ফিলিস্তিনীদের অধিকার নিশ্চিত না হলে ট্রাম্পের শান্তি পরিকল্পনা মানবে না সৌদি আরব
আরব মিত্রদের আশ্বস্ত করলেন বাদশাহ সালমান
ফিলিস্তিন-ইসরাইল সংঘাত নিরসনে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের বহুল আলোচিত মধ্যপ্রাচ্য শান্তি পরিকল্পনা মেনে না নেওয়ার কথা জানিয়েছে সৌদি আরব। দেশটির বাদশাহ সালমান আরব মিত্রদের জানিয়েছেন, যদি এই পরিকল্পনায় জেরুসালেমের অবস্থান ও ফিলিস্তিনী শরণার্থীদের ফিরে যাওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত না হয় তাহলে তা মানবে না রিয়াদ। সম্প্রতি বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে সৌদি আরব ইসরাইল ঘেঁষা এই মার্কিন পরিকল্পনাকে সমর্থন জানাতে পারে- এমন খবরের প্রেক্ষিতে আরব মিত্রদেশগুলোকে আশ্বস্ত করলেন সৌদি বাদশাহ।
কূটনীতিক ও বিশ্লেষকদের সূত্র উল্লেখ করে মধ্যপ্রাচ্যবিষয়ক সংবাদমাধ্যম মিডল ইস্ট আই জানায়, ফিলিস্তিনি প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাসের সঙ্গে একান্ত বৈঠকে বাদশাহ সালমান এই অবস্থানের কথা জানিয়েছেন। ফিলিস্তিন ইস্যুতে সৌদি আরবের দীর্ঘদিনের অবস্থান অটুট থাকবে বলে আশ্বস্ত করেছেন আব্বাসকে। প্রভাবশালী যুবরাজ মুহাম্মদ বিন সালমানের নেতৃত্বে ফিলিস্তিন ইস্যুতে সৌদি আরবের দীর্ঘদিনের এই অবস্থান বদলে যাচ্ছে বলে যে পরিবেশ তৈরি হয়েছে এতে করে তা ঢাকা পড়বে বলে মনে করা হচ্ছে।
সৌদি আরবের এই অবস্থান পরিবর্তন ফলে ইসলামের জন্মভূমি সৌদি আরব ইসরাইল-ফিলিস্তিন সংঘাত নিরসনে নতুন আরব দেশগুলোকে চাপ দেবে কিনা তা সামনে এসেছে। বিশেষ করে আঞ্চলিক প্রতিদ্বন্দ্বি ইরানের দিকে চোখ রেখে সমাধানের কোন পথে নেবে সৌদি আরব তা দেখার বিষয়।
রিয়াদে অবস্থানরত এক সিনিয়র আরব কূটনীতিক বলেন, সৌদি আরবে এখন পুরো বিষয়টি সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন যুবরাজ নয়, স্বয়ং বাদশাহ। যুক্তরাষ্ট্রের ভুল ছিল তারা মনে করেছিল একটি দেশের চাপেই কাজ হয়ে যাবে, কিন্তু বিষয়টি চাপের নয়। কোনও আরব নেতাই জেরুজালেম বা ফিলিস্তিনকে অগ্রাহ্য করতে পারেন না।
ডিসেম্বরে ফিলিস্তিনি কর্মকর্তারা ব্রিটিশ বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে জানান, এমবিএস বলে পরিচিত সৌদি যুবরাজ ফিলিস্তিনি প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাসকে চাপ দিয়েছেন ট্রাম্পের শান্তি পরিকল্পনা মেনে নিতে। আশঙ্কা করা হচ্ছে, এই প্রস্তাবে পশ্চিম তীরেই ফিলিস্তিন রাষ্ট্রকে সীমাবদ্ধ রাখা এবং ১৯৪৮ সালে ইসরাইলের দখলদারিত্বের মধ্যে উচ্ছেদ হওয়া ফিলিস্তিনি শরণার্থীদের নিজ ভূমিতে ফেরার অধিকার রাখা হবে না এই চুক্তিতে।
ট্রাম্পের এই পরিকল্পনাটি ২০০২ সালে নেওয়া সৌদি পরিকল্পনার সঙ্গে সাংঘর্ষিক। সৌদি আরবের ওই শান্তি পরিকল্পনায় বলা হয়েছিল, আরব দেশগুলো ইসরাইলের সঙ্গে স্বাভাবিক সম্পর্ক বজায় রাখবে যদি ফিলিস্তিনকে রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি এবং ইসরাইল কর্তৃক ১৯৬৭ সালে দখলকৃত অঞ্চল পুরোপুরি ফিরিয়ে দিতে হবে।
সৌদি কর্মকর্তারা ফিলিস্তিন ইস্যুতে সৌদি বাদশাহ ও যুবরাজের মধ্যে কোনও মতপার্থক্য আছে কিনা তা জানাতে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন। এপ্রিলে মার্কিন সাময়িকিকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে যুবরাজ জানান, ইসরাইলের শান্তিপূর্ণভাবে বসবাসের অধিকার রয়েছে। একজন আরব নেতা হিসেবে এমন বক্তব্য একেবারে বিরল।
রিয়াদে নিযুক্ত ফিলিস্তিনি রাষ্ট্রদূত বাসেল আল-আঘা রয়টার্সকে জানান, আব্বাসের সঙ্গে সর্বশেষ বৈঠকে সালমান বলেছেন, আমরা আপনাদের পরিত্যাগ করব না। আপনারা যা মেনে নিবেন আমরাও তা মেনে নেব, আপনারা যা প্রত্যাখ্যান করবেন আমরাও তা করব।
ফিলিস্তিন রাষ্ট্রদূত জানান, ২০১৮ সালের আরব লিগের সম্মেলনকে জেরুজালেম সম্মেলন নামকরণ করছেন সৌদি বাদশাহ। একই সঙ্গে ফিলিস্তিনের জন্য ২০০ মিলিয়ন ডলার সহযোগিতা দেওয়া হবে। এতে করে জেরুজালেম ও শরণার্থীদের ফেরার বিষয়টি আলোচনায় নিয়ে আসবে।
চলমান কূটনৈতিক এই উদ্যোগ সম্পর্কে সৌদি আরবের কোনও কর্মকর্তা আনুষ্ঠানিকভাবে কিছু জানাতে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন। মধ্যপ্রাচ্যের কূটনীতিকরা জানান, যুক্তরাষ্ট্রের পরিকল্পনার বিষয়ে গত মাসে হোয়াইট হাউসের সিনিয়র কর্মকতারা আরব নেতাদের অবহিত করেছেন। তবে এই পরিকল্পনায় পূর্ব জেরুজালেমকে ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের রাজধানী হিসেবে রাখা হয়নি। দখলকৃত ফিলিস্তিনি ভূখ- থেকে ইসরাইলের সরে যাওয়া ও শরণার্থীদের ফিরে যাওয়ার বিষয়টিও নেই।
শান্তি পরিকল্পনাটি বাস্তবায়নে দায়িত্বপ্রাপ্ত হোয়াইট হাউসের উপদেষ্টা ও ট্রাম্পের জামাতা জ্যারেড কুশনার ও বিশেষ দূত জেসন গ্রিনব্লাট এই বিষয়ে বিস্তারিত কিছুই জানাননি। এই দুজনকে দায়িত্ব দেওয়ার দেড় বছর পার হলেও চুক্তিটির বিষয়ে এখনও আনুষ্ঠানিকভাবে কিছু জানায়নি যুক্তরাষ্ট্র।
কুশনারের সৌদি আরব সফর সম্পর্কে অবহিত হওয়া রিয়াদের এক কূটনীতিক জানান, সৌদি বাদশাহ ও যুবরাজ একসঙ্গে কুশনারের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। যুবরাজ কুশনারের সঙ্গে আলোচনা করেন, বাদশাহ সেখানে উপস্থিত ছিলেন।
স্বতন্ত্র পর্যবেক্ষক নেইল পার্ট্রিক জানান, যুবরাজের রাজনৈতিকভাবে বেপরোয়া প্রবণতায় হয়ত লাগাম ধরতে চাইছেন সৌদি বাদশাহ। কারণ বিশ্বের মুসলিমদের কাছে জেরুজালেমের গুরুত্ব রয়েছে। সৌদি অ্যারাবিয়ান ফরেন পলিসি: কনফ্লিক্ট অ্যান্ড কোঅপারেশন বইয়ের প্রধান কন্ট্রিবিউটর ও সম্পাদক এই বিশ্লেষক বলেন, কুশনারের চুক্তির বিরোধিতার করবেন না যুবরাজ। কিন্তু এখন আর তিনি এই চুক্তি মেনে নেওয়ার বিষয়ে কাউকে হয়ত উৎসাহিত করবেন না।
এক কূটনীতিক জানান, কুশনার ও গ্রিনব্লাট বিস্তৃত কোনও পরিকল্পনা হাজির করেননি কিছু খণ্ড খণ্ড বিষয় ছাড়া। যা অনেক সীমা লঙ্ঘণ করেছে। তারা মিসরের সিনাই উপত্যকা ও গাজা উপত্যকাকে মিসরের অধীনে নিয়ে একটি অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তোলার বিষয়ে মার্কিনিরা মনোযোগ কেন্দ্রীভূত করেছে। যা অগ্রহণযোগ্য।
এই কূটনীতিক আরও জানান, কুশনার কাতারের আমির শেখ তামিম বিন হামাদ আল-থানিকে উন্নয়ন সহযোগিতার বদলে গাজার নিয়ন্ত্রণ ছেড়ে দেওয়ার জন্য হামাসকে চাপ দিতে বলেন।
ওই বৈঠক সম্পর্কে অবহিত হওয়া এক কূটনীতিক জানান, কুশনারের প্রস্তাবে শেখ তামিম শুধু মাথা নাড়িয়েছেন। এতে স্পষ্ট হয়নি কাতার এটা মেনে নিয়েছে অথবা এই প্রস্তাবের বিপরীতে কাতার কিছু দাবি করেছে কিনা।