দেশের হাওড় বিল থেকে বিলুপ্তির পথে জাতীয় ফুল শাপলা
মুহাম্মদ নূরে আলম: বাংলা সাহিত্যে বিখ্যাত উপন্যাসের নাম তিতাস একটি নদীর নাম। এই তিতাস নদীকে কেন্দ্র করে জেলার বিভিন্ন উপজেলার খাল হাওড় ও বিলে অজস্র শাপলা ফুল দেখা যেত। লাল কিংবা সাদা শাপলা ফুল দেখে মুগ্ধ হন না, এমন লোক খুঁজে পাওয়া কঠিন। কিন্তু কালের বিবর্তনে হারিয়ে যাচ্ছে শাপলা ফুল। আর তার সাথে সাথে বিপন্নের পথে জলাভূমির ফল ‘ঢ্যাপ’বা ভেট। শাপলার ফলকেই ‘ঢ্যাপ’ বা ভেট বলা হয়। ব্রাক্ষণবাড়িয়া এর আঞ্চলিক নাম ‘ ভেট’। পানির অভাবে দেশের জাতীয় ফুল শাপলার প্রাকৃতিক উৎপাদন বিলুপ্তির পথে। শাপলার জন্য বিখ্যাত ব্রাক্ষবাড়িয়াতে এখন এই ফুলটি তেমন মিলে না। জেলার অসংখ্য নদ-নদী, খাল-বিল, হাওর-বাঁওড়, পুকুরসহ জলাশয় হ্রাস পাওয়া এবং ভূমিদস্যুদের দখলে চলে যাওয়ায় দেখা দিয়েছে পানির শূন্যতা। এতে ব্যাপকভাবে কমে যাচ্ছে শাপলা ফুলে উৎপাদন।
বাংলা নাম শাপলা ফুল, ইংরেজি নাম লিলি বা ওয়াটার লিলি, মনিপুরী ভাষায় থরো, আংগৌরা, তামিল ভাষায় ভেলাম্বাল, সংস্কৃত ভাষায় কুমুডা, আসাম ভাষায় শাপলা ফুলকে নাল বলা হয়। শুধু বাংলাদেশ নয় শ্রীলংকায়ও জাতীয় ফুল এই শাপলা। শ্রীলংকায় শাপলাকে বলে নীল-মাহানেল। গ্রিক দার্শনিক প্লেটো ও এরিস্টটলের এক শিষ্য থিউফ্রাস্টাস বলেছেন, এটা একটি জলজ উদ্ভিদ যা প্রায় ৩০০ খ্রিস্টপূর্ব পুরোনো।
ব্রাক্ষণবাড়িয়া ও নবীনগর উপজেলা কৃষি অফিস সূত্রে জানাযায়, জাতীয় ফুল শাপলা সাধারণত আবদ্ধ অগভীর জলাশয়, খাল-বিলে জন্মে থাকে। বাংলাদেশের আবহাওয়ায় সাধারণত পাঁচ প্রকার শাপলা ফুল দেখা যায়। সাদা, লাল, বেগুনি, হলুদ ও নীল রঙের। এর মধ্যে সাদা শাপলা হলো বাংলাদেশের জাতীয় ফুল। গ্রামবাংলার আনাচে কানাচে হাওড় বিলে ঝিলে পুকুরে ডোবায় অহরহ দেখা যেত এ জলে ভাসা ফুল। তবে এখন অযতœ অবহেলায় আর কৃষি জমিতে মাত্রাতিরিক্ত কীটনাশক ও রাসায়নিক সার ব্যবহারের কারণে জাতীয় ফুল শাপলা হারিয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে। নবীনগর উপজেলায় দু’ধরনের শাপলা দেখতে পাওয়া যেত। একটি সাদা আরেকটি লাল। স্থানীয় ভাষায় সাদা শাপলাকে শাপলা আর লাল শাপলাকে রক্ত শাপলা বলা হয়ে থাকে। এ শাপলা ফুল যখন আবদ্ধ জলাশয়ে অনেক ফুটে থাকে তখন সেখানে এক অপরূপ সৌন্দর্যের সৃষ্টি হয়। আর ফুল থেকে যে অংশ ফলে রূপান্তরিত হয় তাকে স্থানীয় ভাষায় ভেটও বলা হয়ে থাকে। এ ঢ্যাবের ভিতরে অনেক ছোট ছোট বীজ থাকে। এগুলো মানুষ উঠিয়ে নিয়ে ভেঙ্গে শুকিয়ে খই ভেজে খায়। এ খই খুবই সুস্বাদু।
ব্রাক্ষণবাড়িয়ার সর্বত্র অসংখ্য নদ-নদী, খাল-বিল, ঝিল, হাওর-বাঁওড়, পুকুরসহ জলাশয়সমূহে দেখা যেত এই জলে ভাসা শাপলা ফুল। ব্রাক্ষণবাড়িয়াতে গত কয়েক দশক ধরে অপরিকল্পিত কল-কারখানার বৃদ্ধিতে নদী-নালা, খাল-বিল, হাওর-বাঁওড় ভূমিদস্যুদের দখলে চলে যাওয়ায় ক্রমশ হ্রাস পেয়ে যাওয়ায় এবং কৃষি জমিতে অধিক পরিমাণে কীটনাশক ও রাসায়নিক সার ব্যবহারের কারণে জাতীয় ফুল শাপলা বিলীন হয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে।
ব্রাক্ষণবাড়িয়া জেলার নবীনগর, বিজয়নগর, সরাইল, বাঞ্ছারামপুর, নাসিরনগর ও সদর উপজেলাসহ বিভিন্ন এলাকায় কিছু লাল শাপলা দেখা গেলেও সাদা, হলুদ, নীল, বেগুনি শাপলা প্রায় হারিয়ে যেতে বসেছে। এখনো দূর-দূরান্ত হতে আসতো মানুষ জেলার বিজয়নগর ও নবীনগর উপজেলার বারো আউলিয়ার বিলের সাদা ও লাল শাপলা দেখতে। বর্ষা মৌসুমে বিভিন্ন এলাকায় খাল-বিল জলাশয় ও নিচু জায়গায় পানি জমা থাকলে সেখানেই প্রাকৃতিকভাবেই জন্ম নেয় আমাদের জাতীয় ফুল শাপলা।
কিছুদিন আগেও বিজয়নগর উপজেলার বিভিন্ন অঞ্চলে প্রচুর পরিমাণে শাপলা ফুল দেখা যেত। তখন পুকুর খাল বিল ও জলাশয়গুলোতে লাল, সাদা, বেগুনি ও বিরল প্রজাতির হলুদ শাপলা ফোঁটার কারণে চারিদিকে নয়নাভিরাম প্রাকৃতিক দৃশ্যে পরিণত হতো।
ব্রাক্ষণবাড়িয়ার নবীনগর উপজেলার বিভিন্ন স্থানে লাল প্রজাতির শাপলা দেখা গেলেও দেখা যাচ্ছে না সাদা, গোলাপী, বেগুনি, নীল ও হলুদ শাপলা। এসব শাপলা হারিয়ে যাওয়ার পেছনে বিভিন্ন কারণ রয়েছে বলে মনে করে ব্রাক্ষণবাড়িয়ার সচেতন মহল। কারো কারো মতে মেঘনা, সুরমা ও বিখ্যাত তিতাস নদীগুলোর নাব্য হ্রাস, ভূমিদস্যুদের জলাশয় ভরাট করে কৃষিজমি তৈরি, ঘর-বাড়ি তৈরি, ফসলি জমিতে মাত্রাতিরিক্ত কীটনাশক ব্যবহার এবং জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ব্রাক্ষণবাড়িয়ার থেকে জাতীয় ফুল শাপলা হারিয়ে যেতে বসেছে।
এক সময়ে ব্রাক্ষণবাড়িয়ার ঝিলে বিলে পুকুরে বর্ষা মৌসুমে নানা রঙের শাপলার বাহারি রূপ মানুষের নয়ন জুড়িয়ে যেত। কিন্তু এখন আস্তে আস্তে হারিয়ে যেতে বসে নয়নাভিরাম সেই দৃশ্য। শাপলা ছোটদের খুব প্রিয়। শাপলার ভ্যাট বাচ্চাদের প্রিয় খাদ্য এবং গ্রামের লোকেরা ভ্যাট দিয়ে খই ভেজে মোয়াসহ বিভিন্ন প্রকার সুস্বাদু খাবার তৈরি করে। ব্রাক্ষণবাড়িয়ার গ্রামগঞ্জের মানুষের কাছে সবজি হিসেবেও খুব জনপ্রিয় এই শাপলা। অনেকে আবার শাপলা তুলে বাজারে বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করতো। এছাড়া লাল শাপলার অনেক ঔষধি গুণ রয়েছে। যেমন শাপলার মূল কা- খেলে আমাশয়ের মতো রোগ ভালো হয় বলে জানা যায়। সংশ্লিষ্টরা মনে করেন, আমাদের জাতীয় স্বার্থে শাপলা ফুলকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে। এখনই এ ব্যাপারে উদ্যোগী না হলে এক সময় হারিয়ে যাবে গ্রাম-বাংলার ঐতিহ্য ও জাতীয় ফুল শাপলা।
নবীনগর পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়ের সাবেক প্রধান শিক্ষক শহিদুল ইসলাম মানিক স্যার বলেন, আমার স্কুল পড়ুয়া নাতী জাতীয় ফুল শাপলা চিনেনা। তাকে ছবি দেখিয়ে শাপলা চেনাতে হয়। নারায়নপুর গ্রামের প্রাইমারি স্কুলের প্রথম শ্রেণির শিক্ষার্থী মুনসিফ ইসলাম মাহির বলেন, শাপলা ফুল দেখিনি। চিনি না। শিক্ষকদের কাছে শুনেছি এবং বইয়ে পড়েছি শাপলা আমাদের জাতীয় ফুল। ওই স্কুলের এক শিক্ষিকা বলেন, ছেলেমেয়েরা এখন শাপলা ফুল দেখে না। তাই চেনে না। বইয়ের ছবি দেখে কিছুটা জানার চেষ্টা করে। খাল-বিল ও আবদ্ধ জলাশয়গুলো বালু দিয়ে ভরাটের কারণে সেখানে আর শাপলা জন্মাতে পারে না। এছাড়া আবদ্ধ জলাশয়গুলোতে আধুনিক পদ্ধতিতে মাছ চাষ করার ফলে শাপলা জন্মানোর ক্ষেত্রগুলো নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।
উপজেলার নবীন-প্রবীণদের অনেকেই বলেন, জাতীয় ফুল শাপলা এক সময় হয়তো কাগজে-কলমে, পাঠ্য বইপত্রে লেখা থাকবে। দ্রুত বিলুপ্তির কারণে বাস্তবে আর হয়তো শাপলা খুঁজে পাওয়া যাবে না। উপজেলার নারায়নপুর গ্রামের আজাদ মিয়া বলেন, এক সময় বিলে ঝিলে পুকুরে বর্ষা মৌসুমে নানা রঙের শাপলার বাহারী রূপে মানুষের নয়ন জুড়িয়ে যেত। শাপলা ছোটদের খুব প্রিয়। শাপলার ঢ্যাপ শিশুদের প্রিয় খাবার। গ্রামের মানুষের কাছে সবজি হিসেবেও খুব জনপ্রিয় ছিল এ শাপলা। অনেকে আবার বিল থেকে শাপলা তুলে বাজারে বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করতো।