বারবার অন্যায়ের শিকার ফিলিস্তিনীরা
মোহাম্মদ আবু নোমান: গাজায় ইসরায়েল যা করছে তা স্পষ্টতই ‘জাতিগত নিধন ও গণহত্যা।’ ৭০ জন নিহত ও আড়াই হাজারকে আহত করে ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু বলেছেন, ‘আজকের দিনটি মহিমান্বিত। এই মুহূর্তটা চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে।’ ১৪ মে তেলআবিব থেকে অধিকৃত পশ্চিম জেরুসালেমে দূতাবাস স্থানান্তর করেছে যুক্তরাষ্ট্র। আর এ কার্যক্রম উদ্বোধনের বিরোধীতায় বিক্ষোভে উত্তাল হয়ে ওঠে গাজা। ‘গ্রেট মার্চ অব রিটার্ন’ নামের সীমান্ত আন্দোলনের অংশ হিসেবেই স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্য সংগ্রামী ফিলিস্তিনিদের গণবিক্ষোভ ও সেনাবাহিনীর ওপর পাথর ছুড়ে মারায় চড়াও হয় ইসরাইলী বাহিনী। ফিলিস্তিনী কিশোর-তরুণ ও প্রতিবাদী জনতার ইট-পাটকেলের বিরুদ্ধে ইসরাইলী সেনারা রীতিমতো স্বয়ংক্রিয় আগ্নেয়াস্ত্র চালিয়েছে। এই অসম সংঘাতে স্বভাবতই প্রাণহানি ও আহত হওয়ার ঘটনা ছিল একতরফা। এদের মধ্যে ১২২ জনের বয়স ১৮ বছরের নিচে। আহতদের বেশীরভাগই গুলিবিদ্ধ, যাদের মধ্যে ৪৪ নারী ও ১১ সংবাদকর্মীও রয়েছেন।
ফিলিস্তিনীদের ঘুম ভাঙে মৃত্যুর আশংকা নিয়ে। জমি দখল ও হত্যা দুটিই ইসরাইলীদের কাছে ডাল ভাত। গত ৩০ মার্চ থেকেই সাপ্তাহিক সীমান্ত বিক্ষোভ করে আসছে ফিলিস্তিনীরা। এসব বিক্ষোভে ইসরাইলী বাহিনী ১৪ মের আগেই অন্তত ৫০ ফিলিস্তিনী নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন আরও আট হাজার।
ট্রাম্প সরাসরি বহু বিতর্কিত নতুন দূতাবাস উদ্বোধন অনুষ্ঠানে যোগ না দিলেও তার কন্যা ইভানকা ট্রাম্প ও তার স্বামী প্রেসিডেন্টের উপদেষ্টা জারেড কুশনার এতে অংশ নিয়েছে। গত ডিসেম্বরে ইসরায়েলের তেলআবিব থেকে জেরুসালেমে দূতাবাস সরানোর বিতর্কিত সিদ্ধান্ত ঘোষণা করে ট্রাম্প। তার ঘোষণার প্রতিক্রিয়ায় সারাবিশ্বে নিন্দার ঝড় উঠেছিল। উদ্বেগ প্রকাশ করেছে জাতিসংঘ ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের মতো জোটও। জেরুজালেমে যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাস স্থানান্তরের দ্বারা ডোনাল্ড ট্রাম্প আরও একটি উসকানিমূলক, নিন্দনীয় এবং অন্যায় কাজ করলেন। আর ১৯৪৮-এর পর আবারও ফিলিস্তিনী জনগণ, যারা ঐতিহাসিকভাবে এই নগরীর স্থায়ী বাসিন্দা, তারা অন্যায়ের শিকার হলো।
মধ্যপ্রাচ্যের বিষফোঁড়া খ্যাত ইসরাইল যুগে যুগেই বিশ্বের সবচেয়ে বড় সম্প্রসারণবাদী, সন্ত্রাসী, দখলদার ও দখলদার দেশের সহযোগী হয়ে দানবীয় শক্তি দেখিয়েছে। যার জন্য এই ইহুদিদেরকে খ্রিষ্টানরা মেরেছে! নাতসিরা মেরেছে! ইংরেজ ও ব্রিটিশরা মেরেছে! ইউরোপ থেকে নির্বাসিত হয়েছে!! এডলফ হিটলার প্রায় ৬০ লক্ষ ইহুদি মারার পর তার আত্মজীবনীতে লিখেছিলেন- ‘আমি ইচ্ছা করলে সব ইহুদিদেরকে মেরে ফেলতে পারতাম। কিন্তু কিছু রেখে দিলাম এ জন্য যে, পরবর্তী প্রজন্মরা বুঝতে পারে ওরা কত জঘন্য, আর কেন আমি ইহুদি বিদ্বেষী ছিলাম’।
বর্তমানে যেসব আরব ফিলিস্তিন ভূখন্ডে বসবাস করছেন, তারাই এই অঞ্চলের, এই ভূখন্ডের ভূমিপুত্র। এরাই অতীতে ইহুদি, খ্রিস্টান, মুর্তি পূজারী ছিল এবং সময়ের পরিক্রমায় এই আরবরা বেশিরভাগ এখন মুসলিম। কিন্তু যারা বর্তমানে ইসরাইলে বসবাস করছে তারা ৯০ ভাগ ইউরোপসহ বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে বিতাড়িত হয়ে এখানে এসেছে। যদিও এই আগমনের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল ১৯১৯ সালের দিকে ব্রিটিশ মন্ত্রী বেলফোর ঘোষণার মধ্য দিয়ে। তার মানে, এখন যারা ইসরাইলে বসবাস করছে তারা বহিরাগত। সুতরাং ফিলিস্তিনী মুসলিমরাই এ ভুমির ভূমি সন্তান। আর ইসরাইলীরা মূলত ইউরোপ থেকে নির্বাসিত যাদের পিতৃপুরুষ কখনই ফিলিস্তিনের বাসিন্দা ছিল না।
জেরুসালেমে দূতাবাস ঘোষণার প্রতিবাদ করায় ইতোমধ্যে গাজা উপত্যকার প্রায় ৭০ শতাংশ বাসিন্দা বিতাড়িত হয়ে নিজেদের মাতৃভূমি হারিয়েছেন। তা ছাড়া সেখানে কোনো কর্মসংস্থান না থাকায় প্রতিদিন ফিলিস্তিনীদের সেখান থেকে পার্শ্ববর্তী অন্যান্য দেশে কাজের সূত্রে যেতে হয়। তাদের এই যাতায়াত এবং চলাচল শান্তিপূর্ণ হতে পারছে না ইসরাইলী চেকপোস্টে নানা হয়রানির কারণে।
বিক্ষোভ দমনে ইসরায়েলের সেনাশক্তি ব্যবহারের নিন্দায় জাতিসংঘের মানবাধিকার সংস্থার মুখপাত্র রুপার্ট কোলভিল বলেছেন, ‘সীমানাবেড়ার কাছে এগিয়ে আসা ধ্বংসাত্মক ও জীবননাশী কোনো কার্যক্রম নয়। সুতরাং তাদের ওপর গুলী চালানো যাবে না।’ তিনি আরও প্রশ্ন রাখেন, ‘অত বড় বেড়া, অস্ত্রসজ্জিত সেনাদল; তা হলে ওপার থেকে দুই পা নেই এমন কোনো ব্যক্তি কতখানি হুমকি হয়ে গেল?’ ইসরায়েল আন্তর্জাতিক আইন অমান্য করছে বলেও তিনি অভিযোগ করেন। জাতিসংঘের মানবাধিকার সংস্থার প্রধান জাইদ রা’আদ আল হুসেন বলেন, ‘ভয়ঙ্কর মানবাধিকার লঙ্ঘনকারীদের অবশ্যই আইনের আওতায় আনতে হবে।’
দীর্ঘ ৭০ বছরের বঞ্চনা ও নির্যাতনের ফলে স্বভাবতই ফিলিস্তিনী জনগণের মনে ক্ষোভ জন্মেছে। এই সত্তর বছরে তাদের একাধিক প্রজন্ম জন্ম নিয়েছে শরণার্থী শিবিরে, প্রত্যেক পরিবারে রয়েছে শহিদ বা অন্যায়-অত্যাচার-নির্যাতনের শিকার মানুষ। আপন মাতৃভূমি থেকে তারা বিতাড়িত হয়েছে, ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত হয়েছে, স্বাভাবিক জীবন তাদের অস্বীকৃত হয়েছে। এভাবে বড় হওয়া তরুণদের মধ্যে ক্ষোভ ও ক্রোধ জন্ম নেওয়াই স্বাভাবিক। ফলে এলাকায় শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য জাতিসংঘসহ বিশ্ব সম্প্রদায়কে ন্যায়বিচারের কথা ভাবতে হবে, মানবাধিকার প্রতিষ্ঠাকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। কিন্তু বরাবর যুক্তরাষ্ট্র ও তার পশ্চিমা মিত্ররা ইসরায়েলকে প্রশ্রয় দিয়ে গেছে। তারই সর্বশেষ দৃষ্টান্ত হলো জেরুসালেমে একতরফা ইসরাইলের রাজধানী স্থাপন ও সেখানে যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাস উদ্বোধন।
অন্যের ভূমি দখল করার পর সেখানে শান্তিপূর্ণ বসবাস বলা যায় না। বিশ্ব মুসলিমদের অন্যতম পবিত্রতম মসজিদ আল আকসা বা বায়তুল মোকাদ্দাস যে শহরে অবস্থিত, সেই জেরুসালেমকে ইসরাইলের রাজধানী প্রতিষ্ঠা করে ট্রাম্প মধ্যপ্রাচ্যের সংকটের আগুনে নতুন ঘি ঢালার সাথে সহিসংতা উসকে আগুনের বৃত্তে ছুড়ে ইসরাইলকে আবারো খুশী করেছেন। অন্যদের ভূখন্ড দখল করে রাষ্ট্র ও বৈধ রাজধানী হতে পারে কি? একথা ঠিক যে, জেরুসালেমকে ইসরাইলের রাজধানী হিসেবে স্বীকৃতির মতো একতরফা, একগুঁয়েমি, অযৌক্তিক, অন্যায়, অগ্রহণযোগ্য ও অপরিণামদর্শী দুঃখজনক সিদ্ধান্তের ফলে কখনোই গোটা ইসরাইলে শান্তি ফিরে আসবে না।