সিলেটে বিএনপিকে জামায়াতের ‘ধাক্কা’!
সিলেট সিটি করপোরেশন নিবার্চনে জামায়াতে ইসলামীর মেয়র প্রার্তীকে নিবার্চন থেকে সরে দাড়ানোর জন্য বিএনপির সব চেষ্টাই ব্যর্থ হয়েছে। জামায়াতের প্রার্থী তার মনোনয়ন প্রত্যাহার করেননি। এই সিটিতে বিএনপির নেতৃত্বাধীন ২০-দলীয় জোটের এখন দুজন প্রার্থী। এর আগে সিটি করপোরেশন নিবার্চনে ২০-দলীয় জোটে এমন ঘটনা ঘটেনি। জোটের প্রধান দুই শরিক বিএনপি ও জামায়াতের প্রার্থী থাকায় এই সিটি করপোরেশন নিবার্চনে ভোটের হিসাবনিকাশ পাল্টে যেতে পারে বলে মনে করছেন দুই দলের স্থানীয় নেতারা।
শুধু ভোটের হিসাব নয়, স্থানীয় সরকারের এই নিবার্চনে বিএনপি-জামায়াতের মুখোমুখি অবস্থান দল দুটির জাতীয় রাজনীতিতে প্রভাব ফেলবে বলে মনে করা হচ্ছে। বিএনপির নাম প্রকাশের অনিচ্ছুক দুজন নেতা বলছেন, এটা সম্ভবত বিএনপিকে জামায়াত একটা ধাক্কা দিল। তাদের মতে, দীঘির্দন থেকে জামায়াতের সঙ্গে কিছুটা শিথিল সম্পর্ক চলছিল বিএনপির। কিন্তু সিলেটের ঘটনায় জামায়াতের ছাড় না দেয়ার ঘটনাটি জাতীয় নিবার্চনে দলটির দর-কষাকষির স্পষ্ট ইঙ্গিত বলে মনে করা হচ্ছে। তা ছাড়া দলীয় চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া কারাগারে যাওয়ার পর থেকে বিএনপির সঙ্গে জামায়াতের যে টানাপড়েন শুরু হয়েছিল, সিলেট নিবার্চনে তা প্রকাশ্যে চলে এলো।
স্থানীয় নিবার্চন হলেও জামায়াতে ইসলামীর এ অবস্থানে বিস্মিত হয়েছেন বিএনপির অনেক নেতা। প্রাথির্তা প্রত্যাহার না করায় সোমবার দলের জ্যেষ্ঠ নেতারা পরবর্তী করণীয় নিয়ে নিজেদের মধ্য আলোচনা করছেন। আবারও এ বিষয়টি নিয়ে জামায়াতের সঙ্গে নেতারা কথা বলবেন বলে জানিয়েছেন।
সোমবার সিলেট সিটি করপোরেশন (সিসিক) নিবার্চনে মেয়র প্রাথীের্দর মনোনয়ন প্রত্যাহারের ছিল শেষ দিন।
সিলেট সিটি করপোরেশন নিবার্চনের রিটার্নিং কমকর্তা মো. আলীমুজ্জামান জানিয়েছেন, এই নিবার্চনে মেয়র প্রার্থী রয়েছেন সাতজন। এর মধ্যে বিএনপির বিদ্রোহী প্রার্থী ও জামায়াতের প্রার্থীসহ কেউই তাদের মনোনয়ন প্রত্যাহার করেননি। মঙ্গলবার প্রার্থীেদের মধ্যে প্রতীক বরাদ্দ দেয়া হবে। এরপর শুরু হবে প্রচার-প্রচারণা। অবশ্য জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধন না থাকায় দলটি দলীয় প্রতীক ‘দাড়িপাল্লা’ নিয়ে নিবার্চন করতে পারবেন না। তাকে স্বতন্ত্র নিবার্চন করতে হবে।
সোমবার শেষ দিনে সিলেট নগর জামায়াতের আমির এহসানুল মাহবুব সিটি নিবার্চনে তার প্রাথির্তা প্রত্যাহার করেননি। ইতোমধ্যে এহসানুল মাহবুব নগরের বিভিন্ন পাড়া-মহল্লায় মতবিনিময়ও অব্যাহত রেখেছেন। এ ছাড়া নগর বিএনপির সাধারণ সম্পাদক বদরুজ্জামান সেলিম বিদ্রোহী প্রার্থী হিসেবে নিবার্চন করার জন্য মনোনয়ন সংগ্রহ করেছেন। তিনিও তার মনোনয়ন প্রত্যাহার করেননি। যদিও কেন্দ্রীয় বিএনপির পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, বিএনপি ও ২০-দলীয় জোটের শরিক দল রাজশাহী, বরিশাল ও সিলেট সিটি নিবার্চনে একক প্রার্থীর পক্ষে কাজ করবে। কিন্তু সিলেটে বিএনপির বিদ্রোহী প্রার্থী ও জামায়াতের স্বতন্ত্র প্রাথীর্র মনোনয়ন প্রত্যাহার না করার ফলে নতুন একধরনের জটিলতার মধ্য দিয়ে যেতে হবে বিএনপিকে।
সিলেটে বিএনপির নিবার্চন পরিচালনা কমিটির সদস্য সচিব হয়েছেন বিএনপির কেন্দ্রীয় সহসম্পাদক আবদুর রাজ্জাক। তিনি বলেছেন, ‘আমরা চেষ্টার কোনো ত্রুটি করিনি। জোটের বৈঠকে জামায়াতের কেউ আসেননি। আবার কেন্দ্রীয় বৈঠকে জামায়াত ছিল। সেখানে সবর্সম্মত সিদ্ধান্ত হয় যে তিন সিটিতেই বিএনপির মনোনীত প্রার্থীই জোটের প্রার্থী। কিন্তু সিলেট জামায়াত তা মানছে না।’
সিলেট জামায়াতের এক নেতা রোববার বলেন, কেবল স্থানীয় সিদ্ধান্তে তারা নিবার্চন করছেন তা নয়। কেন্দ্রও বিষয়টি অবগত। তিনি বলেন, জামায়াতে দীঘির্দন কোনো বড় নিবার্চনে নেই। সিটি করপোরেশন নিবার্চনে অংশ নেয়ায় দলটি সামনে আসছে। তাদের ভোটের বিষয়টিও এখন সামনে আসবে। রাজনীতিতে জামায়াতের অবস্থান যে কম নয়, সেটি দেখানো একটা উদ্দেশ্য।
সম্প্রতি বিএনপির তিন সদস্যের একটি প্রতিনিধিদল ভারত সফরে যায়। প্রতিনিধিদলে ছিলেন বিএনপির জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, ভাইস চেয়ারম্যান আবদুল আউয়াল মিন্টু এবং আন্তজাির্তক বিষয়ক সম্পাদক হুমায়ুন কবির। ওই সফরে তারা ভারতকে আশ্বস্ত করতে চেয়েছেন যে বিএনপি তার আগের ‘ভারতবিরোধী’ অবস্থান থেকে সরে এসেছে। বিএনপির আগের অবস্থান ঠিক ছিল না। এ ছাড়া ওই সফরে জামায়াত নিয়ে বিএনপির নিজের অস্বস্তির বিষয়েও কথা বলেন বিএনপির নেতারা। এ বিষয়টি খুব ভালোভাবে নেয়নি জামায়াত।
২০১৩ সালের ১ আগস্ট রাজনৈতিক দল হিসেবে জামায়াতের নিবন্ধন অবৈধ ঘোষণা করেন হাইকোর্ট। ফলে দলটির নিবন্ধন বাতিল হয়ে যায়। নিবন্ধন বাতিলের কারণে এই দলের প্রতীক দাঁড়িপাল্লা নিয়ে আর কেউ নিবার্চনে অংশ নিতে পারবেন না। এই রায়ের পর বিভিন্ন স্থানীয় নিবার্চনে দলীয় প্রতীকে নিবার্চন অনুষ্ঠিত হয়েছে। এসব নিবার্চনে বেশির ভাগই জামায়াত বিএনপির একক প্রার্থীর পক্ষে কাজ করেছে। কোথাও কোনো ধরনের সমস্যা কিংবা দ্বিমত দেখা যায়নি। কাউন্সিলর পদে এবং কিছু ছোট পদ ছাড়া কখনো মেয়র পদ নিয়ে সমস্যা হয়নি। জামায়াতের সঙ্গে জোট গঠনের পর প্রথমবারের মতো বিএনপি-জামায়াতের মধ্যে এমন অবস্থার সৃষ্টি হলো।
জামায়াতের নিবন্ধন বাতিল হওয়ার পর এবং ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নিবার্চনের আগে দেশজুড়ে চলা সহিংসতার কারণে জামায়াতের রাজনীতি আর মাঠে থাকেনি। জামায়াতের কেন্দ্রীয় নেতারা সবাই আড়ালে চলে যান। এরপর বেশ কয়েকবার গুঞ্জন উঠেছিল জামায়াতের সঙ্গ ছাড়ছে বিএনপি! যদিও সেই গুঞ্জন বাস্তবে রূপ নেয়নি। জামায়াতের নিবন্ধন বাতিল ও যুদ্ধাপরাধের মামলায় জামায়াতের নেতাদের শাস্তির বিষয়ে বিএনপির ‘নীরবতা’ দেখে জামায়াত তাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবতে থাকে। বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া কারাগারে যাওয়ার পর এই প্রথম বিএনপি-জামায়াত ‘দ্বন্দ্ব’ প্রকাশ্যে এলো।
সিলেটে জামায়াতের প্রাথীর্র মনোনয়ন প্রত্যাহার না করার বিষয়টি জাতীয় নিবার্চনে নিজেদের আসন বিষয়ে বিএনপিকে ছাড় না দেয়ার ইঙ্গিত প্রকাশ করছে। জামায়াতের দলীয় নিবন্ধন না থাকায় দলটি জাতীয় নিবার্চনে নিজেদের প্রার্থী দিতে পারবে না। ফলে জামায়াতের সামনে একটি সুযোগ বাকি থাকে, সেটি হলো স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নিবার্চন করা। কিন্তু বিএনপি যদি জামায়াতের সঙ্গে আপস না করে কিংবা জামায়াতের চাওয়া অনুযায়ী আসন বরাদ্দ না দেয়, তাহলে জামায়াতের ভবিষ্যৎ কী হবে? এই চিন্তা থেকেই মূলত জামায়াত সিলেটে নিজেদের প্রার্থীকে প্রত্যাহার করেনি। জামায়াত এটাই জানান দিচ্ছে, জাতীয় নিবার্চন সামনে রেখে বিএনপির সঙ্গে হিসাবের সময় এসে গেছে।