একটি সমীক্ষা : মুসলিম বিশ্বের গন্তব্য
সুমাইয়া তাসনীম: মরুভূমির ঝুপড়ি থেকে ইসলামের যাত্রা শুরু, ক্রমেই তা মানুষের মন জয় করে ছড়িয়ে পড়েছিলো গোটা বিশ্বে। সুমহান গৌরব ও মর্যাদা নিয়ে গোটা পৃথিবী এক হাজার বছর ধরে দুর্দান্ত শাসনের পর আস্তে আস্তে ক্ষয়ে যায় সেই জৌলুস। এক খিলাফত ভেঙে জন্ম নেয় অনেকগুলো ইসলামী রাষ্ট্রের। ধীরে ধীরে সেগুলো ইসলামী রাষ্ট্রের মর্যাদা হারিয়ে রূপ নেয় মুসলিম অধ্যুষিত মুসলিম রাষ্ট্রে। এরপর নেমে আসে মুসলিম বিশ্বের কালো অধ্যায়, গোলামী জিন্দেগী। সেই অবস্থা থেকে ঈমানের চেতনায় ঘুরে দাঁড়ায় মুসলিম রাষ্ট্রগুলো, বিশ্বের বুকে আত্মপ্রকাশ করে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে। এদিকে বসে নেই ইসলাম ও মুসলিম বিরোধী অপশক্তিগুলো। ষড়যন্ত্রের জাল বিছিয়ে আগ্রাসী থাবা মেলে দেয় মুসলিম বিশ্বের দিকে। শুরু হয় নতুন করে অস্তিত্বের সংঘাত।
মুসলিম বিশ্ব পরিচিতি: যে সব দেশে মুসলিমরা বাস করেন তাদের একত্রে মুসলিম বিশ্ব বলে। মুসলিমদের সমগ্র মনন, অবস্থান ও অস্তিত্ব জনিত পরিস্থিতিকে মুসলিম জাহান বলা হয়।
২০১৭ সালে বিশ্বের জনসংখ্যার ১.৮ বিলিয়নের বেশি বা প্রায় ২৪.১% মুসলিম ছিল। এর মধ্যে এশিয়া প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে প্রায় ৬২%, মধ্যপ্রাচ্য-উত্তর আফ্রিকায়….. সাব-সাহারান আফ্রিকায় ১৫%, ইউরোপে প্রায় ৩% এবং আমেরিকায় ০.৩%।
মুসলিম প্রধান দেশসমূহে ধর্মীয় অবস্থা: ইসলামী রাষ্ট্র- বর্তমান বিশ্বে ৬৫টি মুসলিম রাষ্ট্র। বিশ্বে মোট ৫২টি স্বাধীন মুসলিম রাষ্ট্র রয়েছে। এর মধ্যে রাষ্ট্রীয় কার্যে ইসলামকে আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করেছে ২৬টি মুসলিম রাষ্ট্র। যেখানে সরকারের কার্যের প্রথম ভিত্তি হল শরীয়াহ্। তবে সব দেশে সমানভাবে তা কার্যকর নয়। পূর্ণাঙ্গ ইসলামী রাষ্ট্র একটি তা হলো ইরান।
দেশ ধর্ম: ধর্মীয় সংগঠন বা ধর্ম বিশ্বাস হিসেবে ইসলামকে রাষ্ট্রীয়ভাবে অনুমোদন দিয়েছে ২৬টি রাষ্ট্র।
ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র ও ঘোষণা নেই: রাষ্ট্রীয়ভাবে ধর্মীয় বিষয়সমূহে নিরপেক্ষতা অবলম্বন করছে ৩০টি রাষ্ট্র।
ঘোষণা নেই: আনুষ্ঠানিক বা সরকারিভাবে এই মুসলিম অধ্যুষিত রাষ্ট্রগুলোর কোন বক্তব্য নেই ধর্মীয় ব্যাপারে। এমন রাষ্ট্র সংখ্যা ১৩টি। তুরস্ক, আজারবাইজান, গাম্বিয়া, কসোভো। যদিও এখানে মুসলিমদের সংখ্যা ৯৫-৯৯ দশমিক ৮ শতাংশ।
এছাড়া মালি ৯৫.৮, সুদান ৯০.৭ তুর্কমেনিস্তান ৮৯.০, উজবেকিস্তান ৮৮.০, ইন্দোনেশিয়া ৮৭.২, গিনি ৮৬.৭, নাইজার ৮০.০, সিরিয়া ৮৭.০, তাজিকিস্তান ৮৫.০ এগুলোতে কোন ধর্মই এখন রাষ্ট্রীয় নয়। (সূত্র: পিউ রিসার্চ সেন্টার, ২০১২)
মুসলিম বিশ্বের অর্থনীতি: পেট্রোল উৎপাদনে পৃথিবীর মধ্যে প্রথম উপসাগরীয় আরব দেশগুলো। ফসফেট উৎপাদনে পৃথিবীর মধ্যে প্রথম মরক্কো। রাবার উৎপাদনে পৃথিবীর মধ্যে প্রথম মালয়েশিয়া, টিন উৎপাদনে পৃথিবীর মধ্যে প্রথম মালয়েশিয়া (৩৫%)। কার্পাস উৎপাদনে পৃথিবীর মধ্যে প্রথম ইরাক ৮০%। কোলামবাইট (ধাতু) উৎপাদন পৃথিবীর মধ্যে প্রথম নাইজেরিয়া (৯০%), পাম অয়েল উৎপাদনে পৃথিবীর মধ্যে প্রথম মালয়েশিয়া।
এছাড়াও পৃথিবীর মোট তেল ও গ্যাসের ৮০ ভাগ, বয়লার ৬০ ভাগ, স্বর্ণের ৬৫ ভাগ, রাবার ও পাটের ৭৫ ভাগ ও খেজুরের ১০০ ভাগই মুসলিম দেশগুলোর। অমুসলিম বিশ্বের ৮৭ ভাগ বাণিজ্যই মুসলিম দেশগুলোর সাথে।
৫৭টি মুসলিম দেশ পৃথিবীর ২৩% ভূমির অধিকারী। ফোর্বসের তথ্যমতে কাতার সবচেয়ে ধনী রাষ্ট্র বিশ্বের মধ্যে। ২০২২ সালের বিশ্বকাপ ফুটবলের আয়োজক এবং ২০২০ সালের অলিম্পিক গেমস আয়োজনের প্রতিযোগিতাকারী কাতার ইতিমধ্যেই সর্বোচ্চ বিনিয়োগকারী দেশে পরিণত হয়েছে।
সৈন্যসংখ্যার ক্ষেত্রে মুসলিম বিশ্ব: পৃথিবীর সকল রাষ্ট্রের মোট সৈন্যসংখ্যা ৩ কোটি ৪০ লক্ষ। মুসলিম রাষ্ট্রসমূহের মোট সৈন্যসংখ্যা ৮৫ লক্ষ। অর্থাৎ পৃথিবীর মোট সৈন্যসংখ্যার অনুপাতে মুসলিম সৈন্যবাহিনী ২৫%।
জনসংখ্যার দিক থেকে মুসলিম বিশ্ব: বর্তমান বিশ্বে মোট মুসলিম জনসংখ্যা ১৫৭ কোটি। যা বিশ্বের মোট জনসংখ্যার ২৩%। পৃথিবীর মোট রাষ্ট্রের ২৬% মুসলিম রাষ্ট্র।
তবু ৫টি মুসলিম দেশ উচ্চ মানব উন্নয়নভুক্ত তালিকায় ২৫টি মধ্য মানব উন্নয়নভুক্ত রাষ্ট্রের তালিকায় এবং ২৭টি নিম্ন মানব উন্নয়নভুক্ত রাষ্ট্রের তালিকায় রয়েছে এবং ১৯টি মুসলিম দেশ (৩৩%) বিশ্ব ব্যাংকের শ্রেণীবিন্যাস অনুযায়ী স্বল্পোন্নত দেশ হিসেবে বিবেচিত এবং মুসলিম বিশ্বের বিপুল পরিমাণ উদ্বৃত্ত সম্পদ পাশ্চাত্যের ব্যাংকগুলোতেই জমা আছে।
মুসলিম বিশ্বের রাজনৈতিক অবস্থা: বিশ্বে ৬০টি মুসলিম দেশের মধ্যে অন্তত ৫টি দেশে সরাসরি যুদ্ধ চলছে। এছাড়া ১০টি দেশ সন্ত্রাস ও জঙ্গীদের বিরুদ্ধে লড়াই করছে। ৫টি দেশের সন্ত্রাস জঙ্গীদের থাবায় আক্রান্ত হবার আশংকা রয়েছে। অপরদিকে প্রায় ২০টি মুসলিম দেশ একে অপরের বিরুদ্ধাচরণ কিংবা পরোক্ষভাবে হানাহানি উস্কে দিচ্ছে। এক কথায় ৬০টি মুসলিম দেশের মধ্যে ৩৫টি দেশ চরম অশান্তির মধ্যে অবস্থান করছে। অবশিষ্ট ২৫টি দেশ মোটামুটি অনেকটা নিরাপদ। এক্ষেত্রে আবার ২৫টি নিরাপদ দেশ নিয়ে বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে যে, এদের অধিকাংশ দেশ পশ্চিমা দোসর কিংবা তাবেদার সরকার দ্বারা পরিচালিত। অপরদিকে ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, ব্রুনাই, আলবেনিয়া, তাঞ্জানিয়াসহ ৯/১০টি মধ্যপন্থী দেশ রয়েছে এরা কখনো মুসলিম বিশ্ব ও মুসলিম উম্মাহ বিরোধী অপশক্তিকে সমর্থন করেনা। যুদ্ধ, সংঘাত, সন্ত্রাস ও জঙ্গীবাদে জর্জরিত মুসলিম দেশগুলো মূলত পশ্চিমা বিরোধী এমনকি এসব দেশ বৃহত্তর মুসলিম ঐক্য প্রতিষ্ঠার পক্ষে থাকলেও এখন নিজেরাই সন্ত্রাস কিংবা চাপিয়ে দেয়া যুদ্ধের শিকার।
চতুর্মুখী ষড়যন্ত্রের শিকার মুসলিম বিশ্ব: মুসলিম বিশ্বের অফুরন্ত প্রাকৃতিক সম্পদ ও ভূমি দখল করতে এবং জাতিগত বিদ্বেষ থেকে-
১. কম্যুনিটি জেনোসাইড: কম্যুনিটি জেনোসাইড হলো একটি জাতিকে নিঃশেষ করে দেয়ার জন্য টার্গেট কিলিং মিশন বা পরিকল্পিত গণহত্যা চালানো। বিশ্বজুড়ে মুসলিম জাতিকে নিশ্চিহ্ন করতে জায়নবাদী মার্কিন সাম্রাজ্যবাদী গোষ্ঠী, খৃষ্টবাদী গোষ্ঠী, হিন্দুত্ববাদী ও বৌদ্ধশক্তি একাট্টা হয়ে মুসলিম নিধনে নেমেছে। মুসলিম জাতির ইতিহাসের শুরু থেকেই এ চিত্র দৃশ্যমান। বর্তমানে এসে তার পুনরাবৃত্তি ঘটছে মাত্র। যার প্রমাণ আমরা দেখতে পাচ্ছি সাম্প্রতিক সময়ে মায়ানমারে রোহিঙ্গা মুসলিম নিধন, ভারতে গো-রক্ষার নামে মুসলিম নিধন, কাশ্মীরে মুসলিম নিধন, চীনে উইঘুর মুসলিম নিধন, ফিলিপাইনের মুসলিম অধ্যুষিত মিন্দানাওয়ে মুসলিম নিধন, চেচনিয়া ও বসনিয়াতে ককেশীয় মুসলিম নিধন, আফ্রিকায় মুসলিম নিধন, ইউরোপে ও আমেরিকায় হিজাব ইস্যুতে খুন ইত্যাদি চিত্রের মাধ্যমে। মূলত এই অঞ্চলগুলোর মুসলিম জনসংখ্যার বিরাট অংশই নামেমাত্র মুসলিম, প্র্যাকটিক্যাল মুসলিম নয়। ইস্যুর পর ইস্যু সৃষ্টি করে পরিকল্পিতভাবে মুসলিম জাতিকে নিশ্চিহ্ন করাই মূলত উদ্দেশ্য। সিরিয়া, আফগানিস্তান, ইরাক, তিউনিসিয়াতেও আমরা দেখেছি এ হত্যাযজ্ঞ। সবটাই বিধর্মীদের সুদূরপ্রসারী ষড়যন্ত্রের ফসল।
২. মুসলিম বিশ্বের অভ্যন্তরীণ কোন্দল ও বিরোধ: ধর্মীয় কেন্দ্রভূমি হবার কারণে সৌদি আরবের প্রতি গোটা মুসলিম বিশ্বের আলাদা সহানুভূতি প্রত্যক্ষ করা যায়। অন্যদিকে আধুনিক তুরস্ক মুসলিম বিশ্বের কল্যাণ ও সেবায় নিজেকে নিয়োজিত রেখেছে। ফলে মুসলিম বিশ্বের অন্তরে জায়গা করে নিয়েছে। এছাড়াও কাতার, ইরান, কুয়েত অর্থনৈতিকভাবে সম্পদশালী হওয়ায় বিশ্বে আলাদা অবস্থান করে নিয়েছে। তা সত্ত্বেও এই মুসলিম রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে পারস্পরিক বিরোধ পরোক্ষভাবে তুঙ্গে। বাতিল শক্তিগুলো ইসলাম অসমর্থিত রাজতন্ত্র হারানোর ভয় ঢুকিয়ে দিয়েছে সৌদি আরবের মনে, অন্যদিকে তুরস্ক আঞ্চলিক ইসলামী নেতৃত্বের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠতে পারে এ আশংকা করছে মধ্যপ্রাচ্যের অন্যান্য দেশগুলোর মনে। একইভাবে আরব বসন্তের পর মুসলিম ব্রাদারহুডের উত্থানের আশংকা প্রকাশ করে মধ্যপ্রাচ্যের অন্যান্য মুসলিম রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে অনৈক্যের বীজ জিইয়ে রেখেছে। ফলে অন্যান্য মুসলিম রাষ্ট্রগুলো কেউ সৌদি ব্লক, কেউ ইরান ব্লক, কেউ পাক-তুরস্ক ব্লকে দ্বিধা-বিভক্ত হয়ে রয়েছে। ইরানের সামরিক শক্তিকে অন্যদেশের জন্য হুমকি হিসেবে উপস্থাপন করারও চেষ্টা চলছে। একই লক্ষ্যে পাকিস্তানে ভাঙ্গন তৈরি করছে।
৩. মুসলিম দেশসমূহের অভ্যন্তরীণ সরকার-জনগণে মতানৈক্য ও বিরোধ: পশ্চিমা বিশ্বের কল্যাণে মুসলিম রাষ্ট্রসমূহের রাষ্ট্রপ্রধানের উপর জনগণের অনাস্থা তৈরি দেশে অস্থিতিশীলতা তৈরি অনেকখানি সফল হয়েছে। শুধু সরকার ও জনগণই নয় বিভিন্ন ধর্মীয় গোষ্ঠীর উদ্ভব, শিয়া-সুন্নী মতভেদ, মাযহাব কেন্দ্রিক মতবিরোধ উস্কে দিয়ে জনগণের মধ্যেও পরস্পরের প্রতি অবিশ্বাস, সন্দেহ, অসহিষ্ণুতা থেকে মারাত্মক রকমের বিপর্যয় সৃষ্টি হয়েছে। ইরাকে সাদ্দাম কর্তৃক আলেমদের হত্যা, ইরাক-ইরান যুদ্ধ তার জ্বলজ্যান্ত প্রমাণ।
৪. ইসলাম ফোবিয়া ও অপপ্রচার: ইসলামের নামে আল কায়েদা, বোকো হারাম ও আইএস এর মতো জঙ্গী সংগঠনের উদ্ভব ঘটিয়ে এবং কয়েকটি দেশে এই নাম ব্যবহার করে রক্তপাত ঘটানো, স্থাপনা ধ্বংস, ধর্ষণ ইত্যাদি কর্মকান্ডের মাধ্যমে গোটা বিশ্বজুড়ে ইসলাম ও মুসলমানদের ব্যাপারে আতংক ও ভয় ছড়িয়ে দেয়া হচ্ছে সুকৌশলে। ফলে সর্বত্র মুসলিমরা নিজেদের অস্তিত্ব নিয়ে সংকটে পড়েছে। অপমানিত ও লাঞ্ছিত হচ্ছে প্রতিনিয়ত। জঙ্গীবাদ ইস্যুকে ইসলাম ধর্মের পুঁজি হিসেবে উপস্থাপন করা হচ্ছে। আর এ কারণেই মূল ইসলামী ভাবধারার চর্চা, অনুশীলন এবং মুসলিমদের পরস্পরের ঐক্যকে খোদ মুসলিমরাই সন্দেহ ও ভয়ের চোখে দেখছে। গোটা বিশ্বের চোখে মুসলিমদের অবস্থানও দুর্বল হয়ে পড়ছে।
৫. সোশ্যাল ভ্যালু সিস্টেম ও হীনমন্যতাবোধ: পশ্চিমা বিশ্বের সৃষ্টি সোশ্যাল ভ্যালু সিস্টেম বা মূল্যবোধ মুসলিম বিশ্বের জন্য সূক্ষ্ম ও সুদূরপ্রসারী ষড়যন্ত্র। পশ্চিমা বিশ্ব যেভাবে ইসলাম ও মুসলিমদের মূল্যায়ন করছে ঠিক সেভাবেই মূল্যায়ন করতে শেখা এ সিস্টেমের মূলকথা। ফলে আমরা দেখতে পাচ্ছি একধরনের হীনমন্যতাবোধ তৈরি হচ্ছে বর্তমান মুসলিম প্রজন্মের মধ্যে। এ থেকেই তারা ইসলামের কথা বলা, শোনা ও ইসলাম চর্চা করতে ভয় পায়। ব্যক্তিগতভাবে কিছু কিছু পালন করলেও সামাজিক ও রাষ্ট্রীয়ভাবে ইসলামকে এড়িয়ে চলা, পরিত্যাগ করার মধ্যেই আধুনিকতা ও বিজ্ঞানমনস্কতা খোঁজে। সেজন্য ধর্মনিরপেক্ষতার নিচে নিশ্চিত ও নিরাপদ আশ্রয় অনুসন্ধান বর্তমান তথাকথিত মুসলিমদের অভিনব আবিষ্কার।
৬. ডিমোরালাইজেশন বা নৈতিক অবক্ষয়: মুসলিম বিশ্বে মদ, গাঁজা, আফিম, ইয়াবা, হিরোইনসহ নেশাজাতীয় দ্রব্যের রপ্তানি, উৎপাদনে সহযোগিতা, উৎসাহ দান, শিক্ষাখাতে মেধাবীদের রিক্রুট করে নিয়ে যাওয়া ও ব্রেইন ওয়াশ করে ইসলামের বিপক্ষে কাজে লাগানো, অন্যদিকে অশ্লীল চলচ্চিত্র ও সিনেমা রপ্তানি ও তৈরিতে সহযোগিতা, ভেজাল ও তাদের বিশ্বাস, চিন্তা-আদর্শ রচিত সাহিত্যকে মুসলিম বিশ্বে বাজারজাত করণ, নিজেদের সাংস্কৃতিক উৎসবগুলোকে বাণিজ্যিকীকরণে সফল উদ্যোগ বাস্তবায়নের মাধ্যমে মুসলিম বিশ্বের তরুণ প্রজন্মকে নৈতিক অবক্ষয়ের চূড়ান্ত পর্যায়ে ঠেলে দিচ্ছে।
৭. কুসংস্কার ও বেদআতের প্রচার: ইসলামের মৌলিক ধারা ও শরীয়তের রীতি-নীতি বিধানের মধ্যে সুকৌশলে বিজাতীয় রসম-রেওয়াজের অনুকরণ ও চর্চার অনুপ্রবেশ ঘটানো হয়েছে সুচিন্তিতভাবে। পরিকল্পনার মাধ্যমে। সাধারণ মুসলিম সমাজে এ জাতীয় রসম-রেওয়াজের চর্চায় অভ্যস্ত হয়েছে এবং অমুসলিমদের সাথে প্র্যাকটিক্যালি মিশে গিয়েছে। যাদের আলাদা করে মুসলিম হিসেবে চেনার উপায় নেই।
৮. শরণার্থী সমস্যা: নির্যাতিত মুসলিম বিশ্বের একটি বিশাল জনগোষ্ঠী নিজের রাষ্ট্র ছেড়ে বিভিন্ন রাষ্ট্রে আশ্রয় নিয়েছে শরণার্থী হিসেবে। খোলামাঠে বছরের পর বছর মানবেতর জীবন যাপন করছে। যাদের নিজস্ব ঘরবাড়ি নেই, রাষ্ট্র নেই, পরিচয় নেই। এই জনগোষ্ঠীর ভবিষ্যৎ কী? এর কোন আশু ও নিশ্চিত সমাধান নির্ণয় হয়নি আজো। সামাজিকীকরণ ও জাতি বিকাশ থেকে বঞ্চিত এ অংশটি।
৯. আন্তর্জাতিক ইসলামী সংগঠনগুলোর নিস্ক্রিয়তা: মুসলিম বিশ্বের পারস্পরিক দ্বন্দ্ব-সংঘাত কমিয়ে এনে সহযোগিতার সম্পর্ক নির্মাণের জন্য একমাত্র আন্তর্জাতিক ইসলামী সংগঠন ওআইসি, যা বাদশা ফয়সালের উদ্যোগে হয়েছিল ১৯৬৯ সালে। তৎকালীন দুই বিশ্বশক্তি পুঁজিবাদী আমেরিকা ও সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত ইউনিয়নের বিপরীতে এটিই ছিল যুগোপযোগী একমাত্র সমাধান। এই সংস্থাটির উদ্যোগে বিশ্বে ইসলামী ব্যাংকিং ব্যবস্থা প্রাতিষ্ঠানিক রূপ লাভ করে। যা সারা বিশ্বে আজ সমাদৃত। কিন্তু এর বিরুদ্ধে ইরাক-ইরান যুদ্ধ ছিল বাতিল শক্তির প্রথম সফল তীর নিক্ষেপ, যা ওআইসি’র ঐক্যে প্রথম ক্ষত সৃষ্টি করে। তবে এ যুদ্ধ বন্ধে ওআইসি’র মূখ্য ভূমিকা ছিল। কিন্তু পরিবর্তনশীল বিশ্বে মুসলিম বিশ্বের ঐক্য রক্ষার্থে এরপর ওআইসি কোনো উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করতে পারেনি। ফলে ইসলামী ঐক্যের বদলে মুসলিম বিশ্বে জাতিতাত্ত্বিক ঐক্য স্থায়ী আসন গেঁড়েছে।
১০. ভোগ-বিলাসিতা: পাশ্চাত্যের অনুকরণে সীমাহীন ভোগ বিলাসিতায় গা ভাসিয়ে দিয়েছে বিশ্বের ধনী মুসলিম রাষ্ট্রগুলো। অথচ সোমালিয়া, ঘানার মত মুসলিম দেশগুলো খাদ্যসংকটে ধুঁকে ধুঁকে মরছে। কোন কোন রাষ্ট্র স্বল্পোন্নত বা দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাসরত মুসলিম দেশগুলোকে সহযোগিতা করলেও তা প্রয়োজন ও চাহিদার তুলনায় একেবারেই অপ্রতুল। ক্রিকেট, ফুটবল খেলায় সর্বোচ্চ বিনিয়োগ রাষ্ট্রটি মুসলিম রাষ্ট্র। আবার পৃথিবীর সবচেয়ে দরিদ্র রাষ্ট্রটিও মুসলিম।
রাসূল (সা.)-এর ভবিষ্যৎবাণী: বর্তমান পরিস্থিতির সাথে রাসূল (সা.)-এর ভবিষ্যৎবাণী হুবহু মিলে যায়-
একসময় আমার উম্মতের উপর এমন একটি দুর্দিন আসবে, যেই দুর্দিনে মুসলমানরা নিজেদের অস্তিত্ব টিকাতে হিমশিম খাবে। প্রবাহিত পানির মধ্যে আবর্জনা ফেললে যেমন সেই আবর্জনা টিকে থাকতে পারে না, বরং পানির প্রবল স্রোতে তা ভাসিয়ে নিয়ে যায়। তেমনিভাবে মুসলমানেরা নিজেদের অস্তিত্ব টিকাতে পারবেনা, বেদ্বীন কাফেরের স্রোতে ভেসে যাবে। খাদ্যগ্রহণকারীরা দস্তরখানে বসে যেভাবে একে অপরকে ডাকতে থাকে খাওয়ার জন্য, তেমনিভাবে সারা দুনিয়ার বেদ্বীন কাফেররা একে অপরকে আহ্বান করতে থাকবে মুসলমানদেরকে গ্রাস করে ফেলার জন্য।
এ কথা শুনে সাহাবা কেরাম রাসূল (সা.)-কে বললেন- হে আল্লাহর রাসূল (সা.) আপনি যে যুগের কথা বললেন, সে যুগে কি মুসলমানদের সংখ্যা খুব কম হবে? জবাবে রাসূল (সা.) বললেন, না, তোমাদের সংখ্যার চেয়ে তখনকার মুসলমানদের সংখ্যা আরো বহুগুণ বেশী হবে।”
সাহাবীগণ বললেন, ওগো আল্লাহর রাসূল (সা.)! যে যুগে মুসলমান এত বেশি হবে, সেই যুগের মুসলমানরা বেদ্বীন কাফিরদের হাতে এত লাঞ্ছিত হবে কেন? জবাবে রাসূল (সা.) বলেন, দুটি কারণে তখনকার মুসলমানরা লাঞ্ছিত হবে।
১. দুনিয়ার ভালবাসা, ২. মৃত্যুভয়।” দুনিয়ার ভালবাসা হলো ক্ষণস্থায়ী জীবনের সুখ শান্তি আর ভোগ-বিলাস পাওয়ার জন্য রাতদিন পরিশ্রম করবে।
আর মৃত্যু হলো- মজলুম মুসলমানদের পক্ষ অবলম্বন করলে জালিম কাফিররা আমাকেও মেরে ফেলবে।
মুসলিম বিশ্বের ভবিষ্যৎ ও করণীয়: পিউ গবেষণা কেন্দ্রের হিসাব মতে, আগামী পঁয়ত্রিশ বছরে ইউরোপের জনসংখ্যার ১০ শতাংশ হবে মুসলিম, যা দ্বিতীয় বৃহত্তর ধর্মীয় জনগোষ্ঠী, যুক্তরাষ্ট্রেও মুসলিমরা দ্বিতীয় বৃহত্তম জনগোষ্ঠীতে পরিণত হবে। ভারতের মুসলিম জনসংখ্যা সব দেশের চেয়ে বেশি হবে, যা প্রায় ৩০ কোটি। আফ্রিকা মহাদেশেও মুসলমানদের সংখ্যা বেড়েই যাবে।
আগামী শতকে অর্থাৎ ২১০০ সালে বিশ্বের জনসংখ্যার ৩৫ শতাংশ হবে মুসলিম এবং ইসলাম সর্বাধিক মানুষের ধর্ম। এটি প্রচারের কারণে নয় বরং জন্মহার বাড়ার কারণে হবে।
ইহুদী ধর্ম, বৌদ্ধ, হিন্দু ও নাস্তিক্যবাদী বিশ্বাসীদের সংখ্যা কিছুটা বাড়লেও শতাংশের হার কমে আসবে।
ক্রমবর্ধমানহারে সংখ্যাতাত্ত্বিক দিক থেকে মুসলিম শক্তি বাড়লেও মুসলিম বিশ্বের বিবদমান সমস্যার নিরসন না হলে গোটা বিশ্বে মুসলিম ও ইসলাম কোণঠাসা হয়ে পড়বে শতগুণ। তাই খুঁজতে হবে সমাধান ও করণীয়।
এক্ষেত্রে রাসূল (সা.)-এর শাশ্বত সমাধান হলো-
১. তোমাদের জন্য আমি রেখে যাচ্ছি দুটি বস্তু। যদি তোমরা এ দুটিকে আঁকড়ে ধরো তাহলে কখনো পথভ্রষ্ট হবেনা। আর তা হলো কুরআন ও সুন্নাহ।
২. এক মুমিনের জন্য অন্য মুমিনের জান ও মাল হারাম।
৩. তোমরা আল্লাহর রজ্জুকে পরস্পর মজবুতভাবে আঁকড়ে ধরো এবং পরস্পর বিচ্ছিন্ন হয়োনা। -সূরা ইমরান: ১০৩
এই আলোকে করণীয় হতে পারে-
১. কুরআন ও সুন্নাহর একনিষ্ঠ চর্চা, ব্যক্তিগত, সামাজিক, পারিবারিক ও রাষ্ট্রীয় জীবনে।
২. মুসলিম বিশ্বের রাষ্ট্রগুলোর পারস্পরিক ঐক্য ও সংহতির সংরক্ষণ ও মুসলিম ভ্রাতৃত্ব গঠন।
৩. আন্তর্জাতিক ইসলামী সংগঠনকে সক্রিয় ও উদ্যমী ভূমিকায় আনা।
৪. বাতিল শক্তিকে শিক্ষা, সংস্কৃতি, সামরিক দিক থেকে যুগপৎ ও ঐক্যবদ্ধভাবে মোকাবেলা করা।
৫. নির্যাতিত ও মজলুম মুসলিম দেশগুলোর সহায়তা করা সর্বোতভাবে।
৬. মেধাগুলোকে পরিচর্যার মাধ্যমে ইসলামী স্কলার, বিজ্ঞানী, প্রযুক্তিবিদ তৈরি করে ইসলামী সভ্যতা-সংস্কৃতির বিকাশ সাধন করা।
৭. বিলাসিতা ও ক্ষমতার মোহ স্বার্থ পরিত্যাগ করা।
৮. মুসলিম রাষ্ট্রগুলোতে শক্তিশালী সেনাবাহিনী গঠন করা এবং সমগ্র মুসলিম বিশ্বে একটি শক্তিশালী সামরিক জোট হতে পারে চমৎকার সমাধান। তাহলে আগামীর শতাব্দী হবে ইসলামী শতাব্দী, আগামীর বিশ্ব হবে ইসলামী বিশ্ব ইনশাআল্লাহ।