গোপনে ভূমিষ্ঠ হচ্ছে ‘অনাকাক্সিক্ষত’ রোহিঙ্গা নবজাতক

rohingyaসেনা নিধনযজ্ঞ থেকে পালিয়ে বাংলাদেশে আসবার সময় অনেক রোহিঙ্গা নারীই তাদের শরীরে বহন করে এনেছে ‘অনাকাক্সিক্ষত’ জীবনের সম্ভাবনা। সেনাবাহিনীর পরিকল্পিত ও কাঠামোবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হওয়া সেই নারীদের কেউ কেউ গর্ভপাত ঘটিয়ে রেহাই পাওয়ার চেষ্টা করেছে। তবে কেউ কেউ গর্ভপাত ঘটাতে ক্লিনিকে যেতে পারেনি লোকলজ্জার ভয়ে। কেউ ক্লিনিক পর্যন্ত গেলেও মৃত্যুভয়ে ফিরেছে শরণার্থী শিবিরে পাওয়া নিজের একটুকরো আবাস ভূমিতে। এদের গর্ভ থেকে ভূমিষ্ঠ হচ্ছে অপ্রার্থিত-অনাকাক্সিক্ষত নবজাতক। নিপীড়নের ভয়াবহ স্মৃতিচিহ্নের সঙ্গে মিলেমিশে একাকার হয়ে তারা পরিণত হচ্ছে খোদ জন্মদাত্রীর ঘৃণার পাত্রে। ধর্ষণের শিকার নারীদের প্রতি সমাজের নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গির কারণে অনেক শিশুকেই জন্ম দেওয়া হচ্ছে সবার অগোচরে।
রাখাইন থেকে বাংলাদেশের কক্সবাজারের শিবিরে আশ্রয় নেওয়ার পর অনেক রোহিঙ্গা নারীকে দেখা গেছে আতঙ্কে থাকতে। ভয়াবহ সেই ঘটনার স্মৃতি তো আছেই, সেইসঙ্গে রয়েছে সমাজ ও পরিবার থেকে বিচ্যুত হওয়ার ভয়। সে ভয় থেকে নিজেদেরকে গুটিয়ে রেখেছে তারা। অনেকে আবার লোক জানাজানি হওয়ার ভয়ে ক্যাম্প থেকে বেরও হতে চাইছেন না। কেউ কেউ গর্ভাবস্থাকে নিজে নিজেই সামলে নিচ্ছে, চিকিৎসা কেন্দ্রেও আসতে আগ্রহী নয় তারা। ধর্ষণের শিকার রোহিঙ্গা নারী ও তাদের সন্তান জন্মদানের আতঙ্ক ও অনিশ্চয়তা নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে মার্কিন বার্তা সংস্থা এপি।
সমাজে প্রায়ই ধর্ষণের শিকার নারীকে কলঙ্ক হিসেবে বিবেচনা করতে দেখা যায়। আর ধর্ষণের পর গর্ভধারণ ও সন্তান জন্ম দিতে গেলে পড়তে হয় আরও ভয়াবহ পরিস্থিতিতে। আর সেই প্রবণতা নিয়ে ভীত রোহিঙ্গা নারীরা। সে ভয়ে অনেকে সস্তা মূল্যের গর্ভপাতের পিল খেয়ে শুরুর দিকের অবস্থায় গর্ভপাত করিয়েছে। কেউ কেউ আবার ‘অনাকাঙ্ক্ষিত’ সন্তানের জন্ম দিয়েছে। অনেকে আবার সদ্যোজাত সন্তানকে দূরে ফেলে আসবে কিনা তা ভেবে সন্দিহান হয়ে পড়ছে। এপি’র প্রতিবেদনে বলা হয়, এক নারী তো লোক জানাজানি হওয়ার ভয়ে আশ্রয়কেন্দ্রে নিজে নিজেই সন্তানের জন্ম দিয়েছেন। বাইরে যেন শব্দ না যায় তা নিশ্চিত করতে একটি কাপড় কামড়ে ছিলেন তিনি।
গত বছর মিয়ানমারের সেনাদের হাতে ধর্ষণের শিকার হন ‘এ’ (নামের আদ্যক্ষর) নামের এক রোহিঙ্গা নারী। ধর্ষণের শিকার হওয়ার সময় তার বয়স ছিল ১৩ বছর। এরপর পরিবারসহ বাংলাদেশে পালিয়ে আসে সে। ধীরে ধীরে শরীর জানান দিতে থাকে আরেক শরীরের অস্তিত্ব। ‘এ’ এর কাছে এমন গর্ভাবস্থা যেন এক কারাগারের নাম। সেখান থেকে প্রতিনিয়ত পালিয়ে বেড়ানোর জন্য চলতে থাকে মরিয়া প্রচেষ্টা। বাংলাদেশের রোহিঙ্গা শিবিরের ঘরগুলোর দেয়াল প্লাস্টিকের তৈরি। খুব সহজেই শব্দ শোনা যায়। রোহিঙ্গা কিশোরী ‘এ’ জানতো গর্ভাবস্থার কথাটা লুকানোটা সহজসাধ্য নয়। নবজাতক শিশুকে লুকিয়ে রাখাটাই কঠিন। সে আরও ভাবতে লাগলো, এ সন্তানকে জন্ম দিলে কেউ তাকে বিয়ে করতে চাইবে না। আতঙ্কিত হয়ে মাকে সে কথাটা জানালো। গর্ভপাতের জন্য ‘এ’-কে দ্রুত ক্লিনিকে নিয়ে গেলেন মা। তবে চিকিৎসকরা সম্ভাব্য পার্শ্ব প্রতিক্রিয়ার যে বর্ণনা দিলেন তাতে ‘এ’ খুব ভয় পেয়ে গেলো। মনে হলো, গর্ভপাত করাতে গেলে সে মরে যাবে। আর তাই আশ্রয়কেন্দ্রে ফিরে গেল। সেখানেই কয়েক মাস ধরে লুকিয়ে থাকলো। কয়েক মিটার দূরত্বে থাকা টয়লেট ব্যবহার করা ছাড়া ঘর থেকে বের হতো না ‘এ’। ‘অনাকাক্সিক্ষত’ সে শিশুর জন্য অপেক্ষা করা ছাড়া আর কিছুই করার ছিল না তার। এপিকে ‘এ’ বলে, ‘আমি ন্যায়বিচার চাই। সেকারণে আপনাদের সঙ্গে কথা বলছি।’
এপি’র প্রতিবেদনে বলা হয়, গত বছর রাখাইনে সেনাবাহিনীর জাতিগত নিধনযজ্ঞ চলার সময় যে রোহিঙ্গা নারীরা অন্তঃসত্ত্বা হয়েছেন, তারা সব কিছু হারিয়ে ফেলার ঝুঁকি বোধ করেন। সেকারণে কেউ জানে না, ধর্ষণের শিকার কতজন নারী সন্তান জন্ম দিয়েছে। মেডিসিন্স স্যান্স ফ্রন্টিয়ার্সেরধাত্রী ড্যানিয়েলা ক্যাসিও বলেন, ‘মাতৃত্বকালীন পরীক্ষা-নিরীক্ষা করাতে তারা সামনে আসবে না। তারা তাদের গর্ভাবস্থার কথা লুকোতে চায়। আমি নিশ্চিত, গর্ভাবস্থা চলাকালে এবং প্রসবের সময় অনেকে মারা গেছে।’
‘এ’-এর মতো আরেক ভুক্তভোগী নারী ‘এম’ (নামের আদ্যক্ষর)। মিয়ানমারের সেনা সদস্যদের হাতে ধর্ষণের শিকার এ নারী এখন আছেন বাংলাদেশের রোহিঙ্গা শিবিরে। এপি’র সাংবাদিকরা সেখানে গিয়ে দেখেন ‘এম’ একটি মাদুরের ওপর বসে আছেন। ধর্ষণের কারণে ভূমিষ্ঠ হওয়া তার শিশু সন্তানটিকে কোলে নিয়ে পাশে দাঁড়িয়ে আছে আট বছরের বোন। বাচ্চাটিকে মায়ের কাছে দেওয়ার চেষ্টা চলছিলো। তবে হাত তুলে ‘এম’ জানিয়ে দিলেন তাকে কোলে নেবেন না। বলেন, ‘আমি আর তাকে বয়ে বেড়াতে চাই না। আমি ওকে ভালোবাসি না।’
এপিকে ‘এম’ জানান তার সেই দুঃসহ স্মৃতির কথা। জানান, গত বছরের আগস্টে তার গ্রামে আক্রমণ করে মিয়ানমারের সেনারা। বাড়িতে বসেই গুলির আওয়াজ আর চিৎকার শুনতে পান ‘এম’। বাইরে তাকিয়ে দেখেন, সেনারা ঘর-বাড়িতে আগুন দিচ্ছে। তার দুই মেয়ে পালিয়ে গেলো। কিন্তু দুই বছরের ছেলেকে নিয়ে ঘর থেকে বের হতে গিয়ে ‘এম’ দেখেন ছয় সেনা সদস্য অপেক্ষা করছে। তাদের একজন ‘এম’ এর কাছ থেকে ছেলেকে ছিনিয়ে নিয়ে গলা টিপে ধরলো। এরপর প্রাণহীন দেহটাকে নিচে ফেলে দিলো। সেনারা জোর করে ‘এম’ কে ঘরের ভেতর নিয়ে গেলো এবং ধর্ষণ করলো। দুইদিন পর তার স্বামী এসে তাকে নিতে বাড়িতে গেলো এবং একসঙ্গে বাংলাদেশে পালিয়ে এলো তারা। এম-এর স্বামী তার কাছে জানতে চাচ্ছিলেন, সেনারা তাকে ধর্ষণ করেছে কিনা। ‘এম’ তাকে কিছু বলতে পারলেন না, শুধু বললেন সেনারা তাকে পিটিয়েছে। আস্তে আস্তে ‘এম’ বুঝতে পারলেন শরীরে আরেকটি শরীর ধারণ করেছেন তিনি।

আরও পড়ুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও দেখুন...
Close
Back to top button