ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়ায়।’ এই পিলের ক্ষতিকর দিকগুলি বড়ই ভয়াবহ। যেমন, স্তনে ব্যথা, মেদ বাড়ানো, জরায়ুর আকার ছোট হওয়া, বমি বমি ভাব বা বমি হওয়া, মাথা ঘুরা, যৌন শক্তি হ্রাস, রজঃস্রাবের সময় তলপেটে তীব্র ব্যথা, সাদা স্রাব, যোনি ও যোনিমুখে ক্যানডিয়ার আক্রমন, জরায়ুতে ফ্রাইব্রয়েড নামক ক্যান্সার হওয়া, স্তন ক্যান্সার, ওভারিয়ান ক্যান্সার, লিভার ক্যান্সার ইত্যাদি হওয়ার আশঙ্কা থাকে।
এ ছাড়াও ক্লিনিক্যাল পদ্ধতির ( যে পদ্ধতি প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত সেবাদানকারীর সাহায্য নিতে হয়) মধ্যে রয়েছে, আই, ইউ, সি, ডি এবং নরপ্ল্যান্ট।
বাংলাদেশে বহুল ব্যবহৃত আই, ইউ, সি, ডি’র মধ্যে রয়েছে, কপার টি।
এই কপার টি ব্যবহারের মধ্যেও রয়েছে, মারাত্মক জটিলতা। যেমন, এটা ব্যবহারের ফলে, মাসিকে রক্তক্ষরণ বেড়ে যায়, একটোপিক গর্ভধারণ, তলপেটে ও উরুতে ব্যথা, জরায়ু ছিদ্র হয়ে যাওয়া, পেলভিক সংক্রমণ রোগ, বন্ধ্যাত্বের মতো সমস্যা দেখা দিতে পারে। এ ছাড়া, এটি শতকরা মাত্র ৯৭% গর্ভরোধে কার্যকর।
নরপ্ল্যান্ট – এটি ছোটছোট নরম চিকন ক্যাপসুল। যা নারীদের কনুয়ের উপরের চামড়া কেটে ভিতরে স্থাপন করতে হয়।
সমস্যা- ভারী জিনিস বহনে হাতে ব্যথা হয়, অনিয়মিত রজঃস্রাব, মুখে বা শরীরে মেছতার দাগ, মাথা ব্যথা থাকা, লিভারে সমস্যা হতে পারে, স্তন ক্যন্সার হতে পারে, দুই রজঃস্রাবের মধ্যে ফোঁটা ফোঁটা রক্তস্রাব হতে পারে।
স্থায়ী বন্ধ্যার জন্য রয়েছে, পুরুষের জন্য ভ্যাসেক্টমি এবং নারীদের জন্য রয়েছে টিউবাল লাইগেশন। তবে, এই পদ্ধতি উভয়ের জন্যই মারাত্মক ক্ষতিকর। যেমন ভ্যাসেক্টমির জটিলতার মধ্যে রয়েছে, এক. অপারেশন জনিতঃ বেদনা, অন্ডকোষের ভেতর রক্ত জমে যাওয়া, এবং স্থানিক সংক্রমণ। দুই. স্পার্মগ্রানুলোমাঃ স্থানীয়ভাবে শুক্রাণু জমা হয়ে এ অবস্থার সৃষ্টি করে, তিন. মানসিক সমস্যাঃ যৌন ক্ষমতা কমে যায়, অক্ষমতার দরুন মাথা ব্যথা ও দুর্বলতা ইত্যাদি।
টিউবাল লাইগেশনের জটিলতার মধ্যে রয়েছে, এক. অপারেশনজনিতঃ বৃহৎনালীর ছিদ্র হয়ে যাওয়া, দুই. যৌন ক্ষমতা হ্রাস ও মানসিক সমস্যা।
কিন্তু এই সব মারাত্মক কুফলের মাধ্যম হলেও কতটা নিষ্ঠুরভাবে আমরা নারীদেরকে বাধ্য করছি এগুলো গ্রহণ করতে। নিজেদের খায়েশ পুরোপুরি মেটানোর জন্য আমরা নারীদের শরীর ও মনটাকে কোন গুরুত্বই দিচ্ছিনা। এখন তো আবার সিজারের নামে বাণিজ্যিক মহড়া চলছে প্রতিটি হাসপাতালে। আমাদের পুরুষ শাসিত সমাজে নারীরা কোন দিক দিয়ে মুক্তি পেল? না ব্যক্তির কাছে, না সমাজের কাছে, না রাষ্ট্রের কাছে! নারীদের আমরা ব্যবহার করেই চলছি। সুতরাং জন্মনিয়ন্ত্রণের নামে বন্ধ হোক নারীর উপর সকল অত্যাচার।
আর এ জন্য পুরুষরা কনডম ব্যবহার করা, আযল করা বা বীর্য বাহিরে ফেলা, নিরাপদ কাল মেনে চলা এসবের দিকে অধিক ঝুঁকতে হবে। অধিকাংশ পুরুষই ভাবে যে, কনডম ব্যবহারের ফলে যৌন স্বাদ পুরোপুরি মেটে না, তাই কনডম ব্যবহার না করে নারীকে বাধ্য করে ওসব পদ্ধতি গ্রহণ করতে। শুধু স্বাদের দোহাই দিয়ে, একজন নারীকে তো মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেয়া যায় না। সুতরাং এ জন্য শিক্ষিত নারীদের এগিয়ে আসা উচিৎ এবং পুরুষের অত্যাচার থেকে রক্ষা পেতে নিজেরদেরকে তৈরি করা একান্ত কর্তব্য।
-ফরিদগঞ্জ, চাঁদপুর।
jamalassabet@gmail.com