টিপাই মুখে বাঁধ ও পাহাড়ি ঢলই মূল কারণ
হুমকির মুখে হবিগঞ্জের ২৫ নদী
মো. নূরুল হক কবির, হবিগঞ্জ: এক সময় স্টিমার লঞ্চের পাশাপাশি চলতো সারি সারি পালতোরা নৌকা। স্টিমারের ভেঁপুর শব্দ আর মানুষের পদচারণায় দিনরাত মুখরিত ছিল হবিগঞ্জ জেলার পূর্বপশ্চিম সীমান্ত দিয়ে বয়ে চলা কালনী-কুশিয়ারা ভেড়ামোহনা নদী। যার উৎপত্তিস্থল ভারতের বরাক নদীর মোহনা থেকে। নৌ-বন্দর শেরপুর-আজমিরীগঞ্জ পর্যন্ত ব্যবসা বাণিজ্য ছিল জমজমাট। নাব্যতা সংকটের কারণে সেই প্রমত্তা কালনী-কুশিয়ারা যা আজমিরীগঞ্জের অংশে ভেড়ামোহনা নদীর তীরে পূর্বের সেই জৌলুস নেই। উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ী ঢলের সাথে পলি জমে ভরাট হয়ে গেছে। এছাড়াও ভারতে টিপাই মুখ অংশে বাঁধ দেয়ার কারণে পানি প্রবাহ কমে গেছে।
হবিগঞ্জ জেলায় প্রায় ২৫টি ছোট বড় নদী ছিল। তার মধ্যে কালনী কুশিয়ারা (ভেড়ামোহনা), মরা কুশিয়ারা, মরা বিবিয়ানা, হাওয়াই, সুটকী, ঝিংড়ী, ঘরদাইর, রত্না, শাখা বরাক, করাঙ্গী, বিজনা, সুতাং, সোনাই, বছিড়া, হাঙ্গর ভাঙ্গা প্রভৃতি নদীসহ ২৫টি নদী বিলিনের পথে। বর্তমানে নদীগুলো পানি প্রবাহ কমে যাওয়ায় সরু খালে পরিণত হয়েছে। শেরপুর, আজমিরীগঞ্জ কাকাইলছেও, সৌলরী ঘাটসহ অর্ধশতাধিক আন্ত:জেলা ও অভ্যন্তরীন নৌ-রোড বন্ধ হয়ে গেছে। নদীতে নৌ-চলাচলের জন্য পানি কম ও ৫০টি পয়েন্ট বন্ধ হওয়ায় হাওর অঞ্চলের হাজার হাজার মানুষ প্রতিদিন প্রয়োজনীয় তাগিদে পায়ে হেটেই চলাচল করছেন।
নদী বিশেষজ্ঞরা বলছেন দীর্ঘদিন ধরে নদ-নদীগুলো ড্রেজিং না করা এবং বিভিন্ন স্থানে এসব নদীর দু’পাড় দখল করে অবকাঠামো নির্মাণ এবং অবাধে বালু উত্তোলন করায় হবিগঞ্জের ৮টি উপজেলার নদ-নদীগুলোর অস্থিত্ব হুমকির মুখে পড়েছে। এসব এলাকার মাটি ধ্বসে পড়ছে এবং পরিবেশ বিপর্যের আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। এছাড়াও সমগ্র হাওর অঞ্চলগুলো মরু ভূমির রূপ ধারণ করতে চলেছে। তবে আশার কথা শুনালেন হবিগঞ্জের পানি উন্নয়নের বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মোহাম্মদ তাওহিদুল ইসলাম। তিনি জানান, গোপলা, বিজনা, রত্না, করাঙ্গী, কাস্ত্মি, সোনাই, সুতাংসহ ৫টি নদীর মোট ২১০ কিলোমিটার নদী খননের জন্য পানি সম্পদ মন্ত্রানালয়ে প্রস্তাবনা প্রেরণ করা হয়েছে। তবে খননের প্রস্তাবনা থেকে বাদ পড়েছে আজমিরীগঞ্জ, বানিয়াচঙ্গ, লাখাই উপজেলার হাওর অঞ্চলের অন্ত্মত ২০টি নদী।
ওয়াটার কিপার ও পরিবেশ আন্দোলন কর্মী তোফাজ্জল সোহেল জানান, খোয়াই, কালনী, কুশিয়ারা (ভেড়ামোহনা) নদী অবলম্বন করে যে সব পরিবার মাঝি-মাল্লা, জেলে চাষী জীবন-জীবীকা নির্বাহ করে আসছিল তারা এখন কর্মহীন হয়ে দুর্বিষহ জীবন যাপন করছেন। অনেকেই বাপ-দাদার আদি পেশা ছেড়ে ভিন্ন পথ অবলম্বন করছেন। আবার অনেকেই রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় গিয়ে নানা পেশায় জড়িয়ে পড়েছেন।
এদিকে হবিগঞ্জের অন্যতম খোয়াই নদী ভারতের ত্রিপুরা পাহাড় থেকে উৎপন্ন হয়ে আগরতলা ও খোয়াই শহরের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়ে চুনারুঘাট উপজেলার উপর দিয়ে লাখাই উপজেলার ‘মাদনা’ নামক স্থানের অল্প উজানে ‘কইরাল’ গ্রামের নিকটে ধলেশ্বরী নদীর সাথে মিলিত হয়েছে। নদীর দৈর্ঘ্য নিয়ে গবেষকদের মধ্যে মতভেদ রয়েছে। নদীটির দৈর্ঘ্য প্রায় ১০৯ মাইল। দু’এক জায়গায় এর গতিপথ পরিবর্তনের ফলে দৈর্ঘ্য কিছুটা হ্রাস পেয়েছে।
হবিগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্রে জানা যায়, বাল্লা সীমান্ত থেকে হবিগঞ্জের বাজুকা-ফরিদপুর গ্রাম পর্যন্ত নদীর দু’পাশে বাঁধের দৈর্ঘ্য ৯০ কিঃমিঃ। বাকী ৩ কিঃমিঃ-এ বাঁধ নেই। সে হিসেবে খোয়াই নদীর হবিগঞ্জের অংশের দৈর্ঘ্য দাঁড়ায় ৯৩ কিলোমিটার। খোয়াই একসময় খরস্রোতা নদী ছিল। উজানে ভারত সরকারের পানি সীমিতকরণ, দেশের প্রভাবশালী মহল দ্বারা দখল, ড্রেজিং না হওয়া ইত্যাদি কারণে নদীটির ধারা দিন দিন ক্ষীণতর হয়ে যাচ্ছে। অথচ এই নদীর উপর নির্ভরশীল জেলার কৃষি ও বাণিজ্যের বিশাল একটি অংশ। খোয়াই হবিগঞ্জ শহরবাসীর জন্য দুঃখ হিসেবে খ্যাত ছিল। বর্ষাকালে অতিবৃষ্টি ও পাহাড়ী ঢলে হবিগঞ্জ শহরের উপর দিয়ে প্রবাহিত খোয়াই ভয়াবহ রূপ ধারণ করত। খোয়াই’র প্লাবনে শহরের বাসা-বাড়ি, দোকান-পাট, হাট-বাজার, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, অফিস-আদালত ভাসিয়ে দিয়ে শহরবাসীর দুদর্শা সৃষ্টি করতো। যার জন্য ৭০ দশকের শেষের দিকে স্বেচ্ছাশ্রমের মাধ্যমে দুই দফায় মোট ৫ কিলোমিটার ‘লুপ কাটিং’ (আঁকা বাঁকা সোজা করা) করে নদীর গতিপথ সোজা পথে প্রবাহিত করা হয়। হবিগঞ্জ শহর রক্ষা পায় প্লাবনের হাত থেকে। কিন্তু বিগত ৩ যুগেও শাসনকৃত নদীতে সরকারের পক্ষ থেকে ড্রেজিং কিংবা সংস্কারের কোন উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়নি। এছাড়াও সুষ্ঠু পরিকল্পনা এবং অসচেতনতার জন্য নদীটির নাব্যতা শুধু হ্রাসই পায়নি বরং নদীনির্ভর জীবনযাত্রাকেও বিপন্ন করছে। কোথাও কোথাও শহর থেকে ১২/১৫ ফুট উঁচুতে উঠে গেছে নদীর তলদেশ। ফলে নদীর বন্যা পরিস্থিতির কাছে শহরটি হয়ে উঠেছে ঝুঁকিপূর্ণ।