‘কওমি মাদরাসা চালাতে বিদেশী অর্থ নয়’
মহিউদ্দীন জুয়েল, চট্টগ্রাম থেকে: কওমি মাদরাসা চালাতে বিদেশীদের কাছ থেকে কোন ধরনের আর্থিক সহায়তা নেবেন না বলে সাফ জানিয়ে দিলেন হেফাজতে ইসলামের নেতাকর্মীরা। বললেন, কওমি মাদরাসার আলেমদের ওপর সারাদেশে নির্যাতন চলছে। তাদের ওপর নির্যাতন চালিয়ে ঈমান স্তব্ধ করে দেয়ার ষড়যন্ত্র করা হচ্ছে। নাস্তিক, মুরতাদদের শক্তিশালী অবস্থান তৈরি করতে মামলা দিয়ে ভয় দেখানো হচ্ছে মাদরাসা ছাত্রদের। বর্তমান পরিস্থিতিতে এক আল্লাহ ছাড়া আর কারও সাহায্য নেবেন না সারাদেশের সব কওমি মাদরাসার শিক্ষার্থীরা। তাছাড়া, এখানে মন-মানসিকতা, আদর্শ, ধর্মীয় মূল্যবোধের বিষয়টি ওতপ্রোতভাবে জড়িত। তবে বিদেশীদের কাছ থেকে পরামর্শ নিতে আপত্তি নেই হেফাজতে ইসলামের।
গতকাল বৃহস্পতিবার বিকালে এক ঝটিকা সফরে চট্টগ্রাম আসেন অস্ট্রেলিয়া দূতাবাসের ডেপুটি হাইকমিশনার টিম বলটনিকফ। এই সময় তিনি হেফাজতে ইসলাম সমর্থিত নগরীর লালখান বাজার ‘জামেয়াতুল উলুম আল ইসলামিয়া’ মাদরাসায় বৈঠক করেন দলটির সিনিয়র নেতাদের সঙ্গে। সেখানে তাকে এসব কথা জানান হেফাজত নেতারা। এই সময় ডেপুটি হাইকমিশনারের সঙ্গে দেশের বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে কথা বলেন তারা। একই সঙ্গে হেফাজতের নেতা-কর্মীদের বর্তমান দাবি-দাওয়া, তাদেরকে নিয়ে রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র, সরকারি ও বিরোধী দলের মনোভাব, সমর্থন, শাহবাগের ঘটনাসহ বিভিন্ন বিষয় তুলে ধরেন।
প্রায় ৪০ মিনিটেরও বেশি সময় ধরে হেফাজতের মাদরাসায় অবস্থান করেন বাংলাদেশে নিযুক্ত অস্ট্রেলিয়া দূতাবাসের ডেপুটি হাইকমিশনার টিম বলটনিকফ। তিনি খুব মনোযোগ দিয়ে তাদের কথা শোনেন। বিভিন্ন বিষয়ে তার অভিমত জানান। বিকাল সাড়ে ৪টায় টিম বলটনিকফ মাদরাসায় ঢুকে বিভিন্ন ছাত্রদের সঙ্গে কুশল বিনিময় করেন। এই সময় তার সঙ্গে একজন নারী ট্রান্সলেটরও (অনুবাদক) দেখা যায়। যিনি হেফাজত ইসলামের বিভিন্ন কথা, তর্জমা বাংলা থেকে ইংরেজিতে অনুবাদ করে তার মতামত তুলে ধরেন। পরে মাদরাসার ভেতরের গাছ থেকে ডাব পেরে খান টিম বলটনিকফ।
হেফাজত সমর্থিত ‘জামেয়াতুল উলুম আল ইসলামিয়া’ মাদরাসায় ঢুকে অবাক হয়ে যান অস্ট্রেলিয়ান ডেপুটি কমিশনার। তিনি মাথায় টুপি পরা শ’ শ’ তরুণদের দেখে বলেন, ‘ধর্মের প্রতি বাংলাদেশের মানুষের এই শ্রদ্ধা তাদেরকে দেশ গড়ার কাজে অনেক বেশি অনুপ্রেরণা যোগাবে। নিঃসন্দেহে দেশটির প্রতিটি মানুষ অসাম্প্রদায়িক। তারা প্রত্যেকে যার যার ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। সেই তাড়না থেকেই ধর্মীয় শিক্ষার প্রতি অনুরাগী হয়ে তারা আরও বেশি গবেষণা করতে এই ধরনের প্রতিষ্ঠান থেকে শিক্ষা নিচ্ছে।’
কওমি শিক্ষা নিয়ে বিস্ময় প্রকাশ করে টিম বলটনিকফ বলেন, ‘বাংলাদেশে এসে আমি এই ধরনের একটি শিক্ষা পদ্ধতির কথা জানতে পেরেছি। এই শিক্ষার শিক্ষার্থী কারা, তাদের পাঠদানের বিষয়বস্তু কি, কিভাবে পরিচালিত হয় এসব বিষয় কাছ থেকে দেখার খুব দরকার ছিল। সেই কারণে চট্টগ্রামে এসে আমি এখানে পরিদর্শন করতে এসেছি। তবে এই শিক্ষার নাম আগে কখনও শুনিনি।’
মাদরাসার ছাত্রদের সহযোগিতা করার প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘বিভিন্ন মাদরাসায় আমরা ছাত্রদের দক্ষতা বাড়াতে ভাষা কোর্স চালু করার বিষয়ে সহযোগিতা করছি। পুরস্কার বিতরণের মাধ্যমে তাদেরকে উচ্চ শিক্ষার প্রতি আরও বেশি উদ্বুদ্ধ করছি। কওমি মাদরাসার ছাত্ররা চাইলে যে কোন ধরনের সহযোগিতা আমাদের কাছ থেকে পেতে পারে।’
অস্ট্রেলিয়ান দূতাবাসের ডেপুটি হাইকমিশনার টিম বলটনিকফের বক্তব্য শোনার পর তার সঙ্গে কথা বলেন হেফাজতে ইসলামের নায়েবে আমীর ও লালখান বাজার মাদরাসার প্রধান মুফতি ইজহারুল ইসলাম, নায়েবে আমীর মুহিবুল্লাহ বাবুনগরী, হারুন ইজহার, আজিজুল হক ইসলামাবাদীসহ অন্তত ১০ জন সিনিয়র নেতা।
মুফতি ইজহারুল ইসলাম তার উদ্দেশে বলেন, ‘এখানে যেসব ছাত্র পড়াশোনা করে তারে বেশির ভাগই ধর্মীয় শিক্ষায় উজ্জীবিত। তারা এক আল্লাহ ছাড়া আর কারও নেতৃত্ব মানে না। ইসলাম নিয়ে সব ধরনের ষড়যন্ত্রে ওরা সব সময় সোচ্চার। সেই কারণে বহুবার তাদের ওপর রাষ্ট্র থেকে খড়গ নেমে এসেছে।’
নায়েবে আমীর মুহিবুল্লাহ বাবুনগরী বলেন, ‘ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দিয়ে এক শ্রেণীর নাস্তিক দেশের শান্ত পরিবেশ অশান্ত করার ষড়যন্ত্র করছে। তাদেরকে সমর্থন দিচ্ছে সরকারের লোকজন। প্রতিবাদ করতে গিয়ে বহু লোক রাতের আঁধারে পুলিশের হামলার শিকার হয়েছে। সারাদেশে মামলার শিকার হয়েছে। রাত হলেই মাদরাসায় থাকা দুরূহ হয়ে পড়েছে। অথচ এসব ছাত্র কোন রাজনৈতিক দলের কর্মী নয়।’
মাদরাসায় বৈঠক শেষে খুব দ্রুত গাড়িতে উঠে বসেন অস্ট্রেলিয়ার ডেপুটি হাইকমিশনার। এই সময় তার আসার সফর প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তিনি কোন ধরনের কথা বলতে রাজি হননি। পরে হেফাজতে ইসলামের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক মাওলানা আজিজুল হক ইসলামাবাদীর সঙ্গে কথা হলে তিনি বলেন, ‘বৈঠক হয়েছে। এখানে মূলত তিনি কওমি মাদরাসাগুলো কিভাবে পরিচালিত হয় তা দেখার জন্য এসেছিলেন। অস্ট্রেলিয়ান হাই কমিশনারের সঙ্গে আমাদের মাদরাসার মুফতি সাহেব কথা বলেছেন। বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কথা হয়েছে।’
কি কথা হয়েছে-এমন প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, ‘অস্ট্রেলিয়ান ডেপুটি হাইকমিশনার সাহেব কওমি মাদরাসাগুলোতে আর্থিক সহায়তা দেয়ার ব্যাপারে ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন। বলেছেন কোন ধরনের সহযোগিতা চাইলে তিনি করবেন। আমরা তার ইচ্ছাকে স্বাগত জানিয়ে বলেছি আপাতত কোন ধরনের অর্থের প্রয়োজন নেই। তবে ভবিষ্যতে যদি ধর্মীয় শিক্ষার প্রসারে কোন ধরনের সহযোগিতা লাগে তখন সাহায্যের বিষয়টি ভাবা যেতে পারে।’
মাওলানা অজিজুল হক আরও বলেন, ‘উনি ৪০ মিনিট ছিলেন। তার সঙ্গে যেসব কথোপকথন হয়েছে তা লিখে নিয়েছেন। দেশের সাম্প্রতিক পরিস্থিতি নিয়েও কথা হয়েছে তার সঙ্গে। তিনি সব কথা মনোযোগ দিয়ে শুনেছেন। চলে যাওয়ার সময় বলেছি, আদর্শগতভাবে মিল থাকলে অস্ট্রেলিয়ান সরকার কিংবা রাষ্ট্রপ্রধান থেকে যে কোন ধরনের সহযোগিতা নিতে আমাদের আপত্তি নেই।’