তাহাজ্জুদের গুরুত্ব ও ফজিলত
মো: জাহিদ: তাহাজ্জুদ শব্দটি নিদ্রা যাওয়া ও জাগ্রত হওয়া পরস্পরবিরোধী দুটি অর্থে ব্যবহৃত হয়। যেমন পবিত্র কুরআনে বর্ণিত আছে- ‘রাত্রির কিছু অংশ কুরআন পাঠসহ জাগ্রত থাকুন’ (সূরা বনি ইসরাইল:৭৯)। কুরআন পাঠসহ জাগ্রত থাকার অর্থ নামাজ পড়া। এ কারণেই রাত্রিকালীন নামাজকেই তাহাজ্জুদের নামাজ বলা হয়। তবে বেশির ভাগ মুফাসসিরের মতে, শয্যা পরিত্যাগ করে জিকির ও দোয়ায় আত্মনিয়োগ করার অর্থ তাহাজ্জুদ ও নফল নামাজ, যা গভীর রাতে ঘুম থেকে ওঠার পর পড়া হয়। তাহাজ্জুদ মেরাজের পর তা নফল হয়ে যায়।
তাহাজ্জুদ নামাজ পড়ার ফজিলত মহান আল্লাহ তায়ালা বলেন- ‘রাত্রির কিছু অংশে তাহাজ্জুদ কায়েম করো; এটা তোমার জন্য এক অতিরিক্ত কর্তব্য। আশা করা যায়, তোমর প্রতিপালক তোমাকে প্রতিষ্ঠিত করবেন প্রশংসিত স্থানে’ (সূরা বনি ইসরাইল:৭৯)।
এ নামাজ মন ও চরিত্রকে নির্মল ও পবিত্র করা এবং সত্য পথে অবিচল রাখার জন্য অপরিহার্য ও অত্যন্ত কার্যকর পন্থা। কুরআনের সূরা মুজাম্মিলে-এর উল্লেখ করা হয়েছে, ‘নিশ্চয়ই রাতে ঘুম থেকে ওঠা নফসকে দমিত করার জন্য খুব বেশি কার্যকর এবং সে সময়ের কুরআন পাঠ বা জিকির একেবারে যথাযথ।’ রাতের তাহাজ্জুদ নামাজ হলো সব আম্বিয়াদের সুন্নত, আল্লাহ তায়ালার মাহবুব বান্দাদের অভ্যাস আর আল্লাহর সঙ্গে বান্দার গভীর সম্পর্ক স্থাপন তথা নৈকট্য ও সন্তোষ অর্জনের অন্যতম পন্থা। তাহাজ্জুদের ফজিলত প্রসঙ্গে আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘রাতের কিছু অংশে তাহাজ্জুদ নামাজ কায়েম করুন; এটা আপনার জন্য এক অতিরিক্ত কর্তব্য। আশা করা যায়, আপনার প্রতিপালক আপনাকে মাকামে মাহমুদ দান করবেন।’
হাদিসের আলোকে তাহাজ্জুদের গুরুত্ব : এই নফল নামাজকে মহানবী সা: শ্রেষ্ঠ নফল ইবাদত হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ ফরজ হওয়ার আগে রাসূলুল্লাহ সা:-এর ওপর তাহাজ্জুদ নামাজ বাধ্যতামূলক ছিল। তাই তিনি জীবনে কখনো তাহাজ্জুদ নামাজ পড়া থেকে বিরত হননি। হজরত ইবনে আব্বাস রা: বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি এশার পর দুই বা ততধিক রাকায়াত নামাজ পড়ে নেয়, যে হবে তাহাজ্জুদের ফজিলতের অধিকারী। মাহে রমজানে দিবাভাগে পানাহার বর্জন করে রোজা পালনের পর গভীর রাতে নিদ্রাসুখ ত্যাগ করে তাহাজ্জুদের নামাজ আদায়ের গুরুত্ব ও ফজিলত রয়েছে। তাহাজ্জুদ নামাজের ফজিলত সব নফল ইবাদত অপেক্ষা অধিক এবং এটি আল্লাহর কাছে অতি প্রিয়।
এতে সালাতের মহত্ত্ব, মর্যাদা ও গুরুত্বের প্রতিফলন ঘটে। রব ও স্রষ্টার সাথে সম্পর্ক স্থাপনে অভিপ্রায়ী একজন মুসলমানের কর্তব্য হলো, সে এ মহান ইবাদতটির মর্যাদা ও গুরুত্ব অনুধাবন করবে। এবং তার যথার্থতা বজায় রাখতে সচেষ্ট হবে। এ ছাড়াও সালাতের অনেক লাভ ও ফজিলত আছে।
তাহাজ্জুদ এবং শেষ রাতে জাগ্রত থাকা অবসাদগ্রস্থতার চিকিৎসা : অভিজ্ঞতা এবং গবেষণার একথা দিবালোকের মতো সত্য প্রমাণিত হয়েছে যে, রুগ্ন,অসুস্থ,অর্ধমৃত এবং অনিদ্রার রোগীদের নানা রকমের চিকিৎসা থাকা সত্ত্বেও দুনিয়া ও আখিরাতের জন্য কল্যাণকর একটি চিকিৎসাও রয়েছে।
তারা যদি রাতের শেষ দিকে জেগে কাটায়, তবে তাদের দেহ অবশ্যই এর সুফল লাভ করে। মনস্তত্ত্বের চিকিৎসক এবং মস্তিস্ক বিশেষজ্ঞরা এ সম্পর্কে প্রমাণিত কিছু গবেষণার কথা উল্লেখ করেছেন। তারা বলেছেন, রমজানে মুসলমানদের মধ্যে ডিপ্রেসন বা অবসাদ রোগ কম দেখা যায়। রমজান মাসে চিকিৎসকের কাছে অবসাদের রুগী খুব কম আসে। এর কারণ তারা ঊল্লেখ করেন, রমজান মাসে মুসলমানরা রাত্রী শেষে সাহরি খায়, তাহাজ্জুদ আদায় করে, ফলে তাদের মধ্যে ক্লান্তি এবং অবসাদ দেখা দেয় না। এ কারণে চিকিৎসকরা এরকম সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন যে, শেষ রাতে জেগে থাকা স্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত উপকারী।
তাহাজ্জুদের নামাজ নিয়ে লাহোরে আল্লামা ইকবাল মেডিক্যাল কলেজে মনোস্তত্ত্ব ও মস্তিষ্ক বিভাগে নিয়মিত আদায় করার উপর গবেষণার ফলাফল নিচে দেয়া হল: ১৯৮৫ সালে জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত লাহোরে আল্লামা ইকবাল মেডিক্যাল কলেজে মনস্তত্ত্ব ও মস্তিষ্ক বিভাগে ৬৪ জন অবসাদগ্রস্ত রোগী মনোনীত করে তাদের ৩২ জন ৩২ জন করে দুই গ্রুপে পৃথক করা হয়। প্রথম গ্রুপ (রিসার্স গ্রুপ ) ৩২ জনকে রাতে তাহাজ্জুদের নামাজ বাধ্যতামূলক করা হয়। সাথে জিকির ও কুরআন তিলাওয়াত ও (ক) ‘আলা বিজিকরিল্লাহি তাৎমাইননুল কুলুব’ (খ) ‘ওয়া ইয়া মারিদতু ফাহুয়া ইয়াশ ফিল’ মনে মনে পাঠ করতে বলেন। দ্বিতীয় দল (কন্ট্রোল গ্রুপ) তারা রাত ২টা থেকে ৪টা পর্যন্ত জাগবে ছোট ছোট কাজ করবে ও কুরআন তিলাওয়াত করবে।
এ সব রোগী দীর্ঘদিন থেকে অবসাদগ্রস্ত ওষুধ সেবন করত তা বন্ধ করে দেয়া হয়। চার সপ্তাহ পর হেমিলটন ডিপ্রেশন স্কেল দিয়ে পরীক্ষা করা হয়। দেখা যায়, প্রথম গ্রুপ (রিসার্স গ্রুপ) যারা তাহাজ্জুদ আদায়সহ কুরআন তিলাওয়াত করেছে তাদের অবস্থা দ্বিতীয় গ্রুপের চেয়ে অনেক ভালো। এভাবে জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত নিয়মিত অনুসরণ করার ফলে প্রথম গ্রুপ (রিসার্স গ্রুপ) থেকে ২৫ জন, রোগী দ্বিতীয় গ্রুপ (কন্ট্রোল গ্রুপ) থেকে পাঁচজন রোগী আরোগ্য লাভ করেছেন।
গবেষণা করে দেখা যায়, তাহাজ্জুদের নামাজ একজন মুসলমানের জন্য অত্যন্ত উপকারী।
লেখক : প্রবন্ধকার