ভারতকে যা দিয়েছি আজীবন মনে রাখবে: শেখ হাসিনা
ভারতের কাছে কোনো প্রতিদান চান না জানিয়েছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, আমার নেয়ার অভ্যাস কম, দেয়ার অভ্যাস। ভারতকে যা দিয়েছি আজীবন মনে রাখবে। ভারত সফর শেষে বুধবার গণভবনে আয়োজিত সাংবািদক সম্মেলনে তিনি এ কথা বলেন।
মোদির কাছে ‘প্রতিদান’ চান হাসিনা- পশ্চিমবঙ্গের আনন্দবাজার পত্রিকার এমন প্রতিবেদনের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করলে শেখ হাসিনা বলেন, আমি কোনো প্রতিদান চাই না। আমার চাওয়ার অভ্যাস কম, দেয়ার অভ্যাস। এসময় তিনি বলেন, আমি ভারতকে যা দিয়েছি তা আজীবন মনে রাখবে। অস্ত্র চোরাচালান ও সন্ত্রাস বন্ধসহ এখানে একটি শাস্তিপূর্ণ পরিবেশ সৃষ্টি করেছি।
খালেদা জিয়ার মুক্তির বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, কোর্ট মুক্তি না দিলে আমি কি জেলের তালা ভেঙে তাকে নিয়ে আসবো? তিনি বলেন, ‘ওনার মুক্তি চাইতে হলে রাষ্ট্রপতির কাছে ক্ষমা চাক।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আগামী নির্বাচন সংবিধান সম্মতভাবেই হবে। নির্বাচন আমি করবো না, নির্বাচন করবে নির্বাচন কমিশন।’ তিনি বলেন, ‘সংবিধানে যেভাবে নির্বাচনকালীন সরকারের কথা বলা আছে, সেভাবেই হবে।’ ৫ জানুয়ারি (২০১৪) নির্বাচন ঠেকানোর নামে যারা জ্বালাও-পোড়াও করেছে, তা তুলে ধরে শেখ হাসিনা বলেন, ‘এই অপকর্ম যারা করেছে, তারা নির্বাচনে আসলো কী আসলো না, এটা নিয়ে এত হা-হুতাশ কেন?’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘কোর্ট মুক্তি না দিলে আমি কি জেলের তালা ভেঙে তাকে নিয়ে আসবো?’ তিনি বলেন, ‘ওনার মুক্তি চাইতে হলে রাষ্ট্রপতির কাছে ক্ষমা চাক। তিনি মুক্তি না দিলে আমাদের ওপর দোষ দিতে পারে।’ শেখ হাসিনা বলেন, ‘এতিমের টাকা মেরে খাওয়ায় মামলা হয়েছে, আমি তো মামলা দেইনি। মামলা দিয়েছে তত্ত্বাবধায়ক সরকার। ১০ বছর মামলা চলার পরে রায় হয়েছে।’
তিস্তার পানি বণ্টন সংক্রান্ত এক প্রশ্নে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ঘুরে ফিরে একই প্রশ্ন। আমি সেখানে বলেছি- প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে অনেক সমস্যা থাকতে পারে। সেই সমস্যার কথা তুলে তিক্ততা তৈরির পক্ষে আমি নই।
এসময় তিনি বলেন, আমি যদি বলি- আপনি তিস্তা ব্যারেজ করলেন কেন? এটা করার সময় চিন্তা করলেন না- আমরা ভাটিতে, সমস্যা হবে। এখন পানি পানি বলে চিল্লাচ্ছেন কেন? আমরা কথা বলেছি, তারা বলেছে, সমাধান করবে। অপেক্ষা করুন।
শেখ হাসিনা বলেন, আমরা এই তিস্তায় নির্ভর করব কেন? আমরা বিকল্প ব্যবস্থা করছি। নদীগুলো ড্রেজিং করছি। কয়েক হাজার পুকুর খনন করে জলাধার হিসেবে সংরক্ষণের চেষ্টা করছি।
শেখ হাসিনা বলেন, ‘আজকে তারা তিস্তার পানি পানি করে, অথচ সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছিল গঙ্গার পানি। ভারত সফর শেষে খালেদা জিয়া গঙ্গার পানির ন্যায্য হিস্যা চাইতে ভুলে গিয়েছিল। বিএনপি নেতাদের এটা মনে আছে?’
প্রধান মন্ত্রী বলেন, তিস্তা নদীর পানি বন্টন নিয়ে চুক্তি-রোহিঙ্গা ইস্যুসহ নানা বিষয় নিয়ে ভারতের সঙ্গে আলোচনা হয়েছে। যৌথ নদী কমিশন বিষয়টি (তিস্তা) দেখছে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ভারতে যেতেই হবে, স্বাভাবিক। তারা (বিএনপি) যায়নি? ক্ষমতা সুরক্ষায় প্রধানমন্ত্রী বারবার ভারতে যাচ্ছেন বিএনপির এমন অভিযোগের বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘ভারতে যেতেই হবে। তারা তো কম যায়নি। খালেদা জিয়া, জিয়াউর রহমান কি ভারতে যায়নি? ক্ষমতা দখলের দুই বছরের মাথায় ৭৭ সালে গেছে জিয়াউর রহমান।
চলমান মাদকবিরোধী অভিযানে গডফাদারদের গ্রেপ্তারের বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, গডফাদার কাকে বোঝাচ্ছেন তা জানি না। কিন্তু যারা জড়িত তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। জলপথ, নৌপথ সব পথে নজরদারি চলছে। আমি যখন ধরি তখন ভালো করেই ধরি। কে কার ভাই, কার বোন তা দেখি না।
শেখ হাসিনা বলেন, মাদকবিরোধী অভিযানের বিষয়ে অনেকে প্রশ্ন তুলছেন। কিন্তু মাদকবিরোধী অভিযান থেমে থাকুক সেটি কি আপনারা চান? মাদকবিরোধী অভিযান এটি সবার দাবি। আপনারা শুধু অভিযানে কারা নিহত হলো সেটি দেখান। কিন্তু সাত হাজারের ওপর গ্রেফতার হয়েছে সেটি তো কেউ দেখান না। মাদকবিরোধী অভিযান বন্ধ হোক সেটা কি চান?। মাদক বন্ধ হলে সমাজ ভালো থাকবে। আজকে মাদকের কারণে ভাই তার বোনকে এবং ছেলে তার মাকে হত্যা করছে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, খুবই স্বাভাবিক একটি বড় ধরনের অভিযান চললে কিছু অস্বাভাবিক ঘটনা ঘটতে পারে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী যখন কোনো অভিযানে যায় তখন তাদের কোনো অনাকাঙ্খিত ঘটনা ঘটলে সেটার ব্যবস্থা নেওয়া হবে। কিন্তু এখন পর্যন্ত কোনো নিরীহ মানুষ শিকার হয়েছে সেটি দেখান। দেখাতে পারলে আমি এর বিচার করব।
মাদকের গডফাদারদের গ্রেফতার নিয়ে প্রশ্নের জবাবে শেখ হাসিনা বলেন, গডফাদার আপনারা কাকে বলছেন সেটি আমি জানি না। কাকে আপনার গডফাদার হিসেবে বিবেচনা করছেন সেটা আপনারা ভালো জানেন। কে গডফাদার সেটি দেখা হচ্ছে না। মাদকের বিরুদ্ধে অভিযান চলছে। কে গডফাদার, কে এর বিস্তারকারী, কার সহযোগিতায় এটি হচ্ছে এসব বিষয়ে দীর্ঘদিন খোঁজ-খবর নেওয়া হয়েছে। হুট করেই এ অভিযান শুরু করা হয়নি। আপনাদের মনে হতে পারে, হুট করে এ অভিযান শুরু হয়েছে। জলপথ, নৌপথ সব পথে নজরদারি চলছে। আমি যখন ধরি তখন ভালো করেই ধরি। কে কার ভাই, কার বোন তা দেখি না।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘সন্ত্রাস ও জঙ্গিবিরোধী অভিযানের সময়ও অনেকে সমালোচনা করেছিল। সমালোচনার ভয়ে সে অভিযান বন্ধ হয়নি; মাদকবিরোধী অভিযানও বন্ধ হবে না।’
মাদক সমাজের জন্য একটা ব্যাধির মতো মন্তব্য করে সাংবাদিকদের উদ্দেশ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘এর বিরুদ্ধে আপনারা পত্রপত্রিকায় লিখেছেন। আপনারা কি চান, অভিযান চলুক নাকি বন্ধ হয়ে যাক? খুব স্বাভাবিক যে, এই ধরনের অভিযান চালাতে গেলে কিছু ঘটনা ঘটবেই। এ পর্যন্ত যে কয়টা ঘটনা হয়েছে, মনে হয় না একটাও নিরীহ ব্যক্তি শিকার হয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘যখন পুলিশ-র্যাব একটা অভিযানে যায়, তখন তাদের একটা অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতির মুখোমুখী হতে হয়। আর সে ঘটনায় যদি কোনও কিছু ঘটেই থাকে, আর সেখানে যদি অন্যায়ভাবে কিছু ঘটে থাকে, তাহলে তাদের কিন্তু বিচার হয়। এসব অভিযানে কোনও নিরীহ ব্যক্তি শিকার হলে আমরা ব্যবস্থা নেবো। কিন্তু সমাজ থেকে মাদক দূর করতে হবে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমি অবাক হলাম, কত গ্রেফতার হলো, আপনারা কিন্তু সেটা উল্লেখ করেন না। বন্দুকের ব্যবহারের কথা যেটা বলছেন, সাধারণভাবে সেখানে যদি কোনও ঘটনা ঘটে থাকে, আপনারা বলবেন, আইনগতভাবে সেটা ঠিক না।
তিনি বলেন, ‘একটা অভিযান চালাতে গিয়ে যদি কোনও ঘটনা ঘটে, সেটাই বড় করে যদি দেখান, তাহলে বলেন, বন্ধ করে দেই? ভেজালবিরোধী-মাদকবিরোধী অভিযান বন্ধ করে দেই? তাহলে কি সমাজ খুব ভালো থাকবে? সেই জবাবটা আপনারা আমাকে দিন।’
আজ মেয়ে বাবা-মাকে হত্যা করেছে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘ছেলে মাকে হত্যা করছে। ভাই ভাইকে হত্যা করছে এই মাদকের কারণে। এই মাদক নিয়ে সমাজে একটা হাহাকার। তার বিরুদ্ধে কি অভিযান চালানো যাবে না? আপনারা দেখুন, কতজনকে আইনের আওতায় আনা হয়েছে। মোবাইল কোর্টের মাধ্যমে কতজনকে সাজা দেওয়া হয়েছে তাৎক্ষণিকভাবে। আইনের হাতে সোপর্দ করা হয়েছে।
তিনি বলেন, ‘সন্ত্রাসবিরোধী অভিযান চালিয়েছি, তখনও কিন্তু একই প্রশ্ন এসেছে। এখন সন্ত্রাস আমরা নিয়ন্ত্রণ করতে পেরেছি। অনেক দেশেই অনেক ঘটনা ঘটছে। কিন্তু বাংলাদেশে আমরা অনেক ভালো অবস্থানে রাখতে সক্ষম হয়েছি। কাজেই মাদকবিরোধী যে অভিযান চলছে, তাতে সারাদেশের মানুষ কিন্তু স্বস্তি পাচ্ছে।’
বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের দেওয়া সম্মানসূচক ডি লিট ডিগ্রি অর্জনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ধন্যবাদ জানিয়ে তার নোবেল পুরস্কার পাওয়া উচিত বলে সাংবাদিক সম্মেলেনে মন্তব্য করেন গোলাম সারওয়ার। এসময় নোবেল পুরস্কার পাওয়ার জন্য এখন থেকে প্রক্রিয়া চালাতে প্রধানমন্ত্রীকে পরামর্শ দেন। এর উত্তরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘এ ধরনের প্রক্রিয়া চালানোর আমার কোনও ইচ্ছা নাই। লবিস্ট রাখার মতো আর্থিক সামর্থ্য আমার নেই। সামর্থ্য থাকলেও এসব আমি সমর্থন করি না। বাংলাদেশের মানুষকে শান্তি দিতে পারলাম কিনা সেটাই বড় বিষয়। গরিব মানুষের সুদের টাকায় নোবেল পাওয়ার ইচ্ছা আমার নেই।’
সাহিত্যে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের নানান অবদানের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘কবি নজরুলের নামে ডিগ্রি পেয়েছি। এটাই অনেক সম্মানজনক আমার কাছে।’
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, যারা মুচলেকা দেয় আমি সে দলে না। ইতোপূর্বে ভারতীয় বিচ্ছিন্নতাবাদীদের জন্য আনা অস্ত্রের বিষয়েও কথা বলেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেন, ‘আমরা এসব বন্ধ করেছি। ভারত আমাকে ক্ষমতায় আনবে কী আনবে না, সেটা জানি না। কিন্তু গ্যাস আমাদের। আমেরিকান কোম্পানি আমাদের গ্যাস উত্তোলন করে ভারতে বিক্রি করবে। এ নিয়ে সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট জিমি কার্টারকে আমি না করে দেই। তিনি খালেদার শরণাপন্ন হন। পরে সেই গ্যাস পাওয়া যায়নি।
শেখ হাসিনা বলেন, ‘ওরা বলে, আমরা নাকি এক বালতি পানিও আনতে পারিনি। অথচ গঙ্গার পানির চুক্তি আমরাই করেছি। আমি ৩০ বছরের চুক্তি করেছি। যারা মুচলেকা দেয়, আমি সে দলে না।’
ছোট দলগুলোর ফ্রন্ট থেকে খালেদা জিয়ার মুক্তির বিষয়ে এক প্রশ্নের উত্তরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘জিরো প্লাস জিরো সমান জিরো। এতিমের টাকা নিয়ে কোরান শরিফেও লেখা আছে। আর এ মামলা আমাদের সরকারও দেয়নি। এটা দিয়েছে মইনউদ্দিন-ফখরুদ্দিনের সরকার। আমার তো সাজা দেওয়ার কোনও এখতিয়ার নেই। কোর্টের রায়ে আমার কিছু করার নেই। তিনি বলেন, ‘আমি বাংলাদেশের একজন সাধারণ মানুষ। বাংলার মাটিতেই আমার জায়গা।
সাবেক রাষ্ট্রপতি ও বিকল্পধারার চেয়ারম্যান বদরুদ্দোজা চৌধুরীর জাতীয় সরকারের প্রস্তাবের কড়া সমালোচনা করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এই দেশে ভোট নিয়ে খেলা এবং ভোট নিয়ে যতো অনিয়ম তা তো তাদেরই ফল। জিয়া সেনাপ্রধান থাকাবস্থায় বিচারপতি সায়েমকে অস্ত্র ঠেকিয়ে ক্ষমতা দখল করেছিল তখন বদু কাকা কোথায় ছিলেন? জিয়াউর রহমান যখন হ্যা না ভোট দিয়েছিল সেই নির্বাচনটা কেমন হয়েছিল? ১৯৮১ সালের নির্বাচনে তো আমি দেশেই ছিলাম। সেই নির্বাচনটা কেমন হয়েছিল? মাগুরার উপ-নির্বাচন কেমন হয়েছিল? ১৫ ফেব্রুয়ারী নির্বাচনটা কেমন হয়েছিল? বদুকাকা তখন কোথায় ছিলেন? যদিও বিএনপির সঙ্গে বদরুদ্দোজা চৌধুরী সেই গাটছাড়া বেশিদিন থাকেনি। রেললাইনের তল দিয়ে দৌঁড়াতে (রাষ্ট্রপতি পদ থেকে ইমিপিচমেন্টের পর এক অনুষ্ঠানে) হয়েছিল। তাঁরা (বিএনপি) তাকে ছাড়ে নি। তারপরও বদুকাকা যদি খালেদা জিয়ার প্রতি দরদ দেখান তবে আমাদের কি করার আছে।
জাতীয় দলের ক্রিকেটার মাশরাফি বিন মুর্তজা ও সাকিব আল হাসানের নির্বাচনী প্রার্থিতা নিয়ে ইতিবাচক মনোভাব প্রকাশ করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, পৃথিবীর সব দেশেই সেলিব্রেটিরা নির্বাচনে অংশ নেন। সুতরাং এ বিষয়ে কারো না কারো যদি আকাংখা থাকে তারা মনোনয়ন চাইতেই পারেন।
গত ২৫মে দু’দিনের সরকারি সফরে কলকাতা যান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সফরকালে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি যৌথভাবে শান্তি নিকেতনে বিশ্ব ভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘বাংলাদেশে ভবন’ উদ্বোধন করেন।