আহলান সাহলান মাহে রমাদান
মনির হোসেন হেলালী: প্রতি বছর আমাদের মাঝে আগমন করে মাহে রমাদান। এ রমাদান আগমনের একটি সুস্পষ্ট লক্ষ্য-উদ্দেশ্য রয়েছে, রয়েছে তার কিছু আহ্বান। রমাদান শব্দটি বিশ্লেষণ করলেই তার সুস্পষ্ট প্রমাণ পাওয়া যায়। অভিধানের পাতায় চোখ রাখলে দেখা যায়, রমাদান শব্দটি ‘রমযুন’ থেকে এসেছে। এর আভিধানিক অর্থ জালিয়ে দেয়া, নষ্ট করে দেয়া, নিঃশেষ করে দেয়া ইত্যাদি। যেহেতু এমাসে বান্দার ভাল আমলের কারণে তার গুনাহগুলোকে জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে শেষ করে দেয়া হয় সেহেতু একে রমাদান বলা হয়। এ মাসে বান্দার উপর সিয়াম ফরয করা হয়েছে। সিয়ামের শাব্দিক অর্থ বিরত থাকা, দূরে থাকা, সরে থাকা ইত্যাদি। যেহেতু এমাসে সুবহে সাদিক থেকে শুরু করে সূর্যাস্ত পর্যন্ত নিয়তসহ যাবতীয় পানাহার, যৌন ক্রিয়া এবং সব ধরনের অন্যায় থেকে বিরত থাকা হয় এজন্য একে সিয়াম বলা হয়। সিয়ামকে ফার্সি ভাষায় রোযা বলা হয়। রোযার প্রধান টার্গেটই হলো রোযাদারকে মুত্তাকি করে গড়ে তোলা। এর সাথে সম্পর্কিত গুরুত্বপূর্ণ কিছু বিষয় নিয়ে নিম্নে আলোচনা করা হলো।
ইসলামের অন্যান্য বিধানের মতো রোযাও পর্যায়ক্রমে ফরয হয়। শুরুতে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মুসলমানদেরকে প্রতি মাসে মাত্র তিন দিন রোযা রাখতে নির্দেশ দিয়েছিলেন। এ রোযা ফরয ছিলো না। তারপর দ্বিতীয় হিজরিতে রমযান মাসের রোযার এ বিধান কুরআনে নাযিল হয়। তবে এতে এতটুকুন সুযোগ দেয়া হয়, রোযার কষ্ট বরদাশত করার শক্তি থাকা সত্ত্বেও যারা রোযা রাখবেন না তারা প্রত্যেক রোযার বদলে একজন মিসকিনকে আহার করাবেন। পরে দ্বিতীয় বিধানটি নাযিল হয়। এতে পূর্ব প্রদত্ত সাধারণ সুযোগ বাতিল করে দেয়া হয়। কিন্তু রোগী, মুসাফির, গর্ভবতী মহিলা বা দুগ্ধপোষ্য শিশুর মাতা এবং রোযা রাখার ক্ষমতা নেই এমন সব বৃদ্ধদের জন্য এ সুযোগটি আগের মতোই বহাল রাখা হয়। পরে ওদের অক্ষমতা দূর হয়ে গেলে রমযানের যে কয়টি রোযা তাদের বাদ গেছে সে ক’টি পূরণ করে দেয়ার জন্য তাদের নির্দেশ দেয়া হয়।
রমাদান এর ব্যাপারে আল কুরআনের ঘোষণা হচ্ছে- “হে মুমিনগণ, তোমাদের ওপর সিয়াম ফরয করা হয়েছে, যেভাবে ফরয করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তীদের ওপর। যাতে তোমরা তাকওয়া অবলম্বন কর। নির্দিষ্ট কয়েক দিন। তবে তোমাদের মধ্যে যে অসুস্থ হবে, কিংবা সফরে থাকবে, তাহলে অন্যান্য দিনে সংখ্যা পূরণ করে নেবে। আর যাদের জন্য তা কষ্টকর হবে, তাদের কর্তব্য ফিদইয়া একজন দরিদ্রকে খাবার প্রদান করা। অতএব যে স্বেচ্ছায় অতিরিক্ত সৎকাজ করবে, তা তার জন্য কল্যাণকর হবে। আর সিয়াম পালন তোমাদের জন্য কল্যাণকর, যদি তোমরা জান।
রমযান মাস, যাতে কুরআন নাযিল করা হয়েছে মানুষের জন্য হিদায়াতস্বরূপ এবং হিদায়াতের সুস্পষ্ট নিদর্শনাবলী ও সত্য-মিথ্যার পার্থক্যকারীরূপে। সুতরাং তোমাদের মধ্যে যে মাসটিতে উপস্থিত হবে, সে যেন তাতে সিয়াম পালন করে। আর যে অসুস্থ হবে অথবা সফরে থাকবে তবে অন্যান্য দিবসে সংখ্যা পূরণ করে নেবে। আল্লাহ তোমাদের সহজ চান এবং কঠিন চান না। আর যাতে তোমরা সংখ্যা পূরণ কর এবং তিনি তোমাদেরকে যে হিদায়াত দিয়েছেন, তার জন্য আল্লাহর বড়ত্ব ঘোষণা কর এবং যাতে তোমরা শোকর কর।” [সূরা আলবাকারাহ : ১৮৩-১৮৫]
সূরা আল বাকারার ১৮৩ নং আয়াতে যারা ঈমানের দাবিদার বা যারা এক আল্লাহর কাছে আত্মসমর্পনকারী তাদেরকে লক্ষ্য করে বলা হয়েছে যে, তোমাদের উপর রোযা ফরয করা হয়েছে। এটা কেবল তোমাদের উপরই যে ফরয করা হয়েছে বিষয়টি এমন নয়, এ রোযা ফরয ছিলো তোমাদের পূর্ববর্তী নবীদের অনুসারীদের উপরও। যেহেতু আল্লাহ তোমাদের কল্যাণকামী সেহেতু তোমাদের মাঝে আল্লাহর ভয় সৃষ্টি করার জন্য তিনি তোমাদের উপর একমাস রোযা রাখাকে ফরয করে দিয়েছেন। অশা করা যায় তোমরা তাকে ভয় করবে। এ আয়াতে নিশ্চিত করে বলা হয়নি যে, তোমাদের উপর যে রোযা ফরয করা হয়েছে তার মাধ্যমে তোমরা অবশ্যই মুত্তাকি হবে। এখানে ‘সম্ভবত’ শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে। অর্থাৎ তোমরা মুত্তাকি হতেও পারো আবার নাও হতে পারো। এর দ্বারা বুঝা যায় রোযা শুধু রাখলেই হবে না এর হক আদায় করে রাখতে হবে এবং বিশেষ কিছু শর্তও মেনে নিতে হবে। এর যে টার্গেট ঈমানদারকে মুত্তাকি বানান তার জন্য সাধনা করতে হবে। রোযার মাসে প্রশিক্ষণ নিয়ে বাকি এগারটি মাস সে আলোকে সঠিকভাবে অতিবাহিত করতে হবে। এ মাসে যে আমলগুলোর প্রতি বিশেষ দৃষ্টি দিতে হবে তা একটু পরেই আলোচনা করবো।
রমযান মাসের ফজীলত:
রমযান মাসের আগমনে মুসলিমগণ আনন্দ প্রকাশ করে থাকেন। আনন্দ প্রকাশ করাই স্বাভাবিক। কুরআন মাজীদে বলা হয়েছে- ‘বল, এটা আল্লাহর অনুগ্রহ ও তাঁর দয়ায়। সুতরাং এতে তারা আনন্দিত হোক। তারা যা সঞ্চয় করে এটা তার চেয়ে উত্তম।’ [সূরা ইউনুস : ৫৮]
পার্থিব কোন সম্পদের সাথে আল্লাহর এ অনুগ্রহের তুলনা চলে না, তা হবে এক ধরনের অবাস্তব কল্পনা। যখন রমযানের আগমন হত তখন রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অতিশয় আনন্দিত হতেন, তাঁর সাহাবাদের বলতেন, তোমাদের দ্বারে বরকতময় মাস রমযান এসেছে। এরপর তিনি এ মাসের কিছু ফজীলত বর্ণনা করে বলতেন, আল্লাহ তা‘আলা তোমাদের জন্য সিয়াম পালন ফরয করেছেন। এ মাসে আকাশের দ্বারসমূহ খুলে দেয়া হয়। বন্ধ করে দেয়া হয় জাহান্নামের দরজাগুলো। অভিশপ্ত শয়তানকে বন্দি করা হয়। এ মাসে রয়েছে একটি রাত যা হাজার রাতের চেয়ে শ্রেষ্ঠ। যে ব্যক্তি এর কল্যাণ থেকে বঞ্চিত হলো সে মূলত সকল কল্যাণ থেকে বঞ্চিত হল। [নাসায়ী : ২১০৫]
রমযান হল কুরআন নাযিলের মাস:
কুরআন নাযিল হওয়ার কারণে রমযান মাসের গুরুত্ব ও মর্যাদা অন্য যে কোন মাসের চেয়ে বেশি। এ মাসে মানুষের হিদায়াত ও আলোকবর্তিকা যেমন নাযিল হয়েছে তেমনি আল্লাহর রহমত হিসেবে এসেছে সিয়াম। তাই এ দুই নিয়ামাতের শুকরিয়া আদায় করতে বেশি বেশি করে কুরআন তিলাওয়াত ও অধ্যয়ন করা উচিত। প্রতি বছর রযান মাসে জিবরীল রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে পূর্ণ কুরআন শোনাতেন এবং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামও তাকে পূর্ণ কুরআন শোনাতেন। আর জীবনের শেষ রমযানে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দু বার পূর্ণ কুরআন তিলাওয়াত করেছেন। সহীহ মুসলিমের হাদীস দ্বারা এটা প্রমাণিত।
এছাড়াও এ মাসের আরো অনেক ফজীলত রয়েছে। যেমন- রমযান মাসে রয়েছে লাইলাতুল কদর, রমযান মাস দু‘আ কবুলের মাস। রমযান পাপ থেকে ক্ষমা লাভের মাস। রমযান জাহান্নাম থেকে মুক্তি লাভের মাস। রমযান মাসে সৎকর্মের প্রতিদান বহু গুণে বৃদ্ধি করে দেয়া হয়। রমযান ধৈর্য্য ও সবরের মাস। রমযান মাস কুরআন প্রতিষ্ঠার মাস। এমাসে কুরআনের আহ্বানে সাড়া দিয়ে অন্যায়ের প্রতিবাদে বদরের প্রান্তরে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন সহাবায়ে কিরাম। ঈমানের দাবিতে সাহাবায়ে কিরামের পথে আজ আমাদেরও এগিয়ে আসা উচিত।
সিয়াম পালনের ফজীলত:
এক. সিয়াম শুধু আল্লাহর জন্য : আল্লাহ রাব্বুল আলামীন নিজের সাথে সিয়ামের সম্পর্ক ঘোষণা করেছেন। এমনিভাবে তিনি সকল ইবাদাত-বন্দেগী থেকে সিয়ামকে আলাদা মর্যাদা দিয়েছেন। যেমন তিনি এক হাদীসে কুদসীতে বলেন- মানুষের প্রতিটি কাজ তার নিজের জন্য, কিন্তু সিয়াম তার ব্যতিক্রম, তা শুধু আমার জন্য, আমিই তার প্রতিদান দেব। [মুসলিম : ২৭৬০]
এ হাদীস দ্বারা আমরা অনুধাবন করতে পারি নেক আমলের মাঝে সিয়াম পালনের গুরুত্ব আল্লাহর কাছে কত বেশি। তাই সাহাবী আবু হুরাইরা রাদিআল্লাহু যখন বলেছিলেন- ‘ইয়া রাসূলুল্লাহ! আমাকে অতি উত্তম কোন নেক আমলের নির্দেশ দিন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ‘তুমি সিয়াম পালন কর। কারণ এর সমমর্যাদার আর কোন আমল নেই।’ [নাসায়ী : ২৫৩৪]
সিয়ামের এত মর্যাদার কারণ কী তা আল্লাহ রাব্বুল আলামীন ভাল জানেন। তবে, আমরা যা দেখি তা হল, সিয়াম এমন একটি আমল যাতে লোক দেখানো ভাব থাকে না। বান্দা ও আল্লাহ তা‘আলার মধ্যকার একটি অতি গোপন বিষয়। সালাত হজ, যাকাতসহ অন্যান্য ইবাদাত-বন্দেগী কে করল তা দেখা যায়। পরিত্যাগ করলেও বুঝা যায়। কিন্তু সিয়াম পালনে লোক দেখানো বা শোনানোর ভাবনা থাকে না। ফলে সিয়ামের মাঝে ইখলাস, আন্তরিকতা বা আল্লাহর প্রতি একনিষ্ঠতা নির্ভেজালও বেশি থাকে।
এছাড়াও সিয়ামের আরো অনেক ফজীলত রয়েছে। যেমন- দুই. সিয়াম আদায়কারী বিনা হিসাবে প্রতিদান লাভ করে থাকেন [মুসলিম : ১৫৫১]; তিন. সিয়াম ঢাল ও কুপ্রবৃত্তি থেকে সুরক্ষা [মুসলিম : ১৪০০]; চার. সিয়াম জাহান্নাম থেকে বাঁচার ঢাল। পাঁচ. সিয়াম হল জান্নাত লাভের পথ। ছয়. সিয়াম পালনকারীর মুখের গন্ধ আল্লাহর কাছে মেশকের চেয়েও উত্তম। সাত. সিয়াম ইহকাল ও পরকালের সাফল্যের মাধ্যম। আট. সিয়াম কিয়ামতের দিন সুপারিশ করবে।
নয়. সিয়াম হল গুনাহ মাফের কারণ ও গুনাহের কাফফারা। হাদীসে এসেছে- ‘যে রমযান মাসে ঈমান ও ইহতিসাবের সাথে সিয়াম পালন করবে, তার অতীতের গুনাহ ক্ষমা করে দেয়া হবে।’ [সহীহ আল বুখারী : ২০১৪, মুসলিম : ১৮১৭]
ইহতিসাবের অর্থ হল : আল্লাহর পক্ষ থেকে পুরস্কার পাওয়া যাবে এ দৃঢ় বিশ্বাস রেখে নিষ্ঠার সাথে সন্তুষ্ট চিত্তে সিয়াম ও কিয়াম আদায় করা।
হাদীসে আরো এসেছে- ‘পাঁচ ওয়াক্ত সালাত, এক জুম’আ থেকে অপর জুম’আ এবং এক রমযান থেকে অপর রমযান হল মধ্যবর্তী সময়ের পাপের কাফফারা, যদি কবীরা গুনাহ থেকে বেচে থাকা যায়।’ [মুসলিম : ৫৭৪]
সিয়াম ছোট পাপগুলোকে মিটিয়ে দেয় আর তাওবা করলে কবীরা গুনাহ মাফ করা হয়। কুরআস মাজীদে এসেছে- ‘তোমাদেরকে যা নিষেধ করা হয়েছে তার মাঝে যা গুরুতর তা হতে বিরত থাকলে তোমাদের লঘুতর পাপগুলো ক্ষমা করে দেব এবং তোমাদের সম্মানজনক স্থানে প্রবেশ করাব।’ [সূরা নিসা : ৩১]
এ আয়াত ও হাদীস দুটো দ্বারা প্রমাণিত হল, আল্লাহর পক্ষ থেকে যে ক্ষমার ওয়াদা করা হয়েছে তা তিনটি শর্ত সাপেক্ষে। যথা-
প্রথম : রমযানের সিয়াম পালন করতে হবে ঈমানের সাথে। অর্থাৎ আল্লাহর প্রতি ও তাঁর রাসূলের প্রতি ঈমান এবং সিয়াম যে একটি ফরয ইবাদাত এর প্রতি বিশ্বাস। সিয়াম পালনকারীকে আল্লাহ যে সকল পুরস্কার দেবেন তার প্রতি বিশ্বাস রাখা।
দ্বিতীয় : সিয়াম পালন করতে হবে ইহতিসাবের সাথে। ইহতিসাব অর্থ : আল্লাহর পক্ষ থেকে সওয়াব ও পুরস্কারের আশা করা, তাকে সন্তুষ্ট করতেই সিয়াম পালন করা, আর সিয়ামকে বোঝা মনে না করা।
তৃতীয় : কবিরা গুনাহ থেকে দূরে থাকতে হবে। কবিরা গুনাহ ঐ সকল পাপকে বলা হয় যেগুলোর ব্যাপারে ইহকালীন শাস্তির বিধান দেয়া হয়েছে, পরকালে শাস্তির ঘোষণা রয়েছে, অথবা আল্লাহর, তাঁর রাসূলের পক্ষ থেকে লানত (অভিসম্পাত) বা ক্রোধের ঘোষণা রয়েছে। যেমন, শিরক করা, সুদ খাওয়া, এতিমের সম্পদ আত্মসাত করা, ব্যভিচার করা, জাদু-টোনা, অন্যায় হত্যা, মাতা-পিতার সাথে দুর্ব্যবহার, আত্মীয়তার সম্পর্কচ্ছেদ, মিথ্যা সাক্ষ্য, মিথ্যা মামলা, বিচারের নামে অবিচার করা, মাদক সেবন, ধোঁকাবাজি, মিথ্যা শপথ, অপবাদ দেয়া, গিবত বা পরদোষ চর্চা, চোগলখোরি, সত্য গোপন করা ইত্যাদি।
যে ধরনের সিয়াম এ সকল ফজীলত অর্জন করতে পারে: যে সকল ফজীলত ও সওয়াবের কথা এতক্ষণ আলোচনা করা হল তা শুধু ঐ ব্যক্তি লাভ করবে যে নিম্নোক্ত শর্তাবলী পালন করে সিয়াম আদায় করবে।
ক) সিয়াম একমাত্র আল্লাহর জন্য আদায় করতে হবে। মানুষকে দেখানো বা শোনানো অথবা মানুষের প্রশংসা অর্জন কিংবা স্বাস্থ্যের উন্নতির নিয়তে সিয়াম আদায় করবে না।
খ) সিয়াম আদায়ের ক্ষেত্রে আল্লাহর রাসূলের সুন্নাত অনুসরণ করতে হবে। সাহরী, ইফতার, তারাবীহসহ সকল বিষয় রাসূলের সুন্নাত অনুযায়ী আদায় করতে হবে।
গ) শুধু খাওয়া-দাওয়া ও যৌনাচার থেকে বিরত থাকলে যথেষ্ট হবে না। মিথ্যা, পরনিন্দা, অশ্লীলতা, ধোঁকাবাজি, ঝগড়া-বিবাদসহ সকল প্রকার অবৈধ কাজ হতে বিরত থাকতে হবে। মুখ যেমন খাবার থেকে বিরত থাকে, তেমনিভাবে চোখ বিরত থাকবে অন্যায় দৃষ্টি থেকে, কান বিরত থাকবে অনর্থক কথা ও গান-বাজনা শোনা থেকে, পা বিরত থাকবে অন্যায়-অসৎ পথে চলা থেকে।
সিয়াম পালনের মহান উদ্দেশ্য এটাই যে, সিয়াম পালনকারী শরীয়তের দৃষ্টিতে সকল প্রকার অন্যায় ও গর্হিত আচার-আচরণ থেকে নিজেকে হিফাযত করবে। অতএব সিয়াম হল, সকল ভাল বিষয় অর্জন ও অন্যায়-গর্হিত কাজ ও কথা বর্জন অনুশীলনের একটি শিক্ষালয়।
তাইতো দেখা যায় রাসূলে করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ঘোষণা দিয়েছেন- ‘যে মিথ্যা কথা ও কাজ এবং মূর্খতা পরিত্যাগ করতে পারল না, তার পানাহার বর্জনে আল্লাহর কোন প্রয়োজন নেই।’ [বুখারী : ৬০৫৭]
সিয়ামের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য এবং উপকারিতা: সিয়ামের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য, কল্যাণ ও উপকারিতা ব্যাপক। এখানে আমরা মৌলিক কয়েকটি তুলে ধরার চেষ্টা করব।
১) তাকওয়া বা আল্লাহ-ভীতি: এটা আল্লাহ রাব্বুল আলামীন নিজেই স্পষ্ট করে বলে দিয়েছেন। সিয়ামের লক্ষ্য হল মানুষ তাকওয়া বা আল্লাহ-ভীতি অর্জন করবে। তিনি বলেন- ‘হে বিশ্বাসীগণ! তোমাদের জন্য সিয়ামের বিধান দেয়া হল, যেমন বিধান তোমাদের পর্ববর্তীদের দেয়া হয়েছিল, যাতে তোমরা তাকওয়া অর্জন করতে পার।’ [সূরা আলবাকারা : ১৮৩]
তাকওয়া হল আল্লাহ যা আদেশ করেছেন তা পালন করা, আর যা নিষেধ করেছেন তা থেকে বিরত থাকা। এটা করা হবে আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রতিদান লাভ ও তাঁর শাস্তি থেকে মুক্তি পাওয়ার আশায়। সিয়াম পালনকারী আল্লাহর নির্দেশের সামনে আত্মসমর্পণ করে যখন বৈধ পানাহার ও যৌনাচার বর্জন করতে পারে তখন সে অবশ্যই অবৈধ আচার-আচরণ, কথা ও কাজ এবং ভোগ-বিলাস থেকে বেঁচে থাকতে পারবে।
২) শয়তান ও কু-প্রবৃত্তির ক্ষমতা দুর্বল করা: শয়তান মানুষের শিরা-উপশিরায় প্রবেশ ও চলাচল করতে পারে। আর কু-প্রবৃত্তি যদি যখন যা ইচ্ছা তা করতে থাকে তখন সে উদ্ধত ও অপ্রতিরোধ্য হয়ে থাকে এবং সে তার আরো চাহিদা মিটানোর জন্য চাপ অব্যাহত রাখে। এমতাবস্থায় মানুষ ক্ষুধা ও পিপাসা দিয়ে শয়তানের সাথে যুদ্ধ করে। এ যুদ্ধে সিয়াম পালনকারী আল্লাহর সাহায্যে শয়তান ও কু-প্রবৃত্তিকে পরাজিত করে। এ কারণে কু-প্রবৃত্তিকে দমন করার জন্য নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সিয়াম নামক চিকিৎসা দিয়েছিলেন। কেননা নফ্সে আম্মারা বা কু-প্রবৃত্তির তাড়নায় মানুষ সকল প্রকারের পাপাচারে লিপ্ত হয়। যেমন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘হে যুবকেরা! তোমাদের মাঝে যে সামর্থ্য রাখে সে যেন বিবাহ করে। কেননা বিবাহ দৃষ্টি অবনত রাখে ও লজ্জাস্থানের সুরক্ষা দেয়। আর যে বিবাহের সামর্থ্য রাখে না সে যেন সিয়াম পালন করে। কারণ এটা তার রক্ষা কবচ।’ [মুসলিম : ১৪০০]
৩) সিয়াম আল্লাহর দাসত্ব প্রতিষ্ঠার প্রশিক্ষণ: মানুষ যখন তার প্রবৃত্তির গোলামি ও শয়তানের আগ্রাসন থেকে মুক্তি লাভ করে তখনই সে আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের বান্দা বা দাস হওয়ার যোগ্যতা অর্জন করে। আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন ব্যতীত তার সামনে আর কোন উদ্দেশ্য থাকে না। তাই সে আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের আদেশ-নিষেধকে নিজের প্রবৃত্তির দাবির উপর অগ্রাধিকার দেয়। এতে যত কষ্ট হোক, যত ধৈর্যের প্রয়োজন হোক, যত ত্যাগের দরকার হোক সব কিছু করতে সে প্রস্তুত হয়ে যায়। তাই সিয়াম পালনকারীকে দেখবেন সে দিনের বেলা খাচ্ছে না, খাচ্ছে রাতে। রাতে নিদ্রা যাচ্ছে না, রাত জেগে সে সালাত আদায় করছে। মিথ্যা কথা ও কাজ এবং সব ধরনের অসদাচরণ সে পরিহার করে চলছে। অথচ তার মন ও প্রবৃত্তি নির্দেশ দিচ্ছে দিনের বেলায় খাওয়া-দাওয়া করতে, রাতের বেলা বিশ্রাম নিতে, মিথ্যা কথা বলতে ইত্যাদি। এমনিভাবে সিয়াম ও এ সম্পর্কিত কাজগুলো আদায় করার মাধ্যমে সিয়াম পালনকারী প্রবৃত্তিসহ সকল মানুষের দাসত্ব অস্বীকার করে আল্লাহর দাসত্বে প্রবেশ করার যোগ্যতা অর্জন করে।
৪) ঈমানকে মজবুত করা ও আল্লাহর ভয় সৃষ্টি: সিয়াম মুসলিমকে ঈমানের সত্যতার প্রমাণ দিতে প্রশিক্ষণ দেয়। তাকে স্মরণ করিয়ে দেয় যে, মুমিন হিসেবে তার কর্তব্য হল সর্বদা আল্লাহর মোরাকাবা করা অর্থাৎ এ দৃঢ় বিশ্বাস পোষণ করা যে, আমার প্রতিটি মুহূর্তের প্রতিটি কাজ আল্লাহ রাব্বুল আলামীন পর্যবেক্ষণ করছেন। তাই আমাকে কোন কাজে তার অবাধ্য হওয়া চলবে না। তিনি যাতে সন্তুষ্ট হন, শুধু তা-ই আমাকে করতে হবে। যদি এ রকম মোরাকাবার সাথে সিয়াম আদায় করা যায়, তাহলে তার জন্য রয়েছে তা-ই যা আল্লাহর রাসূল সাল্লল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘মানব সন্তানের প্রতিটি নেক আমলের প্রতিদান দশ থেকে সাত শত গুণ পর্যন্ত বৃদ্ধি করা হয়। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, কিন্তু সিয়ামের বিষয়টা ভিন্ন। কেননা সিয়াম শুধু আমার জন্য, আমিই তার প্রতিদান দেব। আমার জন্যই সে পানাহার ত্যাগ করে থাকে। [মুসলিম : ১১৫১]
আর এ বিষয়টা সকল প্রকার ইবাদাত-বন্দেগীতে থাকতে হয়। যখন মানুষ বিশ্বাস করবে আল্লাহ আমাকে সর্বদা দেখছেন তখন সে বিনা ওজুতে সালাত আদায় করবে না। ঠিক তেমনি কোন কাজে ফাঁকি দিতে চেষ্টা করবে না। সকল প্রকার কাজ-কর্ম যথাযথ ও সুন্দরভাবে সম্পাদন করবে।
৫) সবর ও দৃঢ় সংকল্পের প্রশিক্ষণ: সিয়ামের মাস মূলত সবরের মাস। সিয়াম মনের চাহিদা পূরণে বাধা দেয়ার মাধ্যমে সংকল্পের দৃঢ়তার প্রশিক্ষণ দেয়। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন কর্তৃক নির্ধারিত সীমারেখা লঙ্ঘন না করে তা মেনে চলার অভ্যাস গড়তে প্রশিক্ষিত করে গড়ে তোলে। কখনো তাঁর সীমা লঙ্ঘনের কথা চিন্তা করে না। সিয়ামের বিধান বর্ণনা করার পর কুরআন মাজীদ বলেছে : ওগুলো আল্লাহর সীমারেখা। সুতরাং ওগুলোর নিকটবর্তী হয়ো না।’ [সূরা বাকারা : ১৮৭]
৬) নিয়মানুবর্তিতা ও সময় সচেতনতার প্রশিক্ষণ: সিয়াম মানুষকে নিয়ম মেনে সময়মত কাজ করতে শিখায়। একজন মানুষ রমযান মাসে সময়মত তারাবিহ, সাহরি, ইফতার করতে অভ্যস্ত হয়। মাগরিবের আজান দেয়ার সাথে সাথে যেমন ইফতার করে রোযাকে পূর্ণ করতে শিক্ষা দেয় তেমনি পরোক্ষভাবে শিক্ষা দেয় মানুষকে নিজের ওপর অর্পিত দায়িত্ব যথাসময়ে এবং যথাযথভাবে আদায় করতে।
উপরোক্ত আলোচনা থেকে আমরা এ শিক্ষা নিতে পারি যে, আল্লাহর বিধানের প্রতি পূর্ণ আনুগত্য প্রদর্শন করে রমযানের পুরো একমাস সিয়াম পালন করতে হবে। রমযান মাসকে নিজের জন্য প্রশিক্ষণ কোর্স মনে করে আমল করতে হবে। তাকওয়া অর্জনের জন্য চূড়ান্ত প্রচেষ্টা চালাতে হবে। মিথ্যাসহ সকলপ্রকার অন্যায় থেকে নিজেকে বিরত রাখতে হবে।
লাইলাতুল ক্বদর তালাশ করতে হবে এবং রমযান মাসে দিনের বেলায় খাওয়ার অধিকার না থাকায় বৈধ খাবারকে হারাম মনে করে যেভাবে দূরে থাকা হয়েছিল, রমযানের পরেও অন্যের অধিকারে থাকা জিনিস নিজের জন্য হারাম মনে করতে হবে। তবেই আমরা বুঝতে পারবো এ রমাদান মাস থেকে আমরা কাক্সিক্ষত প্রশিক্ষণ নিতে পেরেছি।
লেখক : প্রাবন্ধিক, সাহিত্যিক ও সাংবাদিক