বিশ্বে বাস্তুচ্যুত মানুষের সংখ্যা প্রায় ৭ কোটি
জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক সংস্থা- ইউএনএইচসিআর বলছে যুদ্ধ, অন্যান্য সহিংসতা এবং নির্যাতন বিশ্বব্যাপী জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুতির নতুন মাত্রা দিয়েছে যা ২০১৭ সালে টানা পঞ্চমবারের মতো বৃদ্ধি পেয়েছে।
কঙ্গোর সংকট, দক্ষিণ সুদানের যুদ্ধ এবং মিয়ানমার থেকে লাখ লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থীর বাংলাদেশে পালিয়ে আসার মতো ঘটনা জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুতির ক্ষেত্রে মুখ্য ভূমিকা পালন করেছে। এতে মূলত উন্নয়নশীল দেশগুলোই বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে ।
মঙ্গলবার প্রকাশিত বাৎসরিক গ্লোবাল ট্রেন্ডস রিপোর্টে ইউএনএইচসিআর আরো জানায়, ২০১৭ সালের শেষের দিকে ছয় কোটি ৮৫ লাখ মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছে। এর মধ্যে শুধু ২০১৭ সালেই বাস্তুচ্যুত হয়েছে এক কোটি ৬২ লাখ মানুষ যা দৈনিক ৪৪ হাজার ৫০০ জন অথবা প্রতি দুই সেকেন্ডে একজনের বাস্তুচ্যুতির সমান।
সংঘাত এবং নিপীড়ন থেকে বাঁচতে নিজের দেশ ছেড়ে পালিয়েছে এমন শরণার্থীদের সংখ্যা দুই কোটি ৫৪ লাখ। এটি ২০১৬ সালের চেয়ে ২৯ লাখ বেশি এবং ইউএনএইচসিআর-এর দেখা একটি নির্দিষ্ট বছরে সবচেয়ে বড় বৃদ্ধি।
২০১৭ সালের ৩১ ডিসেম্বর নাগাদ আশ্রয়প্রার্থী যারা শরণার্থী মর্যাদা পেতে আবেদন করে ফলাফলের জন্য এখনো অপেক্ষমাণ তাদের সংখ্যা তিন লাখ থেকে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩১ লাখ। যেসব মানুষ নিজের দেশের অভ্যন্তরে বাস্তুচ্যুত তাদের সংখ্যা মোট চার কোটি যা ২০১৬ সালের চার কোটি তিন লাখ থেকে কিছুটা কমেছে।
সংক্ষিপ্তভাবে পৃথিবীতে এখন শরণার্থীর সংখ্যা অস্ট্রেলিয়ার মোট জনসংখ্যার চেয়ে বেশি। জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত মানুষের সংখ্যা প্রায় থাইল্যান্ডের মোট জনসংখ্যার সমান।
জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক হাই কমিশনার ফিলিপো গ্র্যান্ডি বলেন, ‘আমরা একটা সন্ধিক্ষণে আছি যেখানে বিশ্বব্যাপী জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুতদের ব্যবস্থাপনা সফলতার জন্য দরকার নতুন এবং অধিক সর্বাঙ্গীন পন্থা যাতে দেশ এবং জনসমষ্টিকে এই সমস্যা একা মোকাবেলা করতে না হয়।’
‘কিন্তু সেখানে আশাজনক কিছু কারণ আছে। শরণার্থী পরিস্থিতিতে সাড়া দেয়ার জন্য ইতিমধ্যে ১৪টি দেশ একটি নতুন পরিকল্পনা বাস্তবায়নে অগ্রণী ভুমিকা পালন করছে এবং আগামী কয়েক মাসের মধ্যেই শরণার্থীদের ওপর একটি নতুন গ্লোবাল কম্প্যাক্ট জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ কর্তৃক গ্রহণের জন্য প্রস্তুত হবে। আন্তর্জাতিক শরণার্থী দিবসে সদস্য রাষ্ট্রগুলোর প্রতি আমার বার্তা হচ্ছে দয়া করে আপনারা এটিকে সমর্থন করুন। কেউই স্বেচ্ছায় শরণার্থী হয় না। কিন্তু বাদবাকি আমরা যারা আছি আমাদের কাছে সেই বিকল্প আছে যে কিভাবে আমরা তাদের সাহায্য করব।’
২০ জুন আন্তর্জাতিক শরণার্থী দিবসকে সামনে রেখে প্রতিবছর ইউএনএইচসিআর-এর গ্লোবাল ট্রেন্ডস রিপোর্টটি বিশ্বব্যাপী বের করা হয় এবং জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুতির উপর ইউএনএইচসিআর, সরকার ও অন্যান্য সহযোগী সংস্থা কর্তৃক সংগৃহীত তথ্য তুলে ধরা হয়।
তবে এটি বিশ্বব্যাপী আশ্রয়প্রার্থিতার পরিস্থিতি যাচাই করে না যা ইউএনএইচসিআর আলাদাভাবে প্রতিবেদন দেয় এবং যা ২০১৭ সালেও চলমান আছে জোরপূর্বক ফেরত, রাজনীতিকরণ, শরণার্থীদের বলি বানানো, শরণার্থীদের জেলে রাখা অথবা কাজ করার সুযোগ অস্বীকার করা এবং বিভিন্ন দেশে ‘শরণার্থী’ শব্দটিকে ব্যবহার পরিহার করার মতো বিভিন্ন ঘটনা পর্যবেক্ষণের জন্য।
গ্লোবাল ট্রেন্ডস রিপোর্টটি বিভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বিশেষ করে জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুতির উপর বাস্তব সত্যের এবং অনুভূত সত্যের মধ্যেকার পার্থক্যের ইঙ্গিত দেয়।
এর মধ্যে রয়েছে এমন ধারণা যে বিশ্বব্যাপী বাস্তুচ্যুতরা মূলত পৃথিবীর উত্তরপ্রান্তের। কিন্তু তথ্য উপাত্ত বলছে– প্রায় শতকরা ৮৫ ভাগ শরণার্থী হচ্ছে উন্নয়নশীল দেশে যাদের মধ্যে বেশির ভাগই হচ্ছে অত্যন্ত গরীব এবং খুব সীমিত সংখ্যক সাহায্য পায় এসব মানুষকে সহায়তার জন্য। পাঁচ জনের মধ্যে চার জন শরণার্থী তাদের দেশের পার্শ্ববর্তী দেশে আশ্রয় নেয় ।
জোরপূর্বক পালানো মানুষের তিন ভাগের প্রায় দুই ভাগ হচ্ছে অভ্যন্তরীণ বাস্তুচ্যুত যারা তাদের নিজ দেশ ছেড়ে চলে যায়নি। তাদের মধ্যে দুই কোটি ৫৪ লাখ হচ্ছে শরণার্থী, ইউএনআরডব্লিউএ এর তত্ত্বাবধানে এক পঞ্চমাংশের একটু বেশি হচ্ছে ফিলিস্তিনি । বাকিদের মধ্যে যাদেরকে ইউএনএইচসিআর দেখছে দুই তৃতীয়াংশ এসেছে মাত্র পাঁচটি দেশ- সিরিয়া, আফগানিস্তান, দক্ষিণ সুদান, মিয়ানমার এবং সোমালিয়া থেকে। এ দেশগুলোর যেকোনো একটাতে সহিংসতা বন্ধ হলেই বিশ্বব্যাপী বাস্তুচ্যুতির চিত্রের এক বিশাল পরিবর্তন লক্ষ্য করা যাবে।
গ্লোবাল ট্রেন্ডস-এর আরো দুটি বড় দিক হচ্ছে বেশির ভাগ শরণার্থী বাস করছে শহর এলাকায়, (শতকরা ৫৮ ভাগ) যারা কোন ক্যাম্পে বা গ্রাম এলাকায় থাকে না এবং বিশ্বব্যাপী বাস্তুচ্যুত জনগোষ্ঠী মূলত কম বয়সী- শতকরা ৫৩ ভাগ হচ্ছে শিশু, যাদের মধ্যে রয়েছে নিজ পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ার মতো শিশুও ।
সংখ্যার দিক থেকে তুরস্ক সবচেয়ে বেশি শরণার্থী গ্রহণকারী দেশ যার সংখ্যা ৩৫ লাখ যারা মূলত সিরিয়ার নাগরিক। জাতীয় জনসংখ্যার অনুপাতে বেশি শরণার্থী গ্রহণ করছে লেবানন। সব মিলিয়ে ইউএনএইচসিআর-এর অধীনে শতকরা ৬৩ ভাগ শরণার্থী থাকে শুধুমাত্র ১০টি দেশে ।
সবশেষে ইউএনএইচসিআর জানায়, দুঃখজনক হলেও এসবের সমাধান এখনও থেমে আছে শুধুমাত্র খন্ডকালীন সেবা বা সামগ্রী প্রদানে। যুদ্ধ এবং হানাহানি এগিয়ে চলছে যেখানে শান্তির বাতাস খুব কমই বইছে।
২০১৭ সালে প্রায় ৫০ লাখের মতো মানুষ নিজ দেশে ফিরতে পেরেছিল যাদের বেশির ভাগ ফিরেছে অভ্যন্তরীণ বাস্তুচ্যুতি থেকে। কিন্তু তাদের মধ্য থেকে অনেকেই ফিরেছে খুব খারাপ অবস্থায়। তৃতীয় কোন দেশে স্থানান্তরের জন্য সুযোগ কমে যাওয়ায় পুনর্বাসনের পরিমান প্রায় শতকরা ৪০ ভাগ কমে গেছে যা প্রায় এক লাখের মতো। -ইউএনবি