বিলেতে প্রশ্নবৃদ্ধ বাংলাদেশী রাজনীতি
ইব্রাহিম খলিল : গনতন্ত্রের দেশ বৃটেন এখন বাংলাদেশী সহিংস রাজনীতির থাবায় শংকিত। মাত্র কয়েক বছর আগেও যে বৃটেনে কোন বাংলাদেশী বিপথে পড়লে সব ভ’লে স্বদেশীরা ছুটে যেতেন দু:সময়ের সাথী হতে। সে বৃটেনে স্বদেশী রাজনীতির কারনে বাংলাদেশীদের মমতার দৃষ্ঠি এখন প্রতিহিংসার দৃষ্ঠিতে রুপ নিয়েছে। বিলেতে বাংলাদেশী রাননৈতিক ও সামাজিক সংগঠনের কর্মীদের আচরন এমন পর্যায়ে এসে পৌছে যে, এখন একে অন্যের মধ্যে মতের বিরোধ নিয়ে কথা কাটাকাটি কিংবা উত্তপ্ত বাক্য বিনিময়ে সীমাবদ্ধ থাকেনা বরং এটি এখন লাঠালাঠি চেয়ার ছুড়াচুরিতে গড়িয়ে যায়। এমনকি রাজনৈতিক কর্মীরা নিজেদের অন্ত:কোন্দলে জড়িয়ে পড়ছেন অহরহ।
বাংলাদেশের বাহিরে তৃতীয় বাংলা বলা হয়ে থাকে বিলেতকে। ইতিহাস ঐতিহ্যের এই তৃতীয় বাংলা এখন ক্ষত বিক্ষত ধ্বংসাত্মক বাংলাদেশী রাজনীতির কারনে। বাংলাদেশী এসব রাজনীতি চর্চার কারনে যেমন বাঙালী কমিউনিটিতে বাড়ছে প্রকাশ্য হামলা তেমনি ছড়াচেছ দেশের ন্যয় চরম হিংসা বিদ্বেষ। রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে কমিউনিটির সামাজিক সংগঠনগুলোর মধ্যে দ্বন্ধ ও সংঘাত। বাংলাদেশ থেকে আসা একশ্রেণীর রাজনীতিবিদ ও বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের কর্মীরা এই ভাইরাস ছড়াচেছন বলে অভিযোগ সচেতন প্রবাসীদের। তারা আশংকা করছেন এমন অবস্থা যতো বেশী বিরাজ করবে ততোই দেশের প্রতি আগ্রহ হারাবো এবং ঘৃনা জন্মাবে বিলেতে বেড়ে উঠা তৃতীয় প্রজন্মের ছেলে মেয়েদের।
সম্প্রতিক কয়েকটি ঘটনা পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, প্রত্যেকটি ঘটনার সাথে জড়িয়ে আছে ক্ষমতার দ্বন্ধ, অভ্যন্তরিন কোন্দল, মাছুল প্রদর্শনী,একে অন্যকে ছাড় না দেওয়ার মানসিকতা এবং সর্বোপরি বাংলাদেশের অস্থিতিশীল রাজনীতির প্রভাব। বাংলাদেশী রাজনীতিকে কেন্দ্র করে গত ২ সপ্তাহের ব্যবধানে বৃটেনের বাঙালী কমিউনিটিতে ৩টি অপ্রীতিকর ঘটনা সংঘটিত হয়েছে। এর মধ্যে গত ১০ সেপ্টেম্বর সোমবার রাতে লন্ডনে বেসরকারী বাংলা চ্যানেল এটিএনবাংলা ইউকের অফিসে তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনুর উপর ন্যক্কারজনক হামলা দেশে বিদেশে আলোচিত হচেছ। এর আগে ২ সেপ্টেম্বর বামিংহামে যুক্তরাজ্য যুবলীগের সম্মেলনে মতদ্বৈতা নিয়ে অনাকাঙ্খিত ঘটনা ঘটে। নিজ দলের কর্মীরা একে অন্যের মধ্যে হাতাহাতি লিপ্ত হয়ে এক পর্যায়ে চেয়ার ছুড়াচুড়িতে জড়িয়ে পড়েন। পন্ড হয়ে যায় সম্মেলন। পুলিশ এসে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রনে আনে। এ খবর মিডিয়ার কল্যানে ছড়িয়ে পড়ে পুরো ইউরোপের বাঙালীদের মাঝে। উত্তেজনা দেখা বামিংহামের স্থানীয় বাঙালী কমিউনিটিতে। একই ভাবে গত রোববার বিশ্বখ্যাত কুইনমেরী ইউনিভার্সিটিতে জাতীয়তাবাদী আইনজীবি ফোরামের পূর্ব নির্ধারিত সেমিনার পন্ড হয়ে যায় নিজ দলের অপর গ্রুপের বাধার মুখে। সেমিনারে বাংলাদেশ থেকে লন্ডনে আগত বিএনপির কেন্দ্রীয় দুই নেতা হট্টগোলের কারনে অবস্থা বেগাতিক দেখে ইউনিভাসির্টির মেইন গেইট থেকে কেটে পড়েন। এর আগেও ২০১০ সালে বৃটিশ হাউজ অব লর্ডস সদস্যর সামনে লন্ডনের স্কুল অব ইকোনমিক্সসে আওয়ামীলীগ-বিএনপি লড়াই দেখেছেন বিদেশীরা। ইতিপূর্বে লন্ডনে হামলার শিকার হন দৈনিক আমার দেশ এর ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক মাহমুদুর রহমান ও বার্মিংহামে হামলার শিকার হন প্রয়াত আওয়ামীগের সাবেক সাধারন সম্পাদক আব্দুল জলিল। রাজনৈতিক সংগঠনগুলোর পাশাপাশি পাল্লা দিয়ে বাড়ছে বাংলাদেশী সামাজিক সংগঠনগুলোর দ্ব্ন্ধ ও সংঘাত। সম্প্রতি বৃটেনের ঐতিহ্যবাহী সংগঠন প্রবাসী বালাগঞ্জ-ওসমানী নগর এডুকেশন ট্রাষ্ঠের অভ্যন্তরিন কোন্দল জের ধরে মারামারি সংগঠিত হয়েছে। সেখানে লাঠিসোটার ব্যবহারও হয়েছিলো। পুলিশ এসে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রনে না আনলে সেখানে ঘটতে পারতো রক্তারক্তির মতো ঘটনা। রাজনৈতিক ও সামাজিক সংগঠনগুলোর এসব মারামারির ঘটনায় মামলা মকদ্দমাও চলছে দীর্ঘদিন ধরে। জেল জরিমানা মাথায় নিয়ে ঘুরে বেড়াচেছন অসংখ্য নেতাকর্মী। ঘটনা তদন্তে কাজ করছে বৃটিশ পুলিশ। তাদের কাছে বাংলাদেশীদের এসব হিং¯্রতার রেকর্ড জমা হচেছ। পুলিশ এসব ঘটনার রিপোর্ট করে বৃটিশ হোম অফিসে। হোম অফিসে ধীরে ধীরে জমা হচেছ বাংলাদেশীদের আমলনামার খতিয়ান। হয়তো কোন একদিন এসব খতিয়ান প্রকাশ করবে বৃটিশ হোম অফিস। তাতে দলবাজ রাজনৈতিক নেতাদের কিছু না হলেও লজ্জা আর হতাশার গ্লানি বইতে হবে পুরো জাতিকে।
বৃটেনে বসবাস করেন পৃথিবীর ২ শতাধিক অভিবাসী। তাদের মধ্যে বাঙালীরা টপ টেন এ অবস্থান করছেন। একটি দরিদ্র দেশের দরিদ্র অভিবাসী বৃটেনে বাঙালীরাও দরিদ্র অবস্থানে। বর্তমানে চতুর্থ প্রজন্মের বসবাস বৃটিশ-বাংলাদেশীদের অর্জনও কম নয়। বৃটিশ পালামেন্ট সদস্য, লর্ড সদস্য, নির্বাহী মেয়র, লর্ড মেয়র, অসংখ্য বরার কাউন্সিলারসহ বৃটিশ সোসাইটির বিভিন্ন ক্ষেত্রে অসামান্য অবধান রেখে চলেছেন বাংলাদেশীরা। শিক্ষাক্ষেত্রেও বাঙালী ছেলে মেয়েদের অসাধারন রেজাল্ট নজর কাড়ছে বৃটিশ সমাজে। অবারিত সুযোগ সুবিধার এই বৃটেনে বাংলাদেশীরা যেখানে বৃটিশ মূলধারার রাজনীতিতে আরো বেশী মনোযোগী হওয়ার কথা সেখানে তারা ইদানিং বেশী মনোযোগী হয়ে পড়েছেন বাংলাদেশী রাজনীতির দিকে। বৃটেনে বসবাস করে কেন বাংলাদেশী রাজনীতি করেন সোজা ঝাপটা এমন প্রশ্ন রাখা হয়েছিলো কয়েকটি সংগঠনের নেতাদের কাছে। তার মধ্যে বিএনপির আর্ন্তজাতিক সম্পাদক মুহিদুর রহমানে বক্তব্য হচেছ,
বাংলাদেশ আমাদের রুট। দেশের প্রত্যেকটি ক্ষেত্রে সচেতন থাকার তাগিদেই এখানে রাজনীতি করা। প্রত্যেক প্রবাসীর একটি ব্যক্তিগত পচন্দ ও দৃষ্ঠিভঙ্গি আছে। তারা মনে করেন তাদের পচন্দের দলটি ক্ষমতায় আসলে দেশের মানুষের কল্যান ও মঙ্গল হবে। সে জন্য বিদেশের মাটিতে বসে দলটিকে সাপোর্ট ও উৎসাহ প্রদান করে থাকেন। এটা দোষের নয়। যদি এটি নিয়মতান্ত্রিক ও গঠনমূলক উপায়ে হয়। তবে তিনি স্বীকার করেন বিলেতে বেড়ে উঠা নতুন প্রজন্ম দেশের প্রতি আগ্রহী নয়। তারা প্রচন্দ করেনা বাংলাদেশের প্রচলিত ধারার বর্তমান রাজনীতি।
একই প্রশ্ন রাখা হয় যুক্তরাজ্য আওয়ামীলীগের সাধারন সম্পাদক সৈয়দ সাজিদুর রহমান ফারুকের কাছে। তার বক্তব্য হচেছ, বাংলাদেশের মানুষের অধিকার আধায়ের সংগ্রাম করার জন্য আমরা যারা দেশে রাজনীতি করেছিলাম সেই সংগ্রামের ধারাবাহিকতা বজায় রাখছি যুক্তরাজ্যে এসেও। আমাদের ধ্বমনিতে বঙ্গবন্ধুর রক্ত। বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলাদেশ গড়তে প্রবাস থেকে আমরা সহযোগিতা করতে চাই। এছাড়াও বর্তমান মাহাজোট সরকারের সকল উন্নয়নমূলক কর্মকান্ডকে প্রবাসীদের মাঝে তুলে ধরতে এখানে রাজনীতির করার মূল উদ্দেশ্য বলে তিনি জানান।
বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামির যুক্তরাজ্য প্রতিনিধি ব্যরিস্টার আবু বকর মোল্লাকে এ বিষয়ে অবহিত করলে তিনি জানান, জামায়াতে ইসলামির কোন শাখা যুক্তরাজ্যে নেই। আমরা বহি:বিশ্বে বাংলাদেশী স্টাইলের কোন রাজনীতি করিনা। তবে মানবাধিকার রক্ষা ও অনিয়ম অবিচারের বিরুদ্ধে সোচচার ভ’মিকা পালন করি। তিনি বলেন, আমাদের পক্ষ থেকে আয়োজিত কোন সভা সমাবেশে নিজেদের মধ্যে মারামারি তো দুরের কথা কোন ধরনের কথা কাটাকাটির ইতিহাস যেমন বিদেশের মাটিতে নেই এমনকি দেশের মাটিতেও তা বিরল।
তবে বিশ্লেষকরা বলেছেন, বাংলাদেশের জাতীয় রাজনীতির অস্থিতিশীল প্রভাব পড়েছে বৃটেন প্রবাসী রাজনৈতিক কর্মীদের উপর। যার ফলে দিন দিন বাড়ছে এসব সংঘাত ও সংঘর্ষের ঘটনা। প্রবাসীরা সচেতন না হলেও বিদেশের মাটিতে অন্যান্য জাতি গোষ্ঠির কাছে লজ্জিত হবেন হবে রাজনীতির বাহিরে থাকা সাধারন প্রবাসীরা।