জেরুসালেমে ফিলিস্তিনীদের জন্য ভিন্ন এক রমযান

qudsপবিত্র শহরটিতে এখন ছুটির মৌসুম। রমযান উপলক্ষে ওল্ড সিটির কিছু অংশ হলুদ, লাল ও সবুজ রঙের কাগজের লণ্ঠন দিয়ে সাজানো। সাধারণত, শহরটির মুসলিম কোয়ার্টার বেশ নীরব, শান্তই থাকে। তবে শুক্রবার, প্রথম রোজার দিন জায়গাটা ছিল ভরপুর। কোথাও কোন দোকান থেকে কোন কিশোরকে চিৎকার করে পথযাত্রীদের উদ্দেশ্যে মিষ্টির দাম শোনাতে দেখা যাচ্ছিল। এসব পথযাত্রীদের বেশিরভাগই রোজা রেখেছেন। পুরো মাস জুড়ে সূর্যোদয় থেকে শুরু করে সূর্যাস্ত পর্যন্ত না খেয়ে থাকবেন তারা।
ইসরাইল ও ফিলিস্তিনী ভূখন্ডসহ দূর দূরান্ত থেকে মানুষ এসে জড়ো হয়েছে, আল-আকসা মসজিদে জুম্মার নামায আদায় করার জন্য। এরকম মুসুল্লিদের মধ্যে একজন হচ্ছেন ১৯ বছর বয়সী ফাতিমা বাদের। তিনি তার মা ও আরো কয়েকজন নারীর সঙ্গে মসজিদে নামায আদায় করতে যাচ্ছিলেন।
তিনি বলেন, ‘আমরা আল-আকসায় কেবল এই পবিত্র রমযান মাসেই প্রবেশ করতে পারি। আর তাও কেবল শুক্রবারগুলোতে। এটা সত্যিই আবেগপূর্ণ।’
প্রসঙ্গত, আল-আকসা মসজিদ (বাইতুল মুকাদ্দাস নামেও পরিচিত) ইসলামের তৃতীয পবিত্রতম মসজিদ। ইসলামের বর্ণনা অনুযাযী মুহাম্মদ (সা.) মিরাজের রাতে মসজিদুল হারাম থেকে আল-আকসা মসজিদে এসেছিলেন, নামাজ আদায় করেছিলেন এবং এখান থেকে তিনি ঊর্ধ্বাকাশের দিকে যাত্রা করেন।গত সোমবার জেরুজালেমে উদ্বোধন করা হয়েছে মার্কিন দূতাবাস। এরপর দিন, মঙ্গলবার ফিলিস্তিনিরা পালন করেছে তাদের ‘নাকবা দিবস’। বাংলায় নাকবা শব্দের অর্থ ‘বিপর্যয়’। ১৯৪৮ সালের এইদিন (১৫ মে) নিজেদের জন্মভূমি থেকে উচ্ছেদ করে দেয়া হয়েছিল লাখ লাখ ফিলিস্তিনিকে। তাদের বিতাড়িত করে সেই ভূখন্ডে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ইহুদি রাষ্ট্র ইসরাইল। এই ঘটনার প্রতি নিন্দা প্রকাশ করে এরপর থেকে প্রতিবছর এইদিন নাকবা দিবস পালন করে আসছে ফিলিস্তিনিরা।
এই বছর দিনটিতে অবরুদ্ধ গাজা উপত্যকায় ইসরাইল সংলগ্ন সীমান্তে বয়ে গেছে সহিংসতার ঝড়। নিজের পিতৃপুরুষের জন্মভূমিতে ফিরে যাওয়ার দাবি জানিয়ে সেখানে সহিংস প্রতিবাদ করেছে হাজার হাজার ফিলিস্তিনি। কেউ কেউ সীমান্ত বেষ্টনী পেরিয়ে ইসরাইলী ভূখন্ডে প্রবেশের চেষ্টাও চালিয়েছে। বিক্ষোভকারীদের উদ্দেশ্য করে উন্মুক্তভাবে গুলি চালিয়েছে ইসরাইলী সেনারা। ড্রোন দিয়ে ছোড়া হয়েছে কাঁদানে গ্যাস। সব মিলিয়ে বিক্ষোভে প্রাণ হারিয়েছেন ৬২ জন ফিলিস্তিীন।
গাজায় বিক্ষোভের বাতাস শান্ত হয়ে আসার পর, জেরুসালেমের পরিবেশ কয়েকদিন এমন থাকবে: শুরু হবে জেরুসালেমে প্রবেশাধিকার নিয়ে ‘অনুমতির রাজনীতির’, বেচাকেনা হবে বিশেষভাবে তৈরি মিষ্টি, পুরো মৌসুম জুড়ে থাকবে প্রার্থনার আয়োজন। এসবের মাঝে বসবাসকারীদের মনে প্রতিনিয়ত অনুভূত হবে চাপা পড়া উত্তেজনা। খুব শিগগিরই জেরুসালেমে বিরাজ করবে অস্থিতিশীল, ভারসাম্যহীন এক পরিবেশ। গাজায় বিক্ষোভকারীদের বিক্ষোভ ও ইসরাইলী সেনাদের ছোড়া উন্মুক্ত গুলি পশ্চিমা গণমাধ্যম যতটা গুরুত্বের সঙ্গে ফুটিয়ে তুলেছিল, এই নীরব, গুমোট অস্থিতিশীল পরিবেশও ঠিক ততোটাই গুরুত্বপূর্ণ।
আমেরিকান বংশোদ্ভূত ফিলিস্তিনী নাগরিক সারা। তিনি জেরুসালেমের বাসিন্দা। আল-আকসায় ইফতার করতে করতে সারা বলেন, ‘আমি খুব একটা বাড়ি ছেড়ে বের হইনা, ঘরের ভেতরেই থাকি। তবে বর্তমানের রাজনৈতিক পরিস্থিতি সবকিছু পাল্টে দিয়েছে। প্রার্থনা করার সময় মনোযোগ ঠিক রাখা কঠিন হয়ে পড়ে।’ মসজিদের প্রত্যেক কোনায় কোনায় ইসরাইলি সেনারা দাঁড়িয়ে আছে।
সারার স্বামী সামর জানান, এতগুলো ক্ষোভান্বিত মানুষের ভিড় আর ইসরাইলি সেনাদের মধ্য দিয়ে আল-আকসায় আসতে ভয় পাচ্ছিলেন তিনি। তিনি বলেন, আমি বেশ বয়স্ক একজন মানুষ। আমি শুধুমাত্র বাঁচতে চাই আর আমার পরিবার ও কাজের দেখাশোনা করতে চাই। আমাকে অনেকগুলো বিল পরিশোধ করতে হয়। কিন্তু ভেতরে আমি খুশি নই। জেরুসালেমের বেশিরভাগ অংশেই আপাতত উৎসবের আমেজ ছড়িয়ে আছে। কয়েকদিন পরেই ইহুদিরা শাভৌত উদযাপন করবে। ইহুদি বিশ্বাস অনুসারে, ওইদিন সিনাই পর্বতে তাওরাত নাযিল হয়েছিল। খ্রিস্টানরা উদযাপন করবে পেন্টেকস্ট। মুসলিমরা পালন করছে রমজান। মুসলিম বিশ্বাসমতে, এই মাসেই মহানবীর ওপর কোরান নাজিল হয়েছিল।
প্রথম রোজার দিন বাদের বলেন, আমি প্রতিবছর এই দিনটি আসার অপেক্ষা করি। বাদর থাকেন জেরুসালেম থেকে ২০ মাইল দূরে অবস্থিত হিব্রন শহরে। কিন্তু জেরুসালেমে যাওয়ার জন্য তাকে প্রতি বছর রমজান মাস আসার অপেক্ষা করতে হয়। কেননা, বিশেষ অবস্থা ছাড়া জেরুসালেমের বাইরে বসবাসকারীদের সাধারণত শহরটিতে প্রবেশ করার অনুমতি দেয়া হয়না। তবে রমযান মাসের শুক্রবারগুলোতে এই শহরটিতে প্রার্থনার উদ্দেশ্যে ঢুকতে ইচ্ছুকদের প্রবেশের অনুমতি দিয়ে থাকে ইসরাইল সরকার। অনেকের জন্য এই ছুটির দিনটি শুধুমাত্র প্রার্থনা করা বা সুস্বাদু মিষ্টি কেনার সুযোগের চেয়ে অনেক বেশি কিছু। ইসরাইলে বাস করে, পরিবারের এমন সদস্যদের সঙ্গে দেখা করার একটি বিরল সুযোগ এটি। তারা একসঙ্গে ঘুরতে যায়, কেনা-কাটা করতে যায়, ভূমধ্যসাগর দেখতে যায়।
প্রতি বছর বিভিন্ন বিষয় নিয়ে প্রার্থনা করলেও এবার জেরুজালেমগামী বেশিরভাগ ফিলিস্তিনিরাই জানিয়েছে, তারা গাজায় বিক্ষোভে নিহত ও আহতদের জন্য প্রার্থনা করছেন। হামাদ নামের একজন জানান, রমযানের জন্য এটা বেশ বেদনায়ক শুরু, সত্যিই। গাজার স্বাস্থ্যমন্ত্রণালয় অনুসারে, বিক্ষোভে প্রায় ২ হাজার ৭০০ মানুষ আহত হয়েছেন।
হামাদ বলেন, ‘রমজান একটি উদযাপন করার মাস। বিশ্বজুড়ে মুসলিমদের জন্য শান্তির মাস। এইভাবে রমযানের শুরু হওয়াটা একেবারেই মর্মান্তিক।’ বিক্ষোভের ঘটনায় অনেকেই আত্মিকভাবে বিরক্ত।
হামাদ বলেন, রোজার সময় আপনার কিছুটা ধৈর্য দরকার। গাজায় যা ঘটেছে এমন ঘটনা শোনার পর আপনার অনুভূতিতে প্রভাব পড়বেই। বহু নাটকীয়তা ও বেদনাদায়ক ঘটনার মধ্য দিয়ে বিদায় নিয়েছে গাজায় বিক্ষোভের সপ্তাহটা। অনেক মৃত্যু ও ধংসের ঘটনা ঘটেছে। তেল আবিব থেকে জেরুজালেমে স্থানান্তরিত হয়েছে মার্কিন দূতাবাস। কিন্ত এসব সত্ত্বে অনেক কিছু অপরিবর্তিত রয়ে গেছে। রমজান শুরু হয়েছে। ফিলিস্তিনি মুসলিমরা জেরুজালেমে প্রবেশের অনুমতি পেয়েছে। তারা বাসে, গাড়িতে, হেটে আল-আকসায় যাচ্ছে।
কয়েক সপ্তাহ পর্যন্ত রামাল্লাহ, হিব্রন ও জেরুসালেমের বাসিন্দারা এক সাথে প্রার্থনা করার, একসাথে খাওয়ার, ছোট শিশুদের একসাথে খেলতে দেখার সুযোগ পাবে। এই মাস জুড়ে যতবার তারা সুযোগ পাবে ততবারই তারা সেখানে যাবে। ততদিন পর্যন্ত যাবে যতদিন পর আর যেতে পারবেনা। একসাথে সেখানকার অপরিবর্তিত পরিস্থিতি পরিবর্তনের জন্য প্রার্থনা করবে। সালাম আবু সালিম নামের একজনের ভাষ্য: আমি এখানে প্রতি শুক্রবারে এখানে আসবো। সৃষ্টিকর্তাকে এটা বলার জন্য যে, আমি ভীত।

আরও পড়ুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও দেখুন...
Close
Back to top button