সর্ব রোগের কারণ সর্বনাশা ক্রোধ
কথায় আছে ক্রোধ ক্রোধ নয় উত্তপ্ত লোহা। আর এ উত্তপ্ত লোহার সঙ্গে যা কিছু ছুঁয়ে যায় তা জ্বলেপুড়ে যায়। এমনকি জল যদি এ উত্তপ্ত লোহায় পড়ে তাহলে জলও শুকিয়ে যায়। ক্রোধে নাশ, ক্রোধে সর্বনাশ। ক্রোধে অনেক সময় মনুষ্যত্ব হারিয়ে যায়। তবে এমন মানুষ নেই যিনি ক্রোধমুক্ত জীবনযাপন করছেন বলে দাবি করতে পারেন। ক্রোধ মানুষকে অমানবিক বানিয়ে দেয়। লোভ যেমন বিবেককে নষ্ট করে, চিন্তা যেমন আয়ু ক্ষয় করায় পরমায়ুকে সংক্ষিপ্ত করে, মোহ যেমন দুঃখ এনে দেয়, অপবিত্রতা যেমন সুস্থ-স্বাভাবিক জীবন হারিয়ে ফেলে, ঠিক তেমনি ক্রোধ নিজেকেও জ্বালায় অন্যকেও কষ্ট দেয়।
সাধারণত অসন্তুষ্টতা, অহঙ্কার, ঈর্ষা, বিরোধিতা বদলা নেয়ার ইচ্ছা, যেকোনো ধরনের অপ্রাপ্তি, ক্ষমতা জাহির দুর্বলতাকে অপ্রকাশিত রাখার চেষ্টা, হতাশা ইত্যাদি থেকে ক্রোধের সৃষ্টি হয়। অনেকে মনে করেন, ব্যক্তিত্বের বিকাশ বা শক্তির বহিঃপ্রকাশ হলো ক্রোধ। কিন্তু ইতিহাসে দেখা যায় ক্রোধ কিভাবে ব্যক্তিত্ব ও শক্তিকে পরাজিত করে ধ্বংসের শ্মশান রচনা করেছে। ক্রোধের বিভিন্ন রূপ আমরা দেখতে পাই, যাকে ক্রোধের অংশ-বংশ বলে আখ্যায়িত করা হয়। যেমন খিটখিটে ভাব, মেজাজিভাব, অসন্তুষ্টতার ভাব, গম্ভীরতার ভাব। দেখা গেছে দৈহিক অত্যাচার, মারধর, ভাংচুর, চিৎকার-চেঁচামেচি করা থেকে আরম্ভ করে আত্মহনন পর্যন্ত সবই ক্রোধের বহিঃপ্রকাশরূপে ব্যক্তি জবিনে পরিব্যাপ্ত।
এক সমীক্ষায় জানা যায় যে ভারতবর্ষে প্রতি তিন মিনিটে একজন আত্মহনন করেন এবং আত্মহননের কেস ডায়েরি থেকে জানা যায় যে ত্রিশ থেকে চল্লিশ শতাংশ আত্মহননের মূল কারণ ক্রোধ। এ ক্রোধ এতই মারাত্মক যে কখনো কখনো সমস্ত পরিবারকে আত্মহননে বাধ্য করে থাকে। এ ক্রোধের জন্য অনেক মহান ব্যক্তি পাঁকে নিমজ্জিত হন, আবার অনেকে এমন সব কাজ করেন যা ধ্বংস ডেকে আনে।
অনেক সময় ক্রোধ দিয়ে কার্য উদ্ধার করার চেষ্টা হয়ে থাকে। কিন্তু ক্রোধের ভয়ে যে কার্য হয় তাতে ভালোবাসা থাকে না। ওয়ার্ক ম্যানেজমেন্টের প্রথম কথাই হলে ‘হ্যান্ড, হেড অ্যান্ড হাট’ হৃদয় দিয়ে কাজ না করলে সে কাজ ভালো হয় না। যেখানে ভালোবাসা আছে, আন্ডারস্ট্যান্ডিং ভালো সেখানে হৃদয় খুলে কাজ করা যায় এবং সফলতাও আসে। গরম লোহাকে যেমন ঠান্ডা লোহা দিয়ে কাটতে হয় তেমনি ক্রোধকে স্নেহ, মধুরতা ও নম্রতা দিয়ে পরিবর্তিত করতে হয়। অন্যথায় ক্রোধে ক্রোধ বাড়ে। কথায় আছে, ‘আগুনে আগুন বাড়ে/ঘিতে বাড়ে বল/ক্রোধে ক্রোধ বাড়ে/শাকে বাড়ে মল।’
এ ক্রোধ থেকে বহু রোগের সৃষ্টি হয় যা জীবনের পক্ষে মারাত্মক ক্ষতিকারক এমনকি মৃতু্যকেও আহ্বান করে নিয়ে আসে। ক্রোধ থেকে রক্ত সঞ্চালনজনিত রোগ, নার্ভের অসুখ, হার্টের অসুখ, ব্রেনের অসুখ, হাইপারটেনশন, এমনিক প্যারালাইসিস জাতীয় রোগেও আক্রান্ত হওয়া আশঙ্কা থাকে।
ক্রোধ বর্তমান বিশ্বায়নের যুগে গ্লোবাল সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। গৃহযুদ্ধ থেকে বিশ্বযুদ্ধের জন্য প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে দায়ী হলো ক্রোধ। ব্যক্তিগতভাবে সামগ্রিকভাবে এ ক্রোধকে বশ করতে না পারলে এর পরিণাম কত ভয়াবহ হতে পারে তা আমেরিকা ও ইরাকের যুদ্ধ থেকে সহজে অনুমান করা যায়।
শরীরের ওপর ক্রোধের প্রভাব যখন দেখা যায় তখন শরীরের তাপমাত্রা বেড়ে যায়। হার্ট ও ব্রেনের ওপর এর মারাত্মক প্রভাব পড়ে। তখন আয়নাতে মুখ দেখলে দেখা যাবে, ‘আয়না ঠিক জায়গায় আছে কিন্তু চেহারা বদলাইয়া গেছে’। মুখ, চোখ লাল হয়ে যায়, মুখের আকৃতি বিকৃত হয়ে যায়, শরীরে একটা খিঁচুনিভাব আসে ও রক্ত সঞ্চালনজনিত বিভিন্ন সমস্যা দেখা দেয়, নার্ভগুলো টেনস অনুভব করে। ফলে কখনো কখনো বুকে ব্যথা অনুভূত হয়। করোনারি আর্টারি রোগে আক্রান্ত হওয়ার এবং ব্রেন সেল ড্যামেজ হওয়ার আশঙ্কা থাকে।
কেউ পাহাড়ে তপস্যায় রত থাকুক আর সংসার জীবনে কর্মরত থাকুক, পরিস্থিতির সময় বা ক্রোধের বাতাবরণের মধ্য থেকে যদি বাহ্যিক ও আন্তরিক, শারীরিক ও মানসিকভাবে সংযত থাকা যায় তাহলে সুখ-শান্তি অনুভব হবে, অন্যথায় নয়।
নিজেকে নিজে ম্যানেজ করার যে পদ্ধতি তাকে বাস্তবায়ন করার নামই সেলফ ম্যানেজমেন্ট লিডারশিপ। অর্থাৎ নিজের মনকে ম্যানেজ করা। কারণ ক্রোধ মনে উৎপন্ন হয় এবং এর বহিঃপ্রকাশ হয় শরীর দিয়ে। এ হলো মনের রোগ। মন চোখে দেখা যায় না কিন্তু এর ক্রিয়া-কলাপ প্রতি মুহূর্তে আমাদের সুস্থ-অসুস্থ হতে সাহায্য করে। এক্ষেত্রে সাধারণত মনের চিকিৎসা নয় শরীরের চিকিৎসা হয়ে থাকে। ফলে মন সেই অবস্থানে থেকে তার কার্যধারা চালিয়ে যায়। মনকে জয় করা বা সংস্কারকে জয় করার জন্য দরকার কিছু নিয়মিত অভ্যাস এবং মনের ব্যায়াম। মনে রাখা দরকার মনকে সুস্থ রাখার জন্য পাঁচ গোল্ডেন কি (চাবি) দরকার। নিয়মিত সরল মেডিটেশনের অভ্যাস, ভেজেটেরিয়ান ডায়েট, পজিটিভ লাইভ স্টাইল, নেশামুক্ত জীবন, সদা আনন্দ খুশি ও শান্তিতে থাকা।
নিয়মিত অভ্যাস
– দেহের ধর্ম নয় দেহীর ধর্মকে প্রয়োগে আনা দরকার। এর জন্য নিয়মিত জ্ঞান ও যোগের পাঠ নিন।
– নির্দোষ দৃষ্টি, ক্রোধমুক্ত রাখতে পারে। যেমন দৃষ্টিতে তেমন সৃষ্টি। উদার, ক্ষমাশীল ও বিশাল হৃদয়ে স্নেহ-প্রেম ভালোবাসার জাগরণ ঘটায়, ফলে ক্রোধের ডালপালা দুরস্ত হয়ে যায়।
– প্রেমপূর্ণ ব্যক্তিত্ব, মধুর ব্যবহার, স্নিগ্ধতা, সুখময় জীবন ক্রোধ থেকে মুক্ত থাকতে সাহায্য করে।
– বদলা নয় বদলে নেয়াই হবে সিচুয়েশনকে ট্যাকল করার হাতিয়ার।
– সহনশীলতা, সরলতা, সহযোগিতা, সহমর্মিতা, পবিত্রতা এগুলো ক্রোধকে নাশ করার মহামন্ত্র।
– রোজ ভোরে উঠে মনে মনে বলবেন, ‘আই অ্যাম ওকে, স্মাইল অ্যান্ড স্মাইল’ অথবা আমি সুস্থ আমার কোনো অসুখ-বিসুখ নেই।
– ক্রোধ এলে জলের দিকে বা মাটির দিকে তাকিয়ে থাকুন, না হলে আল্লাহকে স্মরণ করুন এবং জোরে জোরে নাক দিয়ে নিঃশ্বাস নিন।
– মৌন থাকার অভ্যাস করুন। নিজে ক্রোধমুক্ত থেকে অন্যকেও ক্রোধমুক্ত থাকতে সাহায্য করুন।