সেনাবাহিনীকে বাঁচাতে মরিয়া মিয়ানমার
জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশন অভিযোগ করে বলেছে, রোহিঙ্গা নিধনের ঘটনায় মিয়ানমার সেদেশের সেনাবাহিনীকে দায়মুক্তি দিতে মরিয়া হয়ে প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। এ অবস্থায় নিরাপত্তা পরিষদের হস্তক্ষেপ জরুরি হয়ে পড়েছে। দায়িত্ব ছাড়ার আগ মুহূর্তে দেওয়া বক্তব্যে কমিশনের প্রধান স্বাধীন তদন্ত নিশ্চিতে জাতিসংঘ প্রতিনিধিকে প্রবেশাধিকার দিতে মিয়ানমারের প্রতি আহবান জানান। দোষীদের বিচারের আওতায় নিতে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের পদক্ষেপ কামনা করেন তিনি।
গত ২৫ আগস্ট রাখাইনের কয়েকটি নিরাপত্তা চৌকিতে হামলার পর পূর্ব-পরিকল্পিত ও কাঠামোবদ্ধ সহিংসতা জোরালো করে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী। সন্ত্রাসবিরোধী শুদ্ধি অভিযানের নামে শুরু হয় নিধনযজ্ঞ। হত্যা-ধর্ষণসহ বিভিন্ন ধারার মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটিত হতে থাকে ধারাবাহিকভাবে। তবে মিয়ানমার সেনাবাহিনী বরাবরই এই অভিযোগ উড়িয়ে দিয়েছে। এমন অবস্থায় দায়িত্ব ছাড়ার আগ মুহূর্তে জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশনের প্রধান জেইদ রাদ আল হোসেন অভিযোগ করেছেন, সেনাবাহিনীকে বাঁচাতে মিয়ানমার সমস্ত শক্তি দিয়ে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে। মিয়ানমার সরকারের দাবি আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মির (আরসা) হামলার কারণেই রোহিঙ্গা সংকটের উদ্ভব।
সম্প্রতি তারা আরসার বিরুদ্ধে ওঠা মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ খতিয়ে দেখতে স্বাধীন তদন্ত কমিশন গঠনের ঘোষণা দিয়েছে। এদিকে বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থার পক্ষ থেকে রাখাইনে জাতিসংঘের স্বাধীন তদন্ত দাবি করা হলেও মিয়ানমার এতে রাজি হয়নি।
খবরে বলা হয়, মিয়ানমারের রোহিঙ্গা মুসলমানদের ওপর হত্যা ও দমন-পীড়ন অব্যাহত রয়েছে। মিয়ানমারের সরকার ও উগ্রবাদী বৌদ্ধদের নির্মম নির্যাতনের মুখে টিকতে না পেরে চলতি ২০১৮ সালে ১১ হাজার ৪৩২ জন রোহিঙ্গা মুসলমান পালাতে বাধ্য হয়েছে। জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাই কমিশনার জেইদ রা’দ আল-হোসেইন এ তথ্য জানিয়েছেন। বুধবার জাতিসংঘ মানবাধিকার পরিষদে বক্তৃতা করার সময় জেইদ বলেন, মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য থেকে রোহিঙ্গা মুসলমানদের পালিয়ে যাওয়া অব্যাহত রয়েছে এবং তাদের ওপর সহিংসতা, নির্যাতন, হত্যা ও ঘর-বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেয়ার অনেক প্রমাণ রয়েছে।
জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক প্রধান বলেন, বহু রোহিঙ্গা উদ্বাস্তু জানিয়েছে যে, মিয়ানমার সরকারের চাপের মুখে তারা অনেকেই ন্যাশনাল ভেরিফিকেশন কার্ড নিতে বাধ্য হয়েছে। যারা এ কার্ড নেয় তারা মিয়ানমার সরকারের কাছে দেশটির নাগরিকত্ব গ্রহণের জন্য আবেদন করতে বাধ্য হয়।
জেইদ আল-হোসেইন বলেন, কোনো বাগাড়ম্বর এসব বাস্তবতা মুছে দিতে পারবে না। লোকজন এখনো রাখাইন রাজ্য থেকে পালাচ্ছে এমনকি তারা পালাতে গিয়ে সমুদ্রের ভেতরে মৃত্যুর ঝুঁকিও নিচ্ছে।”
দায়িত্ব ছাড়ার আগে শেষ প্রতিক্রিয়ায় মিয়ানমারের রোহিঙ্গা হত্যাকান্ডের তীব্র সমালোচনা করলেন জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশনের প্রধান। চার বছরের দায়িত্ব পালনকালে তার দেখা নিপীড়নের মধ্যে রোহিঙ্গাদের ওপর সংঘটিত মানাবাধিকার অপরাধকে স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন আখ্যা দিয়েছেন তিনি। রাখাইনে সংঘটিত নিপীড়ন হত্যাসহ যাবতীয় ধারার মানবতাবিরোধী অপরাধে সর্বশেষ পরিস্থিতি তুলে ধরে তিনি মিয়ানমারের উদ্দেশ্যে বলেছেন তাদের লজ্জা হওয়া উচিত।
মানবাধিকার সংগঠনের স্যাটেলাইট ইমেজ, আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদন আর পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা থেকে জানা যায়, মায়ের কোল থেকে শিশুকে কেড়ে শূন্যে ছুড়তে থাকে সেনারা। কখনও কখনও কেটে ফেলা হয় তাদের গলা। জীবন্ত পুড়িয়ে মারা হয় মানুষকে। এমন বাস্তবতায় হত্যাকান্ডের বলি হয়ে রাখাইন ছেড়ে পালিয়ে আসতে বাধ্য হয় অন্তত সাত লাখ রোহিঙ্গা। সে কারণেই সম্ভবত; অনেক কষ্ট সত্তেও মিয়ানমারের চেয়ে এ শিবিরকেই নিরাপদ জায়গা মনে করেন রোহিঙ্গারা।
জেইদ বলেন, ‘আমি চার বছর ধরে হাইকমিশনারের দায়িত্বপালন করছি। অনেক নিপীড়ন দেখেছি। কিন্তু এটা একদমই নতুন। আপনাদের লজ্জা হওয়া উচিত স্যার। আমরা বোকা নই। মানবাধিকার পরিষদের ৩৮তম অধিবেশনের পর আর কোনও বৈঠক হচ্ছে না। দায়িত্ব ছাড়ার আগে এটাই জেইদ হোসেনের শেষ বক্তব্য। তিনি বলেন, জাতিসংঘের যদি কোনও সদস্য রাষ্ট্র যদি তিনদিনের সহিংসতায় ৭ লাখ মানুষকে তাড়িয়ে দিতে সক্ষম হয় এবং তাতে কোনও আন্তর্জাতিক চাপ না আসে, তবে এই রুমে থাকা বাকিরাও এমনটা করতে পারে।
সর্বশেষ পরিস্থিতি তুলে ধরতে গিয়ে একটি উদাহরণ টেনে হাই কমিশনার বলেন, জানুয়ারি থেকে এপ্রিলের মাঝে ৫৮ জন রোহিঙ্গা মিয়ানমারে ফেরত গেছে এবং তাদের বিভিন্ন অভিযোগে আটক করা হয়েছে। এরপর প্রেসিডেন্ট তাদের ক্ষমা করলেও বুথিয়াডং কারাগারে পাঠানো হয়। তবে একে বলা হয় ‘রিসিপশন সেন্টার’।
প্রভাবশালী ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম দ্য গার্ডিয়ানের এপ্রিলের এক বিশেষ প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, সেই সময় মিয়ানমারে ক্ষমতার পটপরিবর্তনে সু চির বেসামরিক সরকার শক্তিশালী অবস্থানে রয়েছে।