গাজা: পৃথিবীর বৃহত্তম উন্মুক্ত কারাগার

Gazaগত ১৪ মে গাজা-ইসরাইল সীমান্তে যে বিক্ষোভকারীদের ওপর ইসরাইলি সেনাদের গুলিতে প্রায় ৬০ জন নিহত হন; এরা প্রায় সবাই গাজার অধিবাসী। গাজা হচ্ছে ফিলিস্তিনি-অধ্যুষিত এমন একটি এলাকা, যা পশ্চিম তীর থেকে বিচ্ছিন্ন। এলাকাটি ৪১ কিলোমিটার দীর্ঘ এবং ১০ কিলোমিটার চওড়া। একদিকে ভূমধ্যসাগর, তিন দিকে ইসরাইল ও দক্ষিণ দিকে মিসরের সিনাই সীমান্ত। অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ হওয়ায় এলাকাটি কঠোর নিরাপত্তা বেষ্টনী দিয়ে ঘেরা। অবরুদ্ধ এই ছোট্ট এলাকাটির মধ্যে কীভাবে দিন কাটাচ্ছেন গাজার অধিবাসীরা? কেমন জীবন তাদের?
শ’খানেক বর্গমাইল আয়তনের এই ছোট এলাকাটুকুর মধ্যে বাস করেন প্রায় ১৯ লাখ ফিলিস্তিনি। এরা বেশিরভাগই ১৯৪৮ সালে ইসরাইল প্রতিষ্ঠার সময় বাড়ি ছেড়ে পালানো বা উচ্ছেদ হওয়া ফিলিস্তিনিদের বংশধর। অনেকেই এখনো বাস করেন শরণার্থী শিবিরে, তারা এখনো স্বপ্ন দেখেন নিজের হারানো বসতভূমি ফিরে পাওয়ার। এরা বলেন, গাজা হচ্ছে পৃথিবীর বৃহত্তম উন্মুক্ত কারাগার।
গাজা এক সময় মিসরের অধিকারে ছিল। ১৯৬৭ সালের যুদ্ধে ইসরাইল এলাকাটি দখল করে নেয়। পরে ২০০৫ সালে ইসরাইল এলাকাটির দখল ছেড়ে দেয়। এলাকাটি এখন ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের অধীনে। তবে ২০০৭ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত হামাস গোষ্ঠী শাসন করত এই গাজা। হামাস ২০০৬ সালে ফিলিস্তিনি আইনসভার নির্বাচনে জয়ী হয়। কিন্তু তারপর প্রতিদ্বন্দ্বী ফাতাহর সঙ্গে তাদের সংঘাত সৃষ্টির পর তারা গাজার নিয়ন্ত্রণ নেয়।
গাজার জনসংখ্যা ২০১৫ সালের ছিল ছয় লাখ ৩০ হাজার। জাতিসংঘের হিসাব অনুযায়ী, ২০৩০ সালে এই সংখ্যা ৩১ লাখে গিয়ে দাঁড়াবে। এই ভূখন্ডের প্রতি বর্গকিলোমিটারে বাস করেন পাঁচ হাজার ৪৭৯ জন। এখানে মানুষের মধ্যে ব্যাপক দারিদ্র্য আর বেকারত্ব, আর কঠোর সীমান্ত প্রহরা থাকায় ‘চেক পয়েন্ট’ পেরিয়ে বাইরে যাওয়ার সুযোগও খুব সীমিত। সীমান্ত নিরাপত্তা লঙ্ঘনের কোনো রকম চেষ্টাকে ইসরাইল তার প্রতি সরাসরি হুমকি বলে মনে করে। আর গাজার ভেতর থেকে ইসরাইলে রকেট হামলার জবাবে তিনবার এখানে অভিযান চালিয়েছে ইসরাইল। প্রতিবারই ব্যাপক সংখ্যায় বেসামরিক লোকের মৃত্যু হয়েছে।
চিকিৎসার জন্য এখানকার লোকদের আগে মিসরে বা ইসরাইলের ভেতরে যাওয়ার সুযোগ ছিল। কিন্তু সীমান্তে কড়াকড়ির জন্য তা ব্যাপকভাবে কমে গেছে। ওষুধ বা ডায়ালাইসিস মেশিনের মতো চিকিৎসা যন্ত্রপাতিও এখন গাজায় আসা মুশকিল হয়ে পড়েছে। বিদ্যুৎ সরবরাহের অভাবে তিনটি হাসপাতাল এবং ১০টি মেডিকেল সেন্টার তাদের সেবা স্থগিত করে দিয়েছে।
প্রতিদিন সেখানে বিদ্যুৎ বিভ্রাট হয়। গাজার লোকজন দিনে গড়ে মাত্র ছয় ঘণ্টা বিদ্যুৎ পেয়ে থাকেন। বেশিরভাগ বিদ্যুৎ আসে ইসরাইল থেকে, তবে গাজার একটি নিজস্ব বিদ্যুৎকেন্দ্র আছে, আর কিছু মিসর থেকে আসে। অনেক লোক ডিজেলের জেনারেটর ব্যবহার করেন, তবে তা খুবই ব্যয়বহুল।
গাজার লোকজন কিছু খাদ্য সাহায্য পায়, তা সত্ত্বেও এখানে পাঁচ লাখের বেশি লোক মাঝারি থেকে তীব্র খাদ্য নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে দিন কাটাচ্ছে। আবাসনের ঘাটতিও প্রকট। ইসরাইল ঘোষিত সীমান্ত-সংলগ্ন প্রায় একমাইলের ‘বাফার জোনে’ ফিলিস্তিনিরা চাষবাস করতে পারেন না। সমুদ্র তীর থেকে একটা নির্দিষ্ট এলাকার বাইরে গিয়ে গাজার মৎস্যজীবীরা মাছ ধরতেও পারেন না। গাজা থেকে রকেট হামলা হলেই ইসরাইল এই মাছ ধরার এলাকা কমিয়ে দেয়। আর কোনো ফিলিস্তিনি জেলে নৌকা সেই সীমার কাছাকাছি এলেই ইসরাইলি নৌবাহিনীর সেনারা প্রায়ই গুলি চালায়।
গাজায় বৃষ্টিপাত হয় খুবই সামান্য। কোনো বড় মিঠা পানির জলাধার নেই। গাজার বাড়িগুলোতে পাইপে যে পানি আসে, তার সরবরাহও অনিয়মিত। ৯৭ শতাংশ বাড়িকেই নির্ভর করতে হয় ট্যাঙ্কার দিয়ে সরবরাহ করা পানির ওপর। পয়ঃপ্রণালী ব্যবস্থা হচ্ছে আরেকটি গুরুতর সমস্যা। প্রায় ৯ কোটি লিটার বর্জ্য পাম্প করে ভূমধ্যসাগরে বা খোলা পুকুরে ফেলা হয়। যার ফলে গাজার পানির স্তরের ৯৫ শতাংশই দূষিত। আর গাজার স্কুলগুলোর ওপর ছাত্রছাত্রীর সংখ্যার প্রচন্ড চাপের কারণে ৯৪ শতাংশ স্কুলই দুই শিফট করে চলে। একটি সকালে আরেকটি বিকালে। এই রকম পরিবেশের মধ্যেই বাস করছেন গাজার লাখ লাখ ফিলিস্তিনি। -বিবিসি

আরও পড়ুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button