ইসলামী দলগুলোতে নতুন মেরুকরণ
জামাল উদ্দিন: জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে নতুনভাবে মেরুকরণ শুরু হয়েছে ইসলামী দলগুলোতে। প্রায় প্রতিদিনই দলগুলোর নেতারা পরস্পরের সঙ্গে বোঝাপড়া করছেন, কিভাবে আগামী জাতীয় সংসদে আলেমদের অংশগ্রহণ বেশি রাখা যায়। হেফাজতে ইসলামের আন্দোলন, সরকারের দমন-পীড়ন ও পাঁচ সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে ১৪ দল তথা সরকার সমর্থিত প্রার্থীদের ভরাডুবিতে ইসলামী দলগুলোর নেতারা এখন ফুরফুরে মেজাজে রয়েছেন। তাদের দাবি, ইসলামী আচার-আচরণ ও আকিদা নিয়ে বিদ্বেষ, দেশের আলেম-ওলামাদের সঙ্গে সরকারের দমন-পীড়নই এ ভরাডুবির অন্যতম কারণ। পাঁচ সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনের পর পারস্পরিক যোগাযোগ ছাড়াও সরকারবিরোধী ইসলামী দলগুলোর নেতাদের মধ্যে একাধিক বৈঠক হয়েছে। কোনো কোনো ইসলামী দল পার্লামেন্টারি বোর্ড গঠন করে দেশব্যাপী নির্বাচনী কার্যক্রম শুরু করেছে। বিএনপির নেতৃত্বাধীন ১৮ দলীয় জোটের বাইরে থাকা ইসলামী দলগুলোকে জোটভুক্ত করে দরকষাকষির মাধ্যমে তাদের কাছ থেকে আলেমদের জন্য বেশি আসন নিতে চান তারা।
দলীয় সূত্রগুলো জানায়, ইসলামী ঐক্যজোটের চেয়ারম্যান মাওলানা আবদুল লতিফ নেজামী, খেলাফত মজলিসের সভাপতি মাওলানা মোহাম্মদ ইসহাক, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের আমীর মাওলানা হাবিবুর রহমান, মাওলানা আবদুর রব ইউসুফী, খেলাফত আন্দোলনের মহাসচিব মাওলানা জাফরুল্লাহ খান, জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের সিনিয়র নায়েবে আমীর মাওলানা নূর হোসাইন কাসেমী, মহাসচিব ও সাবেক ধর্ম প্রতিমন্ত্রী মুফতি মুহাম্মদ ওয়াক্কাসসহ শীর্ষস্থানীয় আলেমদের মধ্যে ইতিমধ্যেই কখনও দলীয় এবং কখনও ব্যক্তিগতভাবে দফায় দফায় বৈঠক হয়েছে। সর্বশেষ ৮ ও ৯ জুলাই পল্টন ও বারিধারায় দুটি স্থানে তাদের মধ্যে বৈঠক হয়েছে। এসব বৈঠকে তারা বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিয়েছেন বলে সূত্রগুলো নিশ্চিত করেছে। এসব নেতা হেফাজতের আন্দোলনের সঙ্গেও ওতপ্রোতভাবে জড়িত রয়েছেন। অরাজনৈতিক হওয়ায় হেফাজতের ব্যানারে নির্বাচন সম্ভব নয়। তবে হেফাজতের ব্যানারে যেভাবে তারা ঐক্যবদ্ধ হয়েছিলেন সেটা ধরে রাখার বিষয়ে তারা একমত হয়েছেন। নিজেদের মধ্যে ভুল বুঝাবুঝি ও মতবিরোধ থাকলেও বৃহত্তর স্বার্থে সেটা আপাতত ভুলে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকারের বিরুদ্ধে আগামী নির্বাচনে তারা একাট্টা হয়েই থাকতে চান। ৫ মে মধ্যরাতে মতিঝিলে হেফাজতে ইসলামের অবরোধ ও অবস্থান কর্মসূচিতে আইনশৃংখলা বাহিনীর অভিযান ও পরে মামলা, গ্রেফতা এবং হেফাজতের বিরুদ্ধে সরকারের শীর্ষ নেতাদের নানা মন্তব্যের কারণে বর্তমান সরকারের ওপর চরমভাবে ক্ষুব্ধ হন এক শ্রেণীর ওলামায়ে কেরাম। হেফাজতের সঙ্গে সরকারের এমন রূঢ় আচরণের কারণে জামায়াতের সঙ্গে আদর্শগতবিরোধী ইসলামী দলগুলোর অবস্থানও এখন এ সরকারের বিরুদ্ধে। পাঁচ সিটি নির্বাচনে তারা সেই জবাব সরকারকে দিতে পেরেছেন বলেও মনে করেন ইসলামী দলগুলোর নেতারা। সেটাকে ধরে রেখে মাঠপর্যায়ে সাধারণ মানুষের সামনে সরকারের ইসলাম ও আলেম-ওলামাবিদ্বেষী আচরণের বিষয়টি অব্যাহতভাবে তুলে ধরবেন বলে জানান নেতারা।
আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে উল্লেখযোগ্য সংখ্যাক আসনে ইসলামী দলগুলোর নেতাদের অংশ গ্রহণের তৎপরতার বিষয়টি স্বীকার করে ১৮ দলীয় জোটের অংশীদার ইসলামী ঐক্যজোটের শরিক দল নেজামে ইসলাম পার্টির সভাপতি মাওলানা আবদুর রকিব অ্যাডভোকেট যুগান্তরকে জানান, আগামীতে বেশি সংখ্যক আলেমদের কিভাবে জাতীয় সংসদে পাঠানো যায়, সেটা নিয়ে তাদের মধ্যে আলোচনা চলছে। তবে নির্বাচন প্রক্রিয়া ও ১৮ দলের আরেক অংশীদার জামায়াতে ইসলামীর পরবর্তী ভূমিকা সম্পর্কে পরিষ্কার না জানা পর্যন্ত চূড়ান্ত কোনো সিদ্ধান্ত নেয়া যাচ্ছে না। তিনি বলেন, জামায়াত ছাড়া অন্য ইসলামী দলগুলোর মধ্যেই এ আলোচনা সীমাবদ্ধ রয়েছে। ১৮ দলীয় জোটে সম্পৃক্ত হওয়া ও জাতীয় সংসদে আলেমদের অংশগ্রহণ বাড়ানোর বিষয়ে ইসলামী দলগুলোর তৎপরতা প্রসঙ্গে খেলাফত আন্দোলনের যুগ্ম মহাসচিব মাওলানা মজিবুর রহমান হামিদী বলেন, আমাদের কেউ কেউ ১৮ দলীয় জোটের সঙ্গে সম্পৃক্ত হতে চেষ্টা চালাচ্ছেন এবং বলছেন জাতীয় নির্বাচনে আলেমদের অংশগ্রহণ বাড়ানোর বিষয়েও নানাভাবে আলোচনা হচ্ছে। তবে সব কিছুর আগে ভাবতে হবে, হেফাজতে ইসলামের ১৩ দফা দাবি আদায় ও পূরণে কারা কি ভূমিকা নিচ্ছে। সেটার ওপরই নির্ভর করছে তার দলের পরবর্তী করণীয়। বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের মহাসচিব মোহাম্মদ হুমায়ুন কবির যুগান্তরকে বলেন, ১৮ দলীয় জোটে যাওয়াসহ নতুন নির্বাচনী জোট গঠনের আলোচনা চলছে। জাতীয় সংসদে আলেমদের অংশগ্রহণ বাড়ানোর বিষয়ে তাদের মধ্যে কোনো দ্বিমত নেই জানিয়ে তিনি বলেন, সরকারবিরোধী নতুন যেকোনো জোটেই তারা অংশ নিতে পারেন। তবে সেটা তাদের দলীয় শূরা বৈঠকে সিদ্ধান্ত হবে। ১৮ দলীয় জোটের আরেক শরিক দল জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের প্রচার সম্পাদক মাওলানা ওয়ালী উল্লাহ আরমান বলেন, আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নিতে তার দল এরই মধ্যে বিভিন্ন কার্যক্রম হাতে নিয়েছে। এ মাসের শুরুতেই দলের নির্বাহী সভাপতি আল্লামা মোস্তফা আযাদকে আহ্বায়ক করে সাত সদস্যের পার্লামেন্টারি বোর্ড গঠন করা হয়েছে। এছাড়াও সাংগঠনিক সম্পাদক মাওলানা ওবায়দুল্লাহ ফারুককে সমন্বয়ক করে বিভাগীয় পর্যায়ে উপ-কমিটি গঠন করা হয়েছে। এসব কমিটি আগস্টের দ্বিতীয় সপ্তাহের মধ্যেই প্রার্থী বাছাই করে কেন্দ্রকে রিপোর্ট দেবে। পরে পার্লামেন্টারি বোর্ড তাদের প্রার্থী চূড়ান্ত করে জোটের সঙ্গে প্রার্থিতা নিয়ে আলোচনা চালাবে। এদিকে ইসলামী আন্দোলন এককভাবেই নির্বাচনে যাওয়ার প্রস্তুতি নিয়েছে। দলটি ২৫০ আসনে প্রার্থীও চূড়ান্ত করেছে।
ইসলামী দলগুলোর নেতারা জানান, রাজনৈতিক মতাদর্শ ও নানা স্বার্থ-সংশ্লিষ্ট বিষয় নিয়ে মতানৈক্য থাকলেও সংবিধানে ‘আল্লাহর ওপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস পুনঃস্থাপন’ এবং আল্লাহ ও রাসূল (সাঃ) কে কটূক্তিকারী নাস্তিক-মুরতাদদের শাস্তির দাবিতে সংসদে আইন পাস ও নারীনীতিসহ ইসলামের আরও কিছু বিধি-বিধানের বিষয়ে ইসলামী দলগুলোর মধ্যে কোনো মতানৈক্য নেই। হেফাজতে ইসলাম উত্থাপিত ১৩ দফা দাবির সঙ্গেও একমত পোষণ করে ইসলামী দলগুলো।