পবিত্র হজ্ব পালিত
অন্যায়ের কাছে মাথা নত না করার আহ্বান
লাব্বাইকা আল্লাহুম্মা লাব্বাইক (হে আল্লাহ হাজির তোমার দরবারে) ধ্বনিতে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ২০ লক্ষাধিক মুসলমান নিজেদেরকে আল্লাহর কাছে সোপর্দ করে সোমবার পবিত্র হজ্ব পালন করেছেন। ইহ্রামের দু’টুকরো সাদা কাপড় পরিধান করে আরাফার ময়দানে হাজিরা আল্লাহর কাছে কান্নাকাটি করেছেন। জীবনের সকল অপরাধের কথা স্মরণ করে আল্লাহর রহমত কামনা করেন। তারা বিশ্বের শান্তি সমৃদ্ধি কামনা করে আল্লাহর কাছে দোয়া করেছেন।
খুতবায় ইসলামের সকল বিধিবিধান পালনের গুরুত্ব উল্লেখ করে কোন অবস্থাতে অন্যায়ের কাছে মাথানত না করার জন্য বিশ্বের মুসলমানদের প্রতি আহবান জানানো হয়েছে। শিক্ষা ব্যবস্থায় পরিবর্তন এনে মানুষের চরিত্র গঠনের জন্য খুতবায় বিশ্ববাসীকে আহবান জানানো হয়েছে। মুহাম্মদ সা. এর মতো সৎ চরিত্রের মানুষ তৈরী হলেই গোটা বিশ্বে শাস্তি প্রতিষ্ঠিত হবে বলে খুতবায় উল্লেখ করা হয়।
সোমবার আরাফার ময়দানে বিশ্বের লাখ লাখ আল্লাহ প্রেমিকের এক মহাসম্মিলন অনুষ্ঠিত হয়েছে। এ সম্মিলনে চলমান বিশ্বের প্রেক্ষাপট তুলে ধরে আরাফার ময়দান সংলগ্ন মসজিদে নামিরায় হজে¦র খুতবা প্রদান করেন মসজিদে নববির সিনিয়র ইমাম ও খতিব মদিনা কোর্টের বিচারপতি শায়খ ড. হুসাইন আশ শায়খ।
স্থানীয় সময় দুপুর ১২টা ১৮ মিনিটে তিনি খুতবা দেওয়া শুরু করেন। ৩১ মিনিটব্যাপী খুতবা শেষ হয় ১২টা ৪৯ মিনিটে। পবিত্র হজ্বের খুতবা সৌদি আরবের রাষ্ট্রীয় টেলিভিশন ও বিশ্বের বিভিন্ন সরকারি- বেসরকারি টেলিভিশন সরাসরি সম্প্রচার করে। মসজিদে নামিরায় উপস্থিত থেকে খতিবের খুতবা শুনেন সৌদি আরবের গ্রান্ড মুফতি, মক্কার গভর্নর, রাজপরিবারের সদস্য এবং বিভিন্ন দেশে উচ্চ পর্যায়ের প্রতিনিধিরা।
খুতবায় শায়খ ড. হুসাইন আশ শায়খ ইবাদতের প্রতি গুরুত্বারোপ করেন। তিনি নামায, রোজা, হজ্ব, জাকাত ও সৎকাজের আদেশের বিষয়ে আলোচনা করেন। তিনি নবী-রাসূলদের জীবনের উদাহরণ টেনে বলেন, কোনো অবস্থাতেই অন্যায়ের কাছে মাথানত করা যাবে না। আল্লাহর একত্ববাদের বিষয়টি মানতে হবে। এর কোনো বিকল্প নেই।
খতিব সাহেব জ্ঞানার্জানের প্রতি বিশেষ গুরুত্বারোপ করেন। তিনি বলেন, জ্ঞান মানুষকে অন্ধকার থেকে আলোর পথে নিয়ে যায়। জ্ঞান সুসংবাদ বহন করে। মানুষকে আল্লাহতায়ালা তার ইবাদতের জন্য সৃষ্টি করেছেন। এটা বুঝতে হলে- জ্ঞানার্জন করতে হবে।
তিনি নামায কায়েমের কথা বলেন। এ সময় তিনি জাকাত পরিপূর্ণভাবে আদায়ের জন্যও তাগাদা দেন। এসব ইবাদত মানুষকে আল্লাহর প্রিয়পাত্রে পরিণত করে উল্লেখ করে তিনি বলেন, রমযান মাসে রোজা রাখা ও হজ পালন অনেক ফজিলতপূর্ণ আমল। খতিব ড. হুসাইন আশ শায়খ হজ্বের গুরুত্ব ও ফজিলত নিয়ে কোরআন-হাদিসের বহু উদ্ধৃতি পাঠ করেন।
খুতবায় তিনি মানুষের চরিত্র গঠনের প্রতি গুরুত্ব দেওয়ার জন্য শিক্ষা ব্যবস্থার বিষয়গুলো সন্নিবেশ করার কথা বলেন। তিনি বলেন, নবী করিম (সা.) ছিলেন উত্তম চরিত্রের অধিকারী। আমরা তার উম্মত। কিন্তু চরিত্রের দিক থেকে আমাদের অবস্থান অনেক অনেক নিচে। এটা লজ্জার। চরিত্র সবকিছুর মূল উল্লেখ করে তিনি বলেন, চরিত্রের সাথে অনেক কিছু জড়িত। ওয়াদা রক্ষা, মিথ্যা পরিহার, বয়োজ্যেষ্ঠদের সঙ্গে শ্রদ্ধাপূর্ণ ব্যবহার, ছোটদের স্নেহ, বাবা-মার প্রতি দায়িত্বপালন ও স্ত্রীর অধিকারের মতো বিষয়গুলো চরিত্রবানরাই পালন করেন।
খতিব সবাইকে সতর্ক করে বলেন, সূর্যাস্তের আগে যেন কেউ আরাফা ময়দান ত্যাগ না করে। যদি কেউ সূর্যাস্তের আগে আরাফা ময়দান ত্যাগ করে তাহলে তার হজ্ব হবে না বলেও তিনি হুশিয়ার করে দেন।
হজ্বের খুতবায় খতিব তাওহিদ বা আল্লাহর একত্ববাদের প্রতি গুরুত্বারোপ করেন। একমাত্র আল্লাহর ইবাদত করতে বলেন। তিনি বলেন, যারা আল্লাহর পথ ধরবেন আল্লাহ তাদেরকে শান্তিতে রাখবেন।
আল্লাহ, ফেরেশতা, কিতাব, আখেরাত এসবের প্রতি ঈমান সুদৃঢ় করার প্রতি তাগিদ দেন খতিব। মুসলিম উম্মাহকে ঐকবদ্ধ হওয়ার তাগিদ দেন, বিচ্ছিন্ন না হতে বলেন।
খতিব আরো বলেন, আল্লাহর রাসুল সা. আমাদের জন্য দুটি জিনিস রেখে গেছেন, সেই দুটি জিনিস হলো কোরআনে কারিম ও আল্লাহর রাসুলের সুন্নত। প্রতিটি মুসলমানের উচিত এই দুটি জিনিসকে আঁকড়ে ধরা।
তিনি বলেন, কোরআন জীবনের সব ক্ষেত্রের জন্য। এজন্য কোরআনকে আঁকড়ে ধরতে হবে। কোরআন পড়তে হবে, সেই অনুযায়ী চলতে হবে। পরিশেষে খতিব সৌদি বাদশা, হারামাইনের যার খেদমত করছেন এবং সমগ্র মুসলিম উম্মাহর জন্য দোয়া করেন।
খুতবায় তিনি কুরআন হাদিসের মূলনীতির ভিত্তিতে বিশ্বমুসলিমকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার জন্য আহ্বান জানান। তিনি পরস্পর ভেদাভেদ ভুলে গিয়ে শান্তিময় অসাম্প্রদায়িক বিশ্ব প্রতিষ্ঠা করার জন্য সকলের প্রতি আহ্বান জানান।
আজ থেকে ১৪শ ২৯ বছর আগে এই দিনে রাসূল (সা.) আরাফার ময়দানে সমবেত লাখো জনতার উদ্দেশ্যে ভাষণ প্রদান করেন। এই ভাষণে তিনি ইসলামের পরিপূর্ণতা ঘোষণা করাসহ জীবন পরিচালনার বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্য তুলে ধরেন।
এবারের খুতবায় ইসলামের বিভিন্ন দিকনির্দেশনা তুলে ধরে বিশ্বমুসলিমের শান্তি, মুক্তি ও কল্যাণ কামনা করা হয়। এছাড়া পবিত্র কুরআন হাদিসের উদ্বৃতি দিয়ে ইসলামের বিভিন্ন বিধি বিধান এবং পরকালের পুরস্কার ও শাস্তি সম্পর্কে আলোচনা করা হয়।
আরাফার ময়দান থেকে বিভিন্ন বার্তা সংস্থা জানায়, সকালের দিকে মক্কায় হালকা ঝড় বৃষ্টি হয়েছে বলে বিভিন্ন বার্তা সংস্থা জানিয়েছে। আর সৌদি আরবের আবহাওয়া বার্তায় বৃষ্টির কারণে বন্যা হওয়ার আশঙ্কা করা হয়েছে। এদিকে পবিত্র হজ্ব পালনের উদ্দেশ্যে রোববার ফজরের পর থেকেই মক্কার অদূরে মিনা নগরী অভিমুখে লাখো মানুষের ঢল নামে। বেশিরভাগ লোক গাড়িযোগে, আবার কেউ কেউ ৩/৪ ঘণ্টা পায়ে হেঁটে মিনায় পৌঁছান। শ্বেতশুভ্র লাখো তাঁবুতে ঢাকা পড়েছে মিনা নগরী। চারপাশে মহানবীর ম্মৃতি বুকে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে নগরীর জাবালে নূর, জাবালে রহমতসহ বিভিন্ন পাহাড়। এ পাহাড়ের একটির নাম হেরা। এই হেরা গুহায় হযরত মুহাম্মদ (সা.) নবুয়ত লাভ করেছিলেন। রোববার রাতেই অনেকে আরাফা ময়দানে উপস্থিত হন। আবার অনেকে গতকাল সকালে মিনা থেকে আরাফা ময়দানে আসেন। আরাফার ময়দানে বিশ্বের সর্ববৃহৎ মসজিদ ‘মসজিদে নামিরাহ’ থেকে হাজিদের উদ্দেশ্যে প্রতি বছরের মতো খুতবা দেয়া হয়েছে।
খুতবা ও মুনাজাত শেষে সমবেত হাজিরা সোমবার যোহর ও আসরের নামায একত্রে আদায় করে সূর্যাস্তের পর মুজদালিফার উদ্দেশ্যে আরাফাত ময়দান ত্যাগ করেছেন। হাজিরা বালু ও কংকরময় মুজদালিফায় খোলা আকাশের নিচে অবস্থান করে মাগরিব ও ইশার নামায আদায় করেন ইশার ওয়াক্তে। এছাড়া পবিত্র কুরআন তেলাওয়াত, জিকির-আযকার ও ইবাদাত বন্দেগির মাধ্যমে রাত্রি যাপন করেন। এখান থেকে তারা ৪৯টি (১৩ জিলহজ্ব পর্যন্ত পাথর মারলে ৭০টি) ছোট আকারের পাথর সংগ্রহ করে আজ মঙ্গলবার সূর্যোদয়ের সাথে সাথেই মুজদালিফা থেকে পুনরায় মিনায় ফিরে গিয়ে অদূরে নির্মিত শয়তানের তিনটি প্রতিকৃতির বড় একটি প্রতিকৃতি তথা বড় জামরায় পাথর ছুঁড়ে মারবেন। তারপর কুরবানি করে মাথামুন্ডনের মাধ্যমে পবিত্র হবেন। ইহ্রামের কাপড় ত্যাগ করে সাধারণ পোশাক পরিধান করে হাজিরা মক্কায় ফিরে গিয়ে পবিত্র কা’বা শরিফ তাওয়াফ করবেন। যারা আজ তাওয়াফ করতে পারবেন না তারা কাল বা পরশু তথা ১৩ জিলহজ্ব পর্যন্ত তাওয়াফ করতে পারবেন।
সৌদি আরবের বিভিন্ন বার্তা সংস্থা জানায়, পবিত্র হজের দিনে হাজিদের নির্বিঘ্নে হজব্রত পালনে ব্যাপক প্রস্তুতি নিয়েছে সৌদি সরকার। ইতোমধ্যে হজ মন্ত্রনালয়ের কর্মকর্তা, সিভিল ডিফেন্স কর্মী, নিরাপত্তা কর্মী, ডাক্তার, নার্স, প্যারামেডিক এবং মিডিয়া কর্মীদের নিয়োগ দেয়াসহ অত্যাধুনিক হেলিকপ্টারে করে বিশেষজ্ঞ নিরাপত্তা কর্মীরা আকাশে টহল দিচ্ছে বলে জানিয়েছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কতৃপক্ষ। মাঠে রয়েছে আর্মি, পুলিশ, স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী ও স্কাউট সদস্যরা। অগ্নিনির্বাপণের জন্য প্রস্তুত রয়েছে অত্যাধুনিক সরঞ্জাম সংবলিত সিভিল ডিফেন্সের গাড়ি ও হেলিকপ্টার।
হাজিদের স্বাস্থ্যসেবার জন্য মিনা, মুজদালিফা ও আরাফাতে স্থায়ী হাসপাতাল ছাড়াও রয়েছে অসংখ্য ভ্রাম্যমাণ চিকিৎসাকেন্দ্র ও এয়ার অ্যাম্বুলেন্স। আহত হাজিদের চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে এবং নিহত হাজিদের লাশ স্বযতেœ রাখা হচ্ছে। হাজিদের সুবিধা-অসুবিধা দেখাশোনার জন্য রয়েছে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের কয়েক হাজার কর্মকর্তা।